মডেল তনয়ার হানিট্র্যাপ

logo

স্টাফ রিপোর্টার

২৮ এপ্রিল ২০২৫, সোমবার

mzamin

facebook sharing button

সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা। সংস্কৃতি অঙ্গনেও আছে বিচরণ। থাকেন চট্টগ্রামে। একটি মিউজিক ভিডিও’র সূত্র ধরে পরিচয় হয় ঢাকার ২৮ বছর বয়সী মডেল তনয়া হোসেন ওরফে নাজমুন নাহার সুখী ও তার বোন ৩২ বছর বয়সী তানিশা রহমান ওরফে কামরুন নাহার আঁখির সঙ্গে। পরিচয়ের পর ওই কর্মকর্তার সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তুলেন দুই বোন। প্রায়ই তাদের মধ্যে কথাবার্তা হতো। সরকারি কর্মকর্তাও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। আর এই সুযোগটাই কাজে লাগান তনয়া ও তানিশা। ফেব্রুয়ারি মাসে তাদের জানাশোনা হলেও তানিশা তার স্বামী সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়েছেন তাই চিকিৎসার জন্য ১০ লাখ টাকা ধার চান। শর্ত ছিল কিছুদিনের ভেতরে ফেরত দিবেন। পরে তিনি তানিশাকে ৫ লাখ টাকা ধার দেন। অল্প সময়ের ভেতরে টাকা ফেরতের কথা থাকলেও কয়েক সপ্তাহ পেরিয়ে যায়। তানিশা টাকা ফেরত দেননি। কিন্তু ওই কর্মকর্তা একাধিকবার তানিশার কাছে টাকা ফেরত চান। একপর্যায়ে এপ্রিলের মাঝামাঝি তানিশা টাকা নেয়ার জন্য ওই কর্মকর্তাকে ঢাকায় আমন্ত্রণ জানায়। কিন্তু তখনো তিনি জানতেন না টাকা ফেরত নিতে আসলে তার জীবনে কতোটুকু ভয়াবহ পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে। চলতি মাসে টাকা নিতে ঢাকা আসেন তিনি। তাকে নেয়া হয় একটি বাসায়। সেখানে যাওয়ার পর শুরু হয় কর্মকর্তার ওপর অমানবিক নির্যাতন। দুই বোন ও তাদের হানিট্রাপের সহযোগীরা মারধর, নির্যাতন করে আহত করেন। ধারণ করা হয় নগ্ন ভিডিও। সেই ভিডিও’র হুমকি দিয়ে হানিট্র্যাপ চক্রটি ৬০ লাখ টাকা আদায় করে। নগ্ন ভিডিও ধারণ করার পর ওই কর্মকর্তাকে ছেড়ে দেয় চক্রটি।

চট্টগ্রাম ফিরে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে পরিচিতদের সহযোগিতায় ভাটারা থানায় গিয়ে সব খুলে বলেন। ভাটারা থানা বিষয়টি আমলে নিয়ে অভিযান চালিয়ে তনয়া-তানিশাসহ তাদের সহযোগীদের গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠিয়েছে। শুনানিতে তাদের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি চাইবে পুলিশ। শনিবার রাতে ভাটারা এলাকায় সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। এ সময় গ্রেপ্তারকৃতদের কাছ থেকে আদায়কৃত চাঁদার ১৫ লাখ ৪৬ হাজার ৫০০ টাকা উদ্ধার করা হয়। গ্রেপ্তারকৃতরা হলো- নাজমুন নাহার সুখী ওরফে তনয়া (২৮),  কামরুন নাহার আঁখি (৩২) ওরফে তানিশা,  রুমানা ইসলাম স্মৃতি (৫০) ও মো. সাফাত ইসলাম লিংকন (২৫)।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ১৯শে এপ্রিল ওই কর্মকর্তা ঢাকা এসে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তখন তানিশা তাকে সন্ধ্যায় বসুন্ধরা এভারকেয়ার হাসপাতালের সামনে দাঁড়াতে বলেন। সেখানে গিয়ে তিনি দেখেন তনয়া তাকে অভ্যর্থনা জানাতে এসেছেন। পরে তাকে নিয়ে তনয়া এভার কেয়ার হাসপাতালের গেট থেকে ছোলমাইদ উত্তরপাড়ায় একটি ভাড়া বাসায় নিয়ে যায়। সেখানে পূর্বপরিকল্পিতভাবে গ্রেপ্তাররকৃত চারজনসহ আরেকজন অজ্ঞাতনামা ভুক্তভোগীকে বন্দি করে ফেলে। সেখানে সাফাত ইসলাম বালিশ দিয়ে তার মুখ চেপে শ্বাসরোধের চেষ্টা করে এবং অন্যরা তার হাত-পা বেঁধে মারধর করে। ভুক্তভোগীর চিৎকার যাতে বাইরে না যায়  সেজন্য উচ্চ শব্দে টিভিতে গান বাজায় তারা। সেই আওয়াজের মধ্যেই হকিস্টিক হাতে দুই যুবক তাকে পেটাতে থাকে। তাকে রশি দিয়ে হাত-পা বেঁধে ফেলা হয়, মুখে বালিশচাপা দিয়ে দফায় দফায় নির্যাতন চালানো হয়। ওই কর্মকর্তা তখন প্রাণে বাঁচার জন্য নানা আকুতি করেন। তাকে আর কখনো টাকা ফেরত দিতে হবে না বলেও জানান। তার বিনিময়ে যেন তাকে মারধর করা না হয়। কিন্তু তাদের মন গলেনি, বরং অত্যাচারের পরিমাণ আরও বেড়ে যায়। পরে তার কাছে ১ কোটি টাকা চাওয়া হয়। টাকা না দিলে মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হয়। কিন্তু এত টাকা দিতে অপারগতার কথা জানান। তখন আবার মারধর করে কর্মকর্তার বোনের কাছে ফোন দিতে বলে। প্রাণ বাঁচাতে তখন বোনকে তিনি ফোন করে বলেন, আমি বিপদে আছি। আমার এক কোটি টাকা দরকার। পরে আবার বোনকে ফোন দিয়ে বলেন, যা স্বর্ণ আছে বিক্রি করে বা ধার করে হলেও টাকা পাঠাও। পরে তার বোন ও বন্ধু মিলে মোট ৫২ লাখ টাকা সংগ্রহ করেন। তনয়ার নাম্বারে ফোন করে এসএ পরিবহনের মাধ্যমে টাকা পাঠানোর পরামর্শ দেয়া হয়। ওই নাম্বারটি ছিল পুরুষের নামে। টাকা দুই কিস্তিতে ২৬ লাখ করে মোট ৫২ লাখ টাকা পাঠানো হয়। এরপর এসএ পরিবহনের গুলশান-২ শাখা থেকে ফোন পেয়ে তনয়া ও সঙ্গী সেই টাকা সংগ্রহ করেন। সব মিলিয়ে তারা তার কাছ থেকে ৬০ লাখ টাকা আদায় করে। টাকা পাওয়ার পর তনয়া, তানিশা ও তাদের সহযোগীরা ওই কর্মকর্তার সমস্ত পোশাক খুলে উলঙ্গ অবস্থায় ছবি ও ভিডিও ধারণ করে। তারা তাকে হুমকি দিয়ে বলে, এসব ঘটনা কাউকে বললে বা থানা পুলিশ করলে নগ্ন ভিডিও ছড়িয়ে দিয়ে মানহানি করে ক্যারিয়ার শেষ করে দিবে।  ওই রাত ১১টার দিকে তাকে গাড়িতে তুলে নিয়ে তার মোবাইল ও ২০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়া হয় এবং একটি গেঞ্জি পরিয়ে গাড়ি থেকে বাড্ডার অন্ধকার এলাকায় ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়া হয়। প্রথম রিকশাচালক ভয় পেয়ে চলে গেলেও, দ্বিতীয় একজন তাকে উদ্ধার করে হোটেলে পৌঁছে দেন। পরদিন তিনি চট্টগ্রামে ফিরে হাসপাতালে ভর্তি হন। কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর চট্টগ্রামেরই একজন সংস্কৃতিকর্মী ও রাজনৈতিক নেতার সহায়তায় ২৪শে এপ্রিল ঢাকার ভাটারা থানায় গিয়ে সব খুলে বলেন। এ ঘটনায় ২৬শে এপ্রিল ভাটারা থানায় মামলা হয়।

পুলিশ জানিয়েছে, তনয়া মডেল হিসেবে বিভিন্ন মিউজিক ভিডিও ও ইউটিউবভিত্তিক নাটকে কাজ করেন। আর তানিশারও একই জগতে বিচরণ আছে। তার স্বামী দুবাইয়ে থাকেন এবং তার একটি কন্যাসন্তান রয়েছে বলেও তিনি প্রচার করেন। থাকেন অভিজাত বসুন্ধরা এলাকার আই ব্লকে। তাদের বাড়ি লক্ষ্মীপুর সদরের বড়ালিয়ায়। তারা মূলত একটি হানিট্র্যাপ চক্রের সদস্য। তাদের নামে বিভিন্ন থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। বিভিন্ন ব্যক্তিদের টার্গেট করে তারা হানিট্র্যাপে ফেলে টাকা আদায় করে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক রুবেল মিয়া মানবজমিনকে বলেন, মিউজিক ভিডিও’র সূত্র ধরে ওই কর্মকর্তার তাদের সঙ্গে পরিচয় হলেও এক সময় পারিবারিকভাবে ভালো সম্পর্ক তৈরি হয়। তনয়ার পাশাপাশি তানিশার সঙ্গে সখ্যতা ছিল। একপর্যায়ে একটি সমস্যার কথা বলে তানিশা ৫ লাখ টাকা ধার নেয়। টাকা ফেরত দেয়ার কথা বলে একটি বাসায় নিয়ে তারা দুই বোন ও আরও তিনজনসহ শারীরিক মানসিকভাবে নির্যাতন করে মুক্তিপণ আদায় করে। তারা তার নগ্ন ভিডিও ধারণ করে। মূলত এ ধরনের অভিযোগের প্রেক্ষিতে আমরা মামলা নিয়ে আসামিদের গ্রেপ্তার করি। ঘটনার সত্যতাও পাই। তিনি বলেন, এই মডেলরা হানিট্র্যাপের মাধ্যমে মানুষের কাছ থেকে টাকা আদায় করে। আমরা ওই কর্মকর্তার কিছু টাকা উদ্ধার করেছি। এখন রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করবো।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here