অখিলেশ পিল্লালামরি
হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা ইসরাইলকে অনুকরণ করতে চায়। তারা ভারতে হিন্দু ইসরাইল তৈরি করতে চায়। নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় ভারত ও ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়েছে। নরেন্দ্র মোদি ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু—উভয়ই ডানপন্থী, কট্টর জাতীয়তাবাদী। যেকোনো উপায় উভয়ই তাদের কট্টর জাতীয়তাবাদ টিকিয়ে রাখতে সদা তৎপর।
এটা শুধু রাজনৈতিক পর্যায়ে নয়, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক স্তরে। ইসরায়েলিরা বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় ভারতের পক্ষে থাকে। ২০০৯ সালের একটি সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, ৭১ শতাংশ ইসরায়েলি ভারতের পক্ষে সমর্থন দিচ্ছে, যা পৃথিবীর অন্য সব দেশের চেয়ে বেশি। একই ভারতে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন রেকর্ড করা হয়েছে ৫৮ শতাংশ, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে বেশি৷
গাজায় সাম্প্রতিক যুদ্ধের সময় বিপুলসংখ্যক ভারতীয় সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট ইসরায়েলপন্থী বর্ণনাকে প্রশস্ত করছে।
ভারতে ইসরায়েলের এই অসামান্য সমর্থনের পিছনে কী রয়েছে?
স্বাধীনতা-উত্তর ভারত ফিলিস্তিন-পন্থী অবস্থান নিয়েছিল। উত্তর-ঔপনিবেশিক সংহতিতে ভারতের কংগ্রেস পার্টির বিশ্বাসের অংশ হিসেবে। ভারত এমনকি ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের বিভাজন পরিকল্পনার পক্ষেও ভোট দেয়নি। ওই ভোট ইসরায়েল সৃষ্টির পক্ষে ছিল। যদিও ভারত ১৯৫০ সালে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়, ভারতের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক সম্পূর্ণরূপে স্বাভাবিক হয় ১৯৯২ সালে।
এই সিদ্ধান্তগুলি জাতীয় স্বার্থে নয়, বরং আদর্শ থেকে এসেছিল। দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের বর্তমান উত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে এই আদর্শিক অবস্থান কি ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর? তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।
তিনটি কারণ গত তিন দশকে ভারতে ইসরায়েলপন্থী অনুভূতির উত্থানকে ব্যাখ্যা করে। প্রথম, সন্ত্রাসী হামলার ইস্যুতে ইসরায়েলের প্রতি ভারতের সহানুভূতি ও সংহতি। উভয় দেশই ইসলামি সন্ত্রাসে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রায়ই সন্ত্রাসী/শত্রুরা বিদেশি স্পনসর পেয়েছে। ভারতের ক্ষেত্রে শত্রুরা পাকিস্তান থেকে আর ইসরায়েলের ক্ষেত্রে শত্রুরা ইরান থেকে স্পন্সর পেয়েছে।
সেই অনুযায়ী, একই কারণে, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান ও জাতীয় নিরাপত্তার উপর জোর দিয়েছে উভয় দেশ।
প্রকৃতপক্ষে, সমসাময়িক ভারত-ইসরায়েল সম্পর্কের একটি মাইলফলক ছিল ১৯৯৯ সালে কার্গিল যুদ্ধের সময় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত ভারতীয় বাহিনীকে ইসরায়েলের অস্ত্র সরবরাহ। এই নিরাপত্তা দৃষ্টিভঙ্গি ভারতে ইসরায়েলপন্থী অনুভূতি উতথানের পেছনে কাজ করেছে।
দ্বিতীয় কারণটি হল বাণিজ্য সম্পর্ক, যা ভারতের অনেক মানুষকে সম্পৃক্ত করেছে, যা সম্পর্কের পথ মসৃণ করেছে। স্নায়ুযুদ্ধ-পরবর্তীকালে ভারত ও ইসরায়েল আরও স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।
তাছাড়া বেশ কিছু অর্থনৈতিক ও সামরিক কারণ ভারত ও ইসরায়েলকে কাছাকাছি টেনেছে। দুই দেশ এখন শক্তিশালী বাণিজ্যে জড়িত। ভারতের প্রতিরক্ষা শিল্প ইসরায়েলের সাথে শক্তিশালী সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। ভারত ইসরায়েলি অস্ত্রের বৃহত্তম ক্রেতা, যা তার জাতীয় নিরাপত্তার জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৪ সাল থেকে ইসরায়েলের অস্ত্র রপ্তানির প্রায় অর্ধেক ৪২.১ শতাংশ ভারতে গিয়েছিল।
আই২ইউ২ গ্রুপের দেশ ইসরায়েল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। ২০২২ সালে ভারত তাদের সঙ্গে দেয়, যাদের লক্ষ্য ইসরায়েল, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মাধ্যমে ভারত ও ইউরোপকে সংযুক্ত করার একটি পরিবহন করিডোর নির্মাণ।
তবে এগুলোর বাইরে আরও অনেক কারণ রয়েছে। জাপান থেকে ফ্রান্স পর্যন্ত বিভিন্ন দেশের সাথে শক্তিশালী সামরিক, বাণিজ্য, রাজনৈতিক ও সামাজিক সম্পর্ক জোরদার করতে চায় ভারত। এই অক্ষরেখায় অবস্থিত শক্তিশালী ইসরায়েলকে ভারত কেন পাশ কাটিয়ে যাবে? ইসরায়েলের প্রতি ভারতের ভালোবাসার পিছনে আরও গুরুত্বপূর্ণ যে-কারণটি রয়েছে তা হল আদর্শগত এবং রাজনৈতিক মডেল হিসাবে ইসরায়েলের প্রতি হিন্দুদের বিশেষ সখ্য। ধর্ম বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয় যেখানে হিন্দু জাতীয়তাবাদের উত্থানের পেছনে রয়েছে মুসলমানি প্রতিক্রিয়া।
অতীতে অনেক ভারতীয় জাতীয়তাবাদী, সেকুলার বা হিন্দু যা-ই হোক না কেন, সাম্রাজ্যবাদী জাপানের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। কারণ জাপান ছিল সুপরিচালিত, প্রযুক্তিগতভাবে দক্ষ, এথনোস্টেটের মডেল। বিশ শতকের গোড়ার দিকে ভারত-চীন-থাইল্যান্ড-ইন্দোনেশিয়া অঞ্চলে এশিয়ান জাতীয়তাবাদীদের জন্য সাম্রাজ্যবাদী জাপান ছিল মডেল। সর্বোপরি, জাপান ছিল প্রথম অপশ্চিমা বা এশীয় দেশ যারা উনিশ শতকের ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সফলভাবে শিল্পায়ন ও নিজেদের ধরে রেখেছিল। জাপানের সেই জাতীয়তাবাদের উদ্দেশ্য ছিল নিজের সংস্কৃতি ও সামরিক শক্তি আরও শক্তিশালী করা।
সমসাময়িক ভারতে, ইসরায়েল এমন ভূমিকা পালন করে যে, প্রায়ই বলা হয়, তারা ভারতে একটি হিন্দু ইসরায়েল তৈরি করতে চায়। মানে, সারা বিশ্বের জাতীয়তাবাদীরা তাদের দেশের জন্য যা কল্পনা করেন, একটি সুশৃঙ্খল রাষ্ট্র যা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দাঁড়ায়—আধুনিক, প্রযুক্তিগতভাবে উন্নত, আইনগতভাবে উন্নত, একই সাথে ঐতিহ্যগতভাবে প্রভাবশালী ও সংস্কৃতিতে সমৃদ্ধ। এমন একটি দেশ গড়ে তোলার জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চান ইসরায়েলের সহযোগিতা। কারণ আর কেউ ভারতকে সেই সহযোগিতা দেবে না। কারণ, দেওয়ার সামর্থ্য যাদের আছে তারা সবাই ভারতের প্রতিদ্বন্দ্বী। অথবা, অন্য অনেক কারণে সবাই ভারতকে সেই সহযোগিতা দেবে না। ইসরায়েল দিতে চায়, কারণ ভারতের বিরাট ভূখণ্ড, বিরাট তার জনসমষ্টি, বিশাল তার অর্থনীতির বাজার। এমন একটি বন্ধু কে না চায়।
বিশ্লেষকরা এই দুই দেশের মধ্যে একটি আদর্শিক বা ঐতিহ্যগত মিল দেখতে পান। উভয় দেশই এমন একটি ধর্মীয়/নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর প্রাথমিক আবাস, যা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। উভয় দেশই প্রতিবেশী শত্রু দ্বারা পরিবেষ্টিত, যে-শত্রুরা তাদের সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করতে চায়। উভয় দেশই রাজনৈতিক ক্ষমতা অর্জনের জন্য হাজার বছর সংগ্রাম করেছে। অবশেষে ১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা আসে। আর ১৯৪৮ সালে ইস্রায়েল সৃষ্টি হয়। (দ্য ডিপ্লোম্যাট ডটকম থেকে)
Bangla Outlook