ভ্যানে লাশের স্তুপ করা ভিডিও আশুলিয়া থানা রোডের

mzamin

whatsapp sharing button

কি মর্মান্তিক! হৃদয় বিদারক। গা শিউরে ওঠা ভিডিও। গুলিবিদ্ধ মরদেহ গুনে গুনে প্যাডেল ভ্যানে তুলছে পুলিশ। ভ্যানে তুলেই একটি পরিত্যক্ত ব্যানার দিয়ে লাশগুলো ঢেকে দেয়া হচ্ছে। গুলিবিদ্ধ একজন তখনো জীবিত ছিলো। নিথর দেহ ঝাঁকুনি দিয়ে উঠছে। নড়াচড়া করছেন। এক মিনিট ১৪ সেকেন্ডের একটি ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে। যা নিয়ে তোলপাড় চলছে। মানুষ জানতে চাচ্ছে।

ঘটনাটি কোথায়। কখন, কিভাবে ঘটেছে। তবে কেউই সঠিক তারিখ ও ঘটনাস্থল বলতে পারছে না। কেউ কেউ অনুমান নির্ভর তথ্য শেয়ার করছেন। তবে মানবজমিন অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে প্রকৃত ঘটনা। কোথায়, কিভাবে,  এই ঘটনার পেছনের আদ্যপান্ত তুলে আনার চেষ্টা করেছে মানবজমিন।

সরজমিন জানা গেছে, পুলিশের ভ্যানের লাশের স্তুপ করে রাখা মর্মান্তিক ঘটনাটি আশুলিয়া বাইপাইল এলাকার থানা রোডের গলিতে। থানার পাশেই ইসলাম পলিমারস এন্ড প্লাস্টিসাইজারস লিমিটেডের অফিসার ফ্যামিলি কোয়াটারের দেয়াল ঘেষে গুলিবিদ্ধ ৭ শিক্ষার্থীর মরদেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ছিলো। পরে পুলিশ লাশগুলো একত্রিত করে ভ্যানের উপর স্তুপ করে রাখেন। এরপরে ঘটে আরো মর্মান্তিক ঘটনা। যে ঘটনা বর্ণনা করাও কঠিন।

৫ আগষ্টের কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী মানবজমিনকে বলেন, গত ৫ আগষ্ট দুপুরে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পরপর বাইপাইল এলাকার বিজয় মিছিল বের হয়। মিছিল শেষে বিকেলে উত্তেজিত জনতা আশুলিয়া থানা ঘেরাও করেন। এতে পুলিশ সদস্যরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। থানার আশপাশে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা দৌড়ে থানা ভবনে ঢুকে পড়েন। ঢুকেই তারা থানার গেইট বন্ধ করে দেন। তখন বিকেল সাড়ে ৪টার বাজে। মাত্র ৫ মিনিটের মধ্যে আন্দোলনকারীরা চারদিক থেকে থানা ঘিরে ফেলেন। তারা থানা ভবনে ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। কেউ কেউ গেইট ভাঙতে এগিয়ে যান। অবস্থা বেগতিক দেখে আশুলিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ এ এফ এম সায়েদ আহমেদ পুলিশ সদস্যদের অস্ত্র রেডি করতে বলেন। গুলি লোড করতে বলেন। এই কথা শুনে  উপস্থিতরা আরও চড়াও হন। আশপাশে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময় থানা ভবন থেকে বেরিয়ে এসে ৩০ থেকে ৩৫ জন পুলিশ সদস্য থানার গেইটে অবস্থান নেন। বিকেল ৪টা বেজে ৪০ মিনিট। ওসি সায়েদ আহমেদ গেইটে এসে উত্তেজিত জনতাকে নিবৃত করার চেষ্টা করেন। তখন আন্দোলনকারীরা পুলিশকে উদ্দেশ্য করে ‘ভুয়া ভুয়া’ স্লোগান দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে ওসি পুলিশ সদস্যদের অস্ত্র হাতে নিয়ে রেডি হতে বলেন। তখন ঘটনাস্থলে থাকা জনগণের মধ্যে ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্রজনতা পুলিশকে আত্মসমর্পণ করতে বলেন। তখন ওসি সায়েদ আহমেদ আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে বলেন, আমরা হেরেছি। আপনারা জিতেছেন। আমাদের মাফ করে দেন। সবাই বাড়ি ফিরে যান। একপর্যায়ে এসআই মালেক, ডিবির ওসি তদন্ত আরাফাত, এসআই আফজালুল, এসআই জলিল ছাত্র-জনতাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়েন। গুলিতে থানার গলিতে কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় পড়ে যান। মুহুর্মুহু গুলিতে লোকজন দৌড়ে পালিয়ে যান।

থানার সামনের বিল্ডিং থেকে পুরো ঘটনা স্বচক্ষে দেখা রনি আহমেদ নামের এক ব্যক্তি মানবজমিনকে বলেন, বিকেলে থানা ফটকের সামনে উত্তেজিত জনতার ওপর পুলিশ গুলি ছোড়ে। এতে থানার গেইটের সামনেই ১০ থেকে ১২ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যান। কয়েক মিনিট ধরে ওখানে গোলাগুলি চলে। পরে জীবিত কয়েকজনকে নিচু হয়ে এসে ছাত্ররা টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যান। তারপরেও ৬ থেকে ৭ জন ওখানে পড়েছিল। তখন আশপাশের সব অলিগলি জনগণ ঘিরে ফেলে। রাস্তা থেকেও লোকজন থানার দিকে রওনা হয়। পরে থানা থেকে সব পুলিশ সশস্ত্র হয়ে একযোগে বেরিয়ে আসেন। তারা গুলি করতে করতে বেরিয়ে আসেন।

 

ভ্যানে লাশের স্তুপ করা জায়গাটি পলিমারস এন্ড প্লাস্টিসাইজারস লিমিটেডের অফিসার ফ্যামিলি কোয়াটারের গেইটে। ওই গেইটের অপরপাশে সাদিয়া রাজশাহী কনফেকশনারী এন্ড মিষ্টান্ন ভান্ডারের মালিক ফাহিমা আক্তার মানবজমিনকে বলেন, ঘটনাটি আমার দোকানের সামনেই ঘটেছে। ৫ আগষ্ট বিকেলে সাড়ে ৪টা হবে। সেদিন গুলি খেয়ে থানার সামনে পড়ে থাকা মরদেহগুলো  ভ্যানে তুলছিলেন পুলিশ। আমাদের চোখের সামনেই তুলেছে। প্রথমে লাশগুলো তুলে ব্যানার দিয়ে ঢেকে থানার সামনে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে আগুন জ্বালিয়ে দেয়া হয়। সেই ঘটনা এখনো চোখের সামনে ভাসে।

 

ওইদিন ঘটনাস্থলে থানা রকি আহমেদ নামের এক পোশাক শ্রমিক মানবজমিনকে বলেন, পুলিশ প্রথমে গেইটে এসেই ইসলাম পলিমারস এন্ড প্লাস্টিসাইজারস লিমিটেডের অফিসার ফ্যামিলি কোয়াটারের সামনে পড়ে থাকা গুলিবিদ্ধ ৭ জনকে একটি প্যাডেল  ভ্যানে তুলেন। পরে তাদের থানার সামনে আনেন। পরে লাশগুলো থানার পার্কিংয়ে থাকা পুলিশের একটি পিকআপ ভ্যানে তুলে আগুন দেয়া হয়। ৭ জনের লাশ আগুনে পুড়িয়ে থানা থেকে সব পুলিশ বেরিয়ে থানা গলি দিয়ে হাঁটতে শুরু করেন। আর গুলি ছুড়তে থাকেন। আগুনে পুড়ে যাওয়া একজনের হাতে তখনো হাতকড়া ছিলো।

লাশের স্তুপ করা জায়গাটি হাত দিয়ে দেখিয়ে দিয়ে আসলাম হোসেন মানবজমিনকে বলেন, ভাল করে দেখেন। ভিডিওতে যে পোস্টারটি দেখা যাচ্ছে। সেটা এখনো দেয়ালে অক্ষত আছে। কিছু বালুর বস্তা ছিলো সেগুলো সরিয়ে নেয়া হয়েছে। সেদিন পুরো থানা রোডেই লাশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো। পুলিশ ভ্যান নিয়ে সব লাশ এক জায়গায় জড়ো করে। আম টোকানোর মত করে পুলিশ গলি দিয়ে লাশ টুকিয়েছে। পরে লাশগুলো থানার সামনে এনে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এই ঘটনা দেখেনি আশপাশে এমন কোনো মানুষ ছিলো না।  এ এক ভয়ানক ঘটনা। মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে।

আশুলিয়া থানার সামনে পুড়িয়ে দেয়া লাশের মধ্য জামগড়া শাহিন স্কুলের দশম শ্রেণীর শিক্ষার্থী আসশাবুরও ছিলেন। নিহত আসশাবুরের বড় ভাই রেজওয়ানুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, আমার ভাই গুলিবিদ্ধ হয়ে থানার পাশেই রাস্তায় পড়ে ছিলেন। পরে পুলিশ তার নিথর দেহ রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে পিকআপ ভ্যানে ঢুকিয়ে আগুন দিয়ে দেয়। ভাইটি আমার জীবিত ছিলো নাকি মৃত সেটা জানার সুযোগও আমাদের হয়নি। গুলিবিদ্ধ ৭ জনকেই আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয়। কে জীবিত কে মৃত তাও পুলিশ তা দেখার সুযোগ দেয়নি। আমার ভাই নীল গেঞ্জি পরিহিত ছিলো। আমরা গেঞ্জি দেখে পোড়া লাশ শনাক্ত করি।

আফজাল হোসেন নামের আরেক প্রত্যক্ষদর্শী মানবজমিনকে বলেন, পুলিশ থানা থেকে বের হওয়ার সময় কারও কারও হাতে দুটি অস্ত্র ছিল। অনেকে সিভিল ড্রেসে ছিলেন। অনেকের হাতে অচেনা অস্ত্র দেখেছি। তারা গুলি করতে করতে বের হন। কখনো গুলি বন্ধ করেনি। মেইন রোডে এসে একটি পিকআপ ভ্যানে আগুন দেন। ওই পিকআপ ভ্যানেও ৫ থেকে ৬টি গুলিবিদ্ধ মরদেহ ছিল। বিকালে যারা গুলিতে মারা গেছে তাদের ওই ভ্যানেই রাখা হয়েছিল। তারা নির্বিচারে গুলি চালাচ্ছিল। গুলি কখনো বন্ধ করেনি। অলিগলিতে, রাস্তায়, বাসাবাড়িতে যেখানে খুশি সেখানেই গুলি করেছে পুলিশ। তারা দলবদ্ধ ছিল। ৮০ থেকে ৯০ জন হবে।

বাইপাইল বাসস্ট্যান্ডের অটোরিকশা চালক মানবজমিনকে বলেন, পুলিশ থানা থেকে মেইন রোডে এসে ডান বাম দু’পাশেই গুলি চালায়। রাস্তার দু’পাশে গুলি চালাতে চালাতে তারা নবীনগরের দিকে আগাতে থাকেন। তখন মানুষ জীবন বাঁচাতে যে যার মতো দৌড়ে পালিয়েছে। এক মিনিটের জন্যও পুলিশ গুলি বন্ধ করেনি। যতক্ষণ হেঁটেছে ততক্ষণই তারা গুলি ছুড়েছে। রাস্তার দু’পাশে পথচারী, বাসাবাড়ি ও দোকানপাটের শত শত মানুষ ওইদিন গুলিবিদ্ধ হয়। এমন দিন কখনো দেখেনি বাইপাইলবাসী।

সেদিনের ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী কয়েকজন পথচারী মানবজমিনকে বলেন, পুলিশ থানা রোড থেকে গুলি করতে করতে সোহেল হাসপাতাল পর্যন্ত যায়। তখন গুলির শব্দ ছাড়া কিছুই শোনা যায়নি। চারদিকে মানুষের চিৎকার। বাঁচাও বাঁচাও। মনে হয়েছে যুদ্ধ লেগেছে। তখন মানুষ বাসাবাড়ি ছেড়ে পালাতে শুরু করেন। রাত তখন ৯টার বেশি বাজে। পুলিশ সামনের দিকে হেঁটে যাচ্ছিলেন। আর গুলি ছুড়ছিলেন। এভাবে তারা পল্লী বিদ্যুৎ পর্যন্ত চলে যায়। এই সময়ে শত শত মানুষকে গুলি খেয়ে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখেছি।

সেদিন নিহতের স্বজন ও হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ৫ই আগস্ট সকাল ৯টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত পুলিশ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের গুলিতে অন্তত ৩১ জন নিহত হোন। পরদিন গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় আরও ১৫ জন মারা যান। এতে ওই ঘটনায় মোট নিহতের সংখ্যা ৪৬ জন। এ ছাড়া গুলিবিদ্ধ হয়ে ধামরাই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, আশুলিয়ার নারী ও শিশু হাসপাতাল, আশুলিয়ার হাবিব ক্লিনিক, গণস্বাস্থ্য সমাজভিত্তিক হাসপাতাল, এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সাভারের বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন আছেন প্রায় দেড় হাজারের বেশি মানুষ।

একটি সূত্র মানবজমিনকে জানায়, ৫ই আগস্ট সন্ধ্যায় আশুলিয়া থানার অফিসার ইনচার্জ এ এফ এম সায়েদ, ওসি ইনটিলিজেন্স মিজানুর রহমান মিজান, ওসি অপারেশন নির্মল কুমার দাসের নেতৃত্বে পুলিশের ৯০ থেকে ১০০ জন সদস্য অস্ত্রসহ থানা থেকে বের হয়ে আসেন। বাইপাইলে পুলিশের নির্বিচারের গুলির খবর পেয়ে সাভার সেনানিবাস থেকে সেনাবাহিনীর একটি টহল টিম বাইপাইলের দিকে রওনা হয়। পল্লী বিদ্যুৎ পার হলে তারাও পুলিশের গুলির মুখে পড়েন। এতে দুই সেনাসদস্য গুলিবিদ্ধ হন। পরে সেনাবাহিনীর একাধিক টিম এসে পুলিশের সকল সদস্যকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। তাদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন। পরে কয়েক মিনিটের মধ্যেই পুলিশ সদস্যদের আটক করা হয়। তখন সবার হাতে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র জব্দ করা হয়। এরপর শত শত মানুষ পুলিশকে ঘিরে ফেলেন। পুলিশের কাছে জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালানোর কারণ জানতে চান। জনতাই বিচার করবে বলে পুলিশ সদস্যদের ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেন। এরপর সেনাবাহিনী তাদের নিরস্ত্র করে আটক করে সেনানিবাসে নিয়ে যান। সেদিন রাত ১০টার দিকে নবীনগর সেনানিবাসের গেইটে হাজার হাজার মানুষ জড়ো হন। পরে সেনাসদস্যরা জনতাকে নিবৃত করার চেষ্টা করেন। এসময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত সেনাবাহিনীর একজন মেজর উত্তেজিত জনতাকে নিবৃত করতে বক্তব্য দেন।

manabzamin