ভোট সুষ্ঠু করার অঙ্গীকার থেকে এখনো দূরে নির্বাচন কমিশন

সবার জন্য সমান সুযোগ রেখে নির্বাচন সুষ্ঠু করার ক্ষেত্রে যেসব বাধা আসতে পারে, তার অন্যতম হচ্ছে সরকারের কোনো সংস্থা যাতে হয়রানিমূলক মামলা না করে। সুষ্ঠু ভোটের ক্ষেত্রে আরেকটি বাধা অর্থ ও পেশিশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা। এ ধরনের ১৪টি বাধা চিহ্নিত করে কীভাবে তা মোকাবিলা করা হবে, নিজেরাই সেই কর্মপরিকল্পনা গত বছরের সেপ্টেম্বরে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেছিল নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর ইসির কর্মপরিকল্পনা প্রকাশের দিন সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল, নির্বাচনের আগে হয়রানিমূলক মামলা করা হবে না—এমন নিশ্চয়তা ইসি রাজনৈতিক দলগুলোকে দিচ্ছে কি না। এর জবাবে নির্বাচন কমিশনার আনিছুর রহমান বলেছিলেন, যে পরিস্থিতি ইসি সৃষ্টি করতে চায়, সবার সহযোগিতা পেলে সে রকম পরিবেশ হলে হয়রানিমূলক মামলা হবে না।

তবে বাস্তবে জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরও দেশে এখন পর্যন্ত সে রকম কোনো পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেনি ইসি। তফসিল ঘোষণার ৯ দিন পরও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তালা ঝুলছে। কার্যালয়ের সামনে মোতায়েন রয়েছে অতিরিক্ত পুলিশ। গত ২৮ অক্টোবর বিএনপির মহাসমাবেশে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের পর থেকে এই পরিস্থিতি চলছে।

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের কেন্দ্রীয় কমিটির ২১ জন নেতা এখন কারাগারে। বিএনপি ও এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন পদে থাকা ছয় শতাধিক নেতার মধ্যে গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে রয়েছেন কমপক্ষে ৮৫ জন। গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে আছেন দলটির অসংখ্য নেতা-কর্মী। মামলা ও গ্রেপ্তার এখনো চলছে। এসব বিষয় কার্যত আমলে নিচ্ছে না ইসি।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠু করতে নিজেদের কর্মপরিকল্পনাতেই সুষ্ঠু ভোটের পথে মোট ১৪টি বাধা এবং এসব বাধা উত্তরণে ১৯টি উপায়ের কথা বলেছিল ইসি। কিন্তু এই কর্মপরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো বাস্তবায়নে এখন পর্যন্ত কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি ইসি।

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে ১৫ নভেম্বর। ভোট গ্রহণ করা হবে আগামী ৭ জানুয়ারি। নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার এক সপ্তাহ পরও নির্বাচন কমিশনের কর্তৃত্ব দেখা যাচ্ছে না। কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচনের বার্তা দিতে পারছে না।

এক বছর আগে প্রকাশ করা কর্মপরিকল্পনার কতটি এখন পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়েছে, সেটি আর জানায়নি নির্বাচন কমিশন। এ বিষয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কমিশনের মুখপাত্র ও ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলমের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

ইসি ‘নীরব’

গত জুলাই মাসে এক সাক্ষাৎকারে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়ালের কাছে প্রথম আলোর প্রশ্ন ছিল, ‘ইসি বলেছে, সুষ্ঠু নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ উত্তরণের উপায়গুলোর মধ্যে একটি হলো সরকারের কোনো সংস্থা কর্তৃক হয়রানিমূলক মামলা না করা। এটি কীভাবে নিশ্চিত করবেন?’ জবাবে সিইসি বলেছিলেন, ‘অপেক্ষা করুন এবং দেখুন’।

যদিও বাস্তবে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা বন্ধ করতে ইসির কোনো নির্দেশনা বা পদক্ষেপ দেখা যায়নি। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইসি মনে করছে, যেসব দল নির্বাচনে আসবে, তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি দেখার দায়িত্ব ইসির। এর বাইরে অন্য কোনো রাজনৈতিক হয়রানির বিষয়ে তারা কিছু করবে না। আর বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়ে রেখেছে। দলটি তফসিলও প্রত্যাখ্যান করেছে। এ ক্ষেত্রে বিএনপির নেতাদের গ্রেপ্তার-মামলার বিষয়ে এই মুহূর্তে ইসির করণীয় কিছু নেই।

গত রোববার নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, যেসব দল নির্বাচনে আসবে, তাদের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে যত চেষ্টা, তার সবটাই করবে নির্বাচন কমিশন।

নির্বাচনের আচরণবিধি কঠোরভাবে প্রয়োগ, আচরণবিধি ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও নিজেদের কর্মপরিকল্পনায় বলেছিল ইসি। তবে শুরু থেকেই এ বিষয়ে ইসিকে গা-ছাড়া ভাবে থাকতে দেখা গেছে। নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচার শুরু হবে আগামী ১৮ ডিসেম্বর। এর আগে ১৬ ও ১৭ নভেম্বর রাজশাহী-১ আসনের সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী আচরণবিধি লঙ্ঘন করে নির্বাচনী এলাকায় দুটি অনুষ্ঠান করেন। ঘটনার পাঁচ দিন পর ওমর ফারুক চৌধুরী বা সমাবেশের উদ্যোগ গ্রহণকারীকে ‘সতর্ক’ করার সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন।

এ ছাড়া ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে দলীয় মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করতে ১৮-২১ নভেম্বর পর্যন্ত প্রতিদিন ভিড় করেন হাজারো নেতা-কর্মী। মনোনয়নপ্রত্যাশীদের অনেকেই মোটরসাইকেল ও পিকআপ ভ্যানের বহর নিয়ে ‘শক্তি ও ক্ষমতার’ মহড়া দিয়েছেন। অনেককে আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থীদের নৌকা প্রতীকে ভোট দেওয়ার আহ্বানসংবলিত প্ল্যাকার্ড নিয়ে হাজির হন। আচরণবিধি লঙ্ঘনের এসব ঘটনা নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ছবিসহ সংবাদ প্রকাশ হলেও ইসি ‘নীরব’। এ ক্ষেত্রে সাংবিধানিক এই সংস্থার দাবি, নির্বাচনী প্রচারের নির্ধারিত সময়ের আগে দলীয় প্রতীকে ভোট চাওয়া আচরণবিধি লঙ্ঘন নয়।

কথা দিয়েও সরে এল ইসি

নির্বাচন নিয়ে বিশিষ্ট নাগরিক, সাংবাদিকসহ অংশীজনদের সঙ্গে গত দেড় বছরে কয়েক দফা সংলাপ করেছে ইসি। এসব সংলাপে আসা সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে ইসি এবার সংসদ নির্বাচনে নিজেদের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে যত দূর সম্ভব রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা করার কথা বলেছিল। তবে নিজেদের কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে কাউকেই রিটার্নিং কর্মকর্তা করা হয়নি। দুজন বিভাগীয় কমিশনার ও ৬৪ জন জেলা প্রশাসককে (ডিসি) ৩০০ আসনের রিটার্নিং কর্মকর্তা করা হয়েছে। আর ৪৯৫ জন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা করা হয়েছে। ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের মধ্যে ৫৬ জন উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাকে সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা করা হয়েছে।

দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ দুটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন (২০১৪ ও ২০১৮ সালে) এবং স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলোতে পুলিশ ও প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ছিল। গত বছর অংশীজনদের সঙ্গে ইসির সংলাপেও বিষয়টি এসেছিল। কমিশন শুরুতে বিষয়টি আমলে নিয়েছিল। কর্মপরিকল্পনায় সুষ্ঠু ভোটের পথে যেসব চ্যালেঞ্জ বা বাধা চিহ্নিত করা হয়েছিল, তার একটি হচ্ছে ‘নির্বাচনের দায়িত্বে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা বিশেষ করে পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালন।’

তবে এটি কীভাবে কার্যকর করবে, সে বিষয়ে কিছু বলেনি ইসি। এ বিষয়ে বিশেষ কোনো উদ্যোগ নিতেও তাদের নিতে দেখা যায়নি। ভোটের আগে মাঠপ্রশাসনের রদবদলও আনবে না তারা। গত বুধবার (২২ নভেম্বর) নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, হাজার হাজার কর্মকর্তাকে বদলি করা হলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। আর গত বৃহস্পতিবার (২৩ নভেম্বর) ঝিনাইদহে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে নির্বাচন কমিশনার মো. আহসান হাবিব খান বলেন, মাঠপর্যায়ে প্রশাসনের ক্ষেত্রে কোনো অভিযোগ এলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। হুট করেই মাঠ প্রশাসনে আপাতত রদবদল হবে না। কারণ, জেলার সব পথ, কেন্দ্র, জায়গা, পরিবেশ—সবকিছুই প্রশাসনের জানা রয়েছে।

পরিকল্পনায় থাকলেও বাস্তবায়ন কম

জাল ভোট ও কারচুপি ঠেকাতে প্রতিটি ভোটকক্ষে সিসি (ক্লোজড সার্কিট) ক্যামেরা স্থাপন করার কথা নিজেদের কর্মপরিকল্পনায় বলেছিল ইসি। কিন্তু তারা শেষ পর্যন্ত এই পরিকল্পনা থেকেও পিছু হটেছে। তারা মনে করছে, এটি বাস্তবায়নযোগ্য নয়। সারা দেশের ৩০০ সংসদীয় আসন একসঙ্গে সিসিটিভিতে পর্যবেক্ষণ করার মতো সক্ষমতা তাদের নেই।

তফসিল ঘোষণার পরদিন থেকে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর স্ট্রাইকিং ফোর্স নিয়োগের কথা বলেছিল ইসি। এখন পর্যন্ত এটি হয়নি। তবে আচরণবিধি প্রতিপালন নিশ্চিত করতে ২৮ নভেম্বর থেকে সারা দেশে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করার নির্দেশনা দিয়েছে ইসি।

এ ছাড়া সব রাজনৈতিক দল যাতে নির্বাচনী প্রচার নির্বিঘ্নে চালাতে পারে, সে বিষয়ে সরকারের কাছে প্রস্তাব রাখার কথা বলেছিল ইসি। এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। নির্বাচনের আগে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার ও বৈধ অস্ত্র জামা নেওয়ার কথা বলেছিল ইসি। সে বিষয়েও এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেই।

ইসি যে গতানুগতিকভাবে চলছে, তাতে সুষ্ঠু নির্বাচনের বার্তা দেওয়া কঠিন বলে মনে করেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন নিজেরাই অনেকগুলো চ্যালেঞ্জের কথা বলেছিল। কিন্তু এসব মোকাবিলায় কিছুই করেনি। তফসিল ঘোষণার এক সপ্তাহ পরও ইসির কর্তৃত্ব দেখা যায়নি।

সাবেক এই নির্বাচন কমিশনার বলেন, রাস্তা বন্ধ করে মিছিল-সমাবেশ করে কোনো কোনো দল মনোনয়ন ফরম বিক্রি করছে। অন্যদিকে বিরোধী নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার, হয়রানি চলছে। এসব নিয়ে ইসির কোনো খবর নেই।

প্রথম আলো