নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টিতে (জাপা) সৃষ্ট অস্থিরতা ভরাডুবির পরও অব্যাহত রয়েছে। দ্বাদশ সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসন নিয়ে দলটিতে টানাপোড়েন প্রকটের শঙ্কা রয়েছে। জাপা প্রধান বিরোধী দল হবে কিনা, তাও স্পষ্ট নয়।
স্ত্রী শেরিফা কাদেরের জন্য আওয়ামী লীগের কাছ থেকে আসন ছাড় পাওয়ার পরই জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন– এমন অভিযোগ তুলে নেতৃত্বের সমালোচনা করে পদ হারিয়েছেন দলটির একাধিক জ্যেষ্ঠ নেতা। নির্বাচনে অংশ নিয়ে সরকারের কাছ থেকে টাকা পাওয়া, ভোটে নামিয়ে প্রার্থীদের খবর না নেওয়াসহ কিছু অভিযোগ রয়েছে জি এম কাদেরবিরোধী হিসেবে আবির্ভূত নেতাদের। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে জামানত হারানো শেরিফা কাদের সংরক্ষিত আসনে দ্বাদশ সংসদে যাবেন– এ খবরে বিরোধিতা নতুন মাত্রা পেয়েছে।
জি এম কাদের সমকালকে বলেছেন, শেরিফার জন্য আসন নিশ্চিত হওয়ার পর নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অভিযোগ সঠিক নয়। আওয়ামী লীগ তাঁকে ঢাকা-১৮ আসন দিলেও জাপার লালমনিরহাট-৩ আসনে ছাড় দেয়নি। শেরিফা আমার স্ত্রীর হওয়ায় সংরক্ষিত মহিলা আসনে অযোগ্য হতে পারেন না। কারা মনোনয়ন পাবেন, তা নিয়ে আলোচনা হয়নি। মনোনয়ন বোর্ড প্রার্থী ঠিক করবে।
১১ আসন পাওয়া জাপা দ্বাদশ সংসদে ভাগে মাত্র দুটি সংরক্ষিত মহিলা আসন পাবে। নবম সংসদে চার, দশম সংসদে ছয় এবং একাদশ সংসদে চারটি মহিলা আসন ভাগে পেয়েছিল দলটি। দলের কো-চেয়ারম্যান সালমা ইসলাম ঢাকা-১ আসনে নির্বাচন করে পরাজিত হয়েছেন। নবম ও একাদশ সংসদে তিনি সংরক্ষিত আসনের এমপি ছিলেন। এবারও সংরক্ষিত আসনে এমপি হতে চান সালমা ইসলাম। পরিস্থিতির বড় ধরনের পরিবর্তন না হলে তিনি এবং শেরিফা কাদের এমপি হবেন বলে জানিয়েছে জাপা সূত্র। সালমা ইসলামকে নিয়ে বিরোধ না থাকলেও চেয়ারম্যানের স্ত্রীর বিষয়ে আপত্তি রয়েছে অনেক নেতার।
মহিলা এমপি নির্বাচন নিয়ে অতীতেও জাপায় বিতর্ক হয়েছে। একাদশ সংসদের মহিলা এমপি মাসুদা রশিদ চৌধুরী প্রকাশ্যে জানিয়েছিলেন, ৫ কোটি টাকা দিয়ে তিনি জাপার মনোনয়নে সংসদে যেতে পারেন। এ টাকা নিয়ে পরবর্তী সময়ে জাপায় দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। জি এম কাদের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে নেওয়ার পর মাসুদা রশিদ চৌধুরীর মৃত্যুতে শূন্য আসনে শেরিফা কাদের এমপি হয়েছিলেন। চেয়ারম্যানের স্ত্রী হওয়ার সুবাদেই তিনি সংসদে যেতে সফল হন বলে অভিযোগ রয়েছে জাপায়।
বরিশাল-৬ আসনে গত দু’বার জয়ী হন জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য নাসরিন জাহান রত্না। তিনি দলের কো-চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারের স্ত্রী। ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে বরিশাল-৬ আসনে পরাজিত হয়েছেন নাসরিন জাহান। জাপা সূত্রের খবর, স্ত্রীকে নবম সংসদের মতো সংরক্ষিত মহিলা আসনে এমপি নির্বাচিত করতে চেষ্টা করছেন রুহুল আমিন হাওলাদার।
একাদশ সংসদের মহিলা এমপি রওশন আরা মান্নান এবং নাজমা আকতার ফের এমপি হতে চেষ্টা করছেন। ঢাকা-৪ আসনের দু’বারের এমপি সৈয়দ আবু হোসেন বাবলার আসন এবার ছাড়েনি আওয়ামী লীগ। জিততে পারেননি তিনি। বাবলা তাঁর স্ত্রী সালমা হোসেনকে মহিলা আসনে এমপি বানাতে চেষ্টা করছেন। আরও কয়েকজন একই চেষ্টা চালাচ্ছেন। দলীয় তহবিলে একজন অনুদান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বলে জাপা সূত্র জানিয়েছে।
জাপা চেয়ারম্যানের সঙ্গে ক্ষমতার লড়াইয়ে টিকতে না পারে ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ নেননি বিদায়ী সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ। তিনি জাপার কোটায় মহিলা এমপি হতে পারেন– এমন গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে। তবে সূত্রের খবর, দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষককে সংসদে নিতে রাজি নন জি এম কাদের। তবে প্রধানমন্ত্রী চাইলে রওশনের এমপি হওয়া আটকাবে না বলে জানিয়েছে জাপা সূত্র।
নির্বাচনের পর জি এম কাদেরের সমালোচনায় মুখর জাপা নেতারা যোগাযোগ করছেন দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের সঙ্গে। ভোটের আগে জাপার মূল নেতাদের সবাই জি এম কাদেরকে সমর্থন করলেও নির্বাচনে ভরাডুবিতে পরিস্থিতি বদল হয়েছে। জাপা সূত্রের খবর, জি এম কাদেরের পাল্টা হিসেবে রওশনকে সক্রিয় করার চেষ্টা চলছে। তবে এসব নেতা মাসখানেক আগেও জি এম কাদেরের পক্ষে থাকায়, রওশন এরশাদ তাদের এখনও আস্থায় নেননি। রওশন এরশাদের রাজনৈতিক সচিব গোলাম মসিহ সমকালকে বলেছেন, অনেকেই যোগাযোগ করছেন। তবে রওশন এরশাদ কোনো সিদ্ধান্ত নেননি।
নির্বাচনের আগে লাঙ্গলের অনেক প্রার্থী যেভাবে ঘোষণা দিয়ে সরে গিয়েছিলেন, ভোটের পর একই কায়দায় দল ছাড়ছেন জি এম কাদেরের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে। গত বৃহস্পতিবার কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা সংবাদ সম্মেলন করে জানান, কেন্দ্রীয় থেকে মহানগর, থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ের প্রায় ৭০০ পদধারী পদত্যাগ করেছেন। তবে তাদের নামের তালিকা দেওয়া হয়নি। জাপা বলছে, পদত্যাগকারীর সংখ্যা বিশ্বাসযোগ্য নয়। জি এম কাদের পদত্যাগকারীদের সম্পর্কে মন্তব্য করতে রাজি হননি।
জাপার প্রেসিডিয়াম সদস্য পদ হারানো শফিকুল ইসলাম সেন্টু সংবাদ সম্মেলন আয়োজকদের অন্যতম। তাঁর দাবি, পদত্যাগকারীর সংখ্যা আরও অনেক বেশি। পদত্যাগের ধারা অব্যাহত থাকবে। জি এম কাদেরের পাশে কেউ থাকবে না। তিনি জাপাকে রাজনৈতিক দল থেকে মুদি দোকানে পরিণত করেছেন। এর ব্যাখ্যায় শফিকুল ইসলাম বলেছেন, নির্বাচনের আগে জি এম কাদের স্ত্রীর জন্য আসন নিশ্চিত করা ছাড়া কিছুই করেননি। এ জন্য স্ত্রীকে প্রেসিডিয়াম সদস্য বানিয়েছেন। আওয়ামী লীগ আসন ছেড়ে দিলেও শেরিফা কাদেরের জামানত বাঁচেনি। তিনি কী এমন নেতা যে, জামানত হারানোর পরও এমপি বানাতে হবে?
সমকাল