সরকার পতনের এক দফা দাবি আদায়ে আগামী ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগের সাত দিনকে ‘টার্গেট’ করছে বিএনপি। আন্দোলনে সফলতা আনতে ‘সব পদ্ধতি ও কৌশল’ প্রয়োগ করবে দলটি। জনগণের সম্পৃক্ততা বাড়াতে গণসংযোগ কিংবা জনইস্যুতে কর্মসূচি যেমন থাকবে, তেমনি রাজপথেও একের পর এক কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে। হরতাল-অবরোধের বাইরে আর কোন ধরনের কর্মসূচি দেওয়া যেতে পারে, সেসব নিয়েও আলোচনা চলছে দলটিতে। সেখানে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ঘেরাও, নির্বাচনের আগের দিন থেকে ‘গণকারফিউ’ দেওয়ার সিদ্ধান্ত রয়েছে। এর বাইরেও আলোচনায় রয়েছে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কর্মসূচি। এখনই সেসব বিষয়ে কেউ মুখ খুলতে রাজি না হলেও নেতারা বলছেন, নির্বাচনের আগের সাত দিনে তারা ‘অলআউট’ আন্দোলনে যাচ্ছেন। এর আগে মাঠ প্রস্তুত করতে সব আয়োজন শেষ করছেন তারা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান সমকালকে বলেন, সরকার যতই ধরপাকড় করুক না কেন, সরকারের পতনের দাবিতে এবং দেশের গণতন্ত্র আর ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনতে চলমান আন্দোলন আরও জোরদার করা হবে। জনগণকে সঙ্গে নিয়ে তারা মাঠে আছেন। তাদের সঙ্গে নিয়েই তারা আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে যাবেন। সেখানে তাদের বিজয় সুনিশ্চিত। সময় ও পরিস্থিতি অনুযায়ী আন্দোলনের নতুন কর্মসূচি দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
অবশ্য বিগত ১৫ বছর আন্দোলন করে যে দাবি তারা আদায় করতে পারেনি, এক বা দুই সপ্তাহের মধ্যে কীভাবে তা করবে, তা স্পষ্ট করেনি বিএনপি। অন্যদিকে, বিএনপির আন্দোলনের হুমকিকে কোনো আমলেই নিচ্ছে না ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। নির্বাচন কমিশনও আগামী ৫ থেকে ৯ জানুয়ারি পর্যন্ত সব ধরনের রাজনৈতিক সভা-সমাবেশের কর্মসূচি নিষিদ্ধ করেছে। এ পরিস্থিতিতে কীভাবে দলটি মাঠের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবে, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ওই সময়ে রাজপথের কর্মসূচি দিতে হলে নিষেধাজ্ঞা ভাঙতে হবে দলটির। কিন্তু গণগ্রেপ্তার ও সাজার পাশাপাশি গ্রেপ্তার এড়াতে প্রায় সব নেতাকর্মী আত্মগোপনে থাকা দলটির সেই সাংগঠনিক শক্তি আছে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন রেখেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
তবে রাজপথের প্রধান বিরোধী দলটির বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা সমকালকে জানান, বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মী হারানোর কিছু নেই। মামলা-হামলা জর্জরিত প্রত্যেক নেতাকর্মী নিজেদের প্রয়োজনেই ‘মুক্তির মিছিলে’ অংশ নিচ্ছেন। সেখানে সক্রিয় ও ত্যাগী নেতাকর্মীর একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তবে সেটা বিএনপির সাংগঠনিক শক্তির একটি ছোট অংশ। এখন সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা। সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ২৮ ডিসেম্বরের পর থেকে লাগাতার কঠোর কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকবেন। সেই আন্দোলনে যার যেখানে যেটুকু সক্ষমতা আছে, তার পুরোটাই প্রয়োগের সিদ্ধান্ত রয়েছে তাদের। এর পাশাপাশি কূটনৈতিক তৎপরতা সর্বোচ্চ পর্যায়ে বাড়ানো হয়েছে। যাতে আন্তর্জাতিকভাবে এই আন্দোলনের গ্রহণযোগ্যতা পায় এবং সমর্থন করেন।
তারা বলছেন, আন্দোলনের মোক্ষম সময় নির্বাচনের আগের সাত দিন। এ সময়ে নির্বাচনী প্রচারণায় নৌকা, স্বতন্ত্র আর তাদের জোট প্রার্থীদের মধ্যে সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নির্বাচন ঘিরেই বেশি তৎপর থাকবে। সেখানে বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীরা জোটবদ্ধ রাজপথে নামলে তা সামলানো সহজ বিষয় হবে না। অন্যদিকে, এ সময়ের মধ্যে গণতান্ত্রিক বিশ্ব এই ‘একতরফা’ নির্বাচনের বিরুদ্ধে আরও সোচ্চার হয়ে উঠতে পারে। একদিকে অভ্যন্তরীণ গোলযোগ, অন্যদিকে বহির্বিশ্বের চাপ– এ দুই মিলে সরকার অনেকটা কোণঠাসা হতে পারে। আবার জনগণও দ্রব্যমূল্য ইস্যুতে, তাদের ন্যায্য দাবিতে, ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে ফুঁসে উঠবে এ সময়ে। তাই সবকিছু মোকাবিলা করে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো ‘ভুয়া’ নির্বাচন করে সরকার সহজে পার পাবে না বলে তাদের বিশ্বাস।
বিএনপির দাবি, গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় মহাসমাবেশ পণ্ড করে দেওয়ার পর থেকে সারাদেশে প্রায় ২৪ হাজার নেতাকর্মী গ্রেপ্তার হয়েছেন। প্রায় আট হাজার নেতাকর্মীকে আহত করা হয়েছে। একইভাবে জামায়াতেরও সাড়ে তিন হাজার নেতাকর্মীকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে ওই সময়ের মধ্যে।
বিএনপি নেতারা জানান, ২৮ অক্টোবরের ঘটনার জন্য তারা প্রস্তুত ছিলেন না। ওই ঘটনার পর সারাদেশে নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি অভিযানে তাদের অনেক নেতাকর্মী ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন। সবাই আত্মগোপনে চলে যান। সেখান থেকে আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর সব প্রচেষ্টা শেষ করা হয়েছে। দলের সর্বোচ্চ নেতা সারাদেশে তৃণমূল নেতাকর্মীর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করে তাদেরে চাঙ্গা করেছেন। নেতাকর্মীর মধ্যে সমন্বয়হীনতা দূর করতে দিয়েছেন দিকনির্দেশনা। নেওয়া হয়েছে পদক্ষেপ। গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে তাদের উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে মাঠে নামতে কঠোর নির্দেশ দিয়েছেন। তৃণমূলের সঙ্গে কেন্দ্রের সংযোগ স্থাপন করে আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়ার বিভিন্ন কৌশলও নেওয়া হয়েছে এ সময়।
একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গ্রেপ্তার অভিযানে যেসব সাংগঠনিক ইউনিট কমিটির শীর্ষ নেতা কারাগারে গেছেন, তাদের স্থানে তাৎক্ষণিক নতুন নেতৃত্ব দেওয়া হয়েছে। অনেক স্থানে নেতাদের গাফিলতি স্পষ্ট হওয়ায়, সেখানে নতুন সমন্বয়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আন্দোলনকে টেনে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে সব ধরনের প্রস্তুতিই শেষ করেছেন দলটির হাইকমান্ড।
দলের বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতা জানান, আগামী ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলমান আন্দোলন অব্যাহত থাকবে। ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলনে জনগণের সমর্থন আদায়ে এবং তাদের ভোটদানে বিরত রাখতে গণসংযোগের মতো কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। পাশাপাশি অবরোধ কর্মসূচিও চলবে। তবে ২৯ ও ৩০ ডিসেম্বর শুক্র ও শনিবারের পর থেকে ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের দিন পর্যন্ত তারা টানা কর্মসূচিতে প্রবেশ করবেন। সেই কর্মসূচিকে সফল করতে ‘মরণপণ’ চেষ্টা করবেন তারা। প্রয়োগ করা হবে আন্দোলনের সব কৌশলই। আন্দোলনের শেষ মুহূর্তে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ঘেরাও, নির্বাচনের আগের দিন থেকে ‘গণকারফিউ’ কিংবা আরও কঠোর কর্মসূচি নিয়ে তারা মাঠে নামবেন। একযোগে অসহযোগ ও গণকারফিউ মোকাবিলা করে সরকারের পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব হবে না বলে মনে করেন তারা।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, সরকার জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তারা ভোটাধিকার হরণ করে দেশে একটি একতরফা নির্বাচন করতে যাচ্ছে রাষ্ট্র শক্তিকে ব্যহার করে। বিরোধী দলের নেতাকর্মীর ওপর ক্র্যাকডাউন চালিয়ে গ্রেপ্তার, মামলা, গুম, খুন করে দেশে একটি আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করেছে তারা। উদ্দেশ্য ‘আমরা ও মামুরা’ মিলে একা একা একটা নির্বাচন নির্বাচন খেলা করব। নির্বাচনের নাটকের সঙ্গে জড়িত মীরজাফরদের করুণ পরিণতি ঘটবে। সেদিন আর বেশি দূরে নয়। তারা যতই চেষ্টা করুক– জনগণ এই ডামি নির্বাচন বর্জন করছে, কেউ ৭ জানুয়ারি ভোটকেন্দ্রে যাবে না।
জামায়াতের সঙ্গে ঐক্য শেষ পর্যায়ে, ঘোষণা যে কোনো সময় আন্দোলনের চূড়ান্ত মুহূর্ত শুরু হওয়ার আগে বিএনপি-জামায়াতসহ সব বিরোধী দলকে এক মঞ্চে নিয়ে আসার প্রক্রিয়াও রয়েছে শেষ পর্যায়ে। বেশ কিছু বিষয়ে ঘষামাজার কাজ চলছে। সেটা শেষ হলেই ঘোষণা করা হবে ‘সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ’ কিংবা ‘ফ্যাসিবাদবিরোধী গণতান্ত্রিক মঞ্চ’। সেখানে যেসব দল আসতে গড়িমসি করবে, তাদের যুগপৎ আন্দোলনে রাখার সুযোগও রাখা হবে।
আবার বিএনপি নেতারা এও মনে করছেন, দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে বিভেদ, মতপার্থক্য ভুলে সব দল একসঙ্গে আন্দোলনের মাঠে ঝাঁপিয়ে পড়বে। এই প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করতে এরই মধ্যে সমমনা অন্যান্য দল ও জোটের সঙ্গেও আলোচনা শেষ করেছেন। তাদের প্রস্তাবনা দিয়েছেন। এর আলোকে গতকাল শুক্রবারও গণতন্ত্র মঞ্চের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে মঞ্চের নেতারা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন– আদর্শিকভাবে জামায়াতকে নিয়ে একমঞ্চে ওঠা অসম্ভব হলেও দেশের গণতন্ত্র ও ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনতে সবাইকে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। তারা একমঞ্চে না গেলেও একই দাবিতে ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ইস্যুতে জামায়াতের সঙ্গে আওয়ামী লীগের পৃথক মঞ্চ থেকে যেভাবে আন্দোলন করেছে, সেভাবেও হতে পারে।
মঞ্চের বেশ কয়েকজন নেতা সমকালকে জানান, জামায়াতকে নিয়ে তাদের আগের কট্টর অবস্থান থেকে ছাড় দিতে সম্মত হয়েছেন তারা। আন্দোলনের স্বার্থে বিএনপি-জামায়াতসহ অন্যান্য দল একমঞ্চে উঠলে তাদের কোনো আপত্তি নেই। এ ক্ষেত্রে তারা যুগপৎ আন্দোলনকেই এখন পর্যন্ত প্রাধান্য দিচ্ছেন। তবে চূড়ান্ত মুহূর্তে যে কোনো সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হতে পারে। সেখানে অনেক চমক আসবে বলেও তারা জানান।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি সমকালকে বলেন, তাদের বৈঠকে আন্দোলনের বিভিন্ন দিক নিয়েই আলোচনা হয়েছে। সেখানে আন্দোলন জোরদার করতে নানা প্রস্তাবনা নিয়েও আলোচনা হয়েছে। তবে এখনই সে বিষয়ে মন্তব্য করাটা সমীচীন হবে না বলে তিনি মনে করছেন।
বিএনপি ও জামায়াতের সূত্র জানায়, ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্য গঠনে তাদের সবকিছুই চূড়ান্ত করা হয়েছে। মাঠপর্যায়ে আন্দোলনের ভিত মজবুত ও কার্যকর করতে এরই মধ্যে তারা কাজ শুরু করেছেন। ঢাকা মহানগরকেন্দ্রিক বিভিন্ন থানা-ওয়ার্ড পর্যায়ে দুই দলের নেতারা আন্দোলনের রূপরেখা তৈরি করছেন, তথ্য আদান-প্রদান করছেন। আনুষ্ঠানিকভাবে ঐক্য ঘোষণার পর একসঙ্গে মাঠে নামার প্রস্তুতিও নেওয়া হচ্ছে।
সমকাল