জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এবার উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের ক্ষণ গণনা শুরু হয়েছে। গতকাল ষষ্ঠ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। নির্বাচনে দলীয় প্রতীক থাকছে না। জাতীয় নির্বাচনের পর থেকেই স্থানীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়া শুরু করে আওয়ামী লীগ। এজন্য দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা দলটির বেশ কয়েক শীর্ষ নেতাকে দায়িত্ব দিয়েছেন। এ ধরনের দায়িত্ব পাওয়া একজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মানবজমিনকে বলেন, জাতীয় নির্বাচনের পরই স্থানীয় নির্বাচন স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা চ্যালেঞ্জ। তবে এবার যোগ্য প্রার্থী বাছাই হবে আমাদের জন্য মূল চ্যালেঞ্জ। এর সঙ্গে রয়েছে দলীয় কোন্দল। দুই চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখে আমরা উপজেলা নির্বাচনকে ব্যাপক অংশগ্রহণমূলক ও উৎসবমুখর করার চেষ্টা করবো। সবমিলিয়ে আওয়ামী লীগে তোড়জোড় চলছে দলীয় প্রার্থী বাছাই নিয়ে।
নির্বাচন নিয়ে নিজেদের মধ্যে যেন কোনো ধরনের অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি না হয়, নজর রাখা হচ্ছে সেদিকেও। আওয়ামী লীগের দলীয় সূত্র জানায়, নির্বাচনে ভোটার টানতে নির্বাচনে দলীয় প্রতীক রাখা হচ্ছে না। এতে দলের একাধিক প্রার্থী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন। তবে প্রতি উপজেলায় যোগ্যতর একজনকে কৌশলে দলীয় সমর্থন দেয়া হতে পারে। একাধিক প্রার্থী হওয়ার সুযোগ থাকায় দলীয় কোন্দল বাড়তে পারে এজন্য এ বিষয়টিও মাথায় রাখছে ক্ষমতাসীন দল। দলীয় কোন্দলের চ্যালেঞ্জটি এরইমধ্যে সামনে এনেছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
সম্প্রতি তিনি সাংবাদিকদের জানান, সামনে উপজেলা পরিষদের নির্বাচন। দলীয় মনোনয়ন দেয়া হবে না, দলীয় নেতাদের জনপ্রিয়তা যাচাই হবে। যারা মানুষের জন্য কাজ করেছেন জনগণ তাদের বেছে নেবে। নিজেদের মধ্যে মনোমালিন্য ভুলে যান। একযোগে কাজ করুন। এর আগে একই নির্দেশনা দেয়া হয় দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে। জাতীয় নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগের যৌথসভায় দলীয় সভাপতি নিজেদের মধ্যে দোষারোপ ও অপরাধ খোঁজা বন্ধ করতে দলীয় নেতাকর্মীদের নির্দেশনা দেন। তিনি বলেন, যারা নির্বাচন করেছে, কেউ জয়ী হয়েছে, কেউ পারেনি। তাই আমি সবাইকে অনুরোধ করবো, একজন আরেকজনকে দোষারোপ করা বা কার কী অপরাধ, সেগুলো খুঁজে বেড়ানো বন্ধ করতে হবে। সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। গত ৭ই জানুয়ারি হয়ে যাওয়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারা দেশে নৌকার প্রতিদ্বন্দ্বী স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বেশির ভাগই ছিল আওয়ামী লীগের। নির্বাচনে সারা দেশে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে বিভক্তি ও অভ্যন্তরীণ কোন্দল চরম আকার ধারণ করে। এটি নিরসন করাই এখন দলটির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ সামনেই উপজেলা পরিষদ নির্বাচন।
দলীয় নেতারা জানান, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের আগে এটি নিরসন করতে না পারলে বড় ধরনের খেসারত দিতে হতে পারে দলটিকে। তবে দলটি দাবি করছে, আগামী উপজেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে দলের তৃণমূল পর্যায়ে যে সংকট তৈরি হয়েছে, নির্বাচনের আগেই তা নিরসন করা সম্ভব হবে। ইতিমধ্যে দলের কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যায়ে নেতাকর্মীদের সংকট নিরসনে কাজ করার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে হাইকমান্ড থেকে। এ ছাড়া সারা দেশে ৭৮টি সাংগঠনিক জেলা রয়েছে। এসব সাংগঠনিক জেলার নেতাদের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি দলটির ৮টি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক টিম রয়েছে। সাংগঠনিক সম্পাদকদেরও এ সংকট নিরসনে উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে। প্রয়োজনে নৌকা ও স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং তাদের সমর্থকদের সঙ্গে সশরীরে বসার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এমনকি তৃণমূল পর্যায়ে চিঠি দেয়া হবে, যারা দ্বন্দ্বে জড়াবেন, তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, উপজেলা নির্বাচন ঘিরে তৃণমূল পর্যায়ে কিছুটা দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। ইতিমধ্যে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আমাদের ৮ বিভাগে দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক টিম রয়েছে। তারাও কাজ করছেন। আশা করছি, শিগগিরই এটার সমাধান হয়ে যাবে। উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে এর প্রভাব পড়বে না।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন মানবজমিনকে বলেন, আওয়ামী লীগ যেহেতু দলগতভাবে নির্বাচন করছে না সেহেতু এখানে প্রার্থী বাছাই নিয়ে আওয়ামী লীগ কোনো চ্যালেঞ্জ অনুভব করছে না। জনগণ যাকে নির্বাচন করবে আওয়ামী লীগ তার সঙ্গেই কাজ করবে। এমনকি বিরোধী দলের কোনো প্রার্থী নির্বাচিত হলেও আওয়ামী লীগ স্বাচ্ছন্দ্যে তার সঙ্গে কাজ করবে। যদিও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে দ্বিধা-বিভক্তি দেখা দিয়েছে। তারা জানান, উপজেলা নির্বাচন নিয়েও আওয়ামী লীগের ভেতর এরইমধ্যে একাধিক বিভাজন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যারা আওয়ামী লীগের টিকিটে এমপি হয়েছেন তারা উপজেলা নির্বাচনে তাদের কর্তৃত্ব অব্যাহত রাখার জন্য পছন্দের প্রার্থী দিচ্ছেন। অন্যদিকে যারা আওয়ামী লীগের টিকিটে এমপি হতে পারেননি, স্বতন্ত্রদের কাছে পরাজিত হয়েছেন তারা এখন নিজেদের হারানো অবস্থান পুনরুদ্ধারের জন্য উপজেলা নির্বাচনকে বেছে নিয়েছেন। অন্যদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা আওয়ামী লীগে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী দিচ্ছেন। সবকিছু মিলিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে চেইন অব কমান্ড দুর্বল হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের যে অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন আছে তারাও এখন ক্রমশ বিভক্ত হয়ে পড়ছে। দলীয় এমপিদের পক্ষে, পরাজিত স্বতন্ত্রদের পক্ষে ইত্যাদি নানা ভাগ-উপভাগে আওয়ামী লীগ এখন বিভক্ত। বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে আওয়ামী লীগের নীতি- নির্ধারকদের।
তারা বলছেন, এলাকায় নিজের কর্তৃত্ব ও দখলদারিত্ব ধরে রাখার মানসিকতার কারণে তৃণমূল পর্যায়ে দলের চেইন অব কমান্ড হুমকির মুখে। দলীয় কোনো কর্মসূচি এক এলাকায় একেক নেতা ভিন্নভাবে পালন করছেন। এ ধরনের শত শত অভিযোগ আসছে। অর্থাৎ যে যার মতো দলকে পরিচালনা করছেন। সবমিলিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে আওয়ামী লীগের যে সমস্ত প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এবার মন্ত্রিসভায় জায়গা পাননি, তাদেরকে সংগঠন গোছানোর দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে। দলের অন্তর্কলহ দূর করা, দলের মধ্যে বিভক্তি কোন্দল ঠেকানো এবং দলকে শৃঙ্খলায় আনার জন্য এসব নেতাকে বিশেষ নির্দেশনা দিয়ে মাঠে নামানো হচ্ছে।
manabzamin