ভারত ও ইসরাইল : বর্জনের নীতিতে গড়ে ওঠা জোট

গোলাম এম সোহরাওয়ার্দী
প্রকাশ : ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১০: ১৮

গোলাম সোহরাওয়ার্দি

ভারত আর ইসরাইলের ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে। এই সম্পর্কটা বাণিজ্য কিংবা প্রতিরক্ষা চুক্তির মধ্যে সীমিত নেই। এটি আরো গভীর আর উদ্বেগের। দুটো ধারণা এখানে একসঙ্গে মিলিত হচ্ছে। একটি হলো ভারতের হিন্দুত্ববাদ, অন্যটা ইসরাইলের জায়নবাদ। সমালোচকরা বলেন, এই দুই ধারণায় অন্যদের দূরে ঠেলে দেয়। তারা মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতা উসকে দেয়। যারা শক্তিধর নেতাদের ক্ষমতার সামনে নিয়ে আসে। এরা নিয়মনীতির তোয়াক্কা করে না। তারা মানবাধিকার ভূলুণ্ঠিত করে। কিন্তু সে জন্য কোনো সাজার মুখোমুখি হয় না।

দুই দেশের সম্পর্কে একটি সুস্পষ্ট প্যাটার্ন আছে। দুই দেশই কাজের কিছু অভিন্ন কৌশল অনুসরণ করে। একে অন্যকে সহায়তা করে। তাদের ধারণাগুলো পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই কৌশলগুলো দিয়ে তারা লাখ লাখ মানুষের ক্ষতি করছে। দুই দেশেই মুসলিমরা সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত হচ্ছে। ন্যায্যতা আর দোষারোপের যে বৈশ্বিক নিয়মকানুন রয়েছে, সেগুলোও তারা লঙ্ঘন করছে।

হিন্দুত্ববাদ আর জায়নবাদের ঐতিহাসিক সম্মিলন

হিন্দুত্ববাদ আর জায়নবাদের বন্ধুত্বের শুরু হয়েছে অনেক আগে। ১৯০০ দশকের শুরুতে ফিলিস্তিন ইস্যুতে জায়নবাদীদের পরিকল্পনা খুবই পছন্দ করেছিলেন হিন্দু নেতারা। বিনায়ক দামোদর সাভারকার হিন্দুত্ব শুরু করেছিলেন। তিনি জায়নবাদের প্রশংসা করেছেন। হিন্দুত্বের অহংকার রক্ষায় এটিকে তিনি দিকনির্দেশনা হিসেবে দেখেছেন। জায়নবাদীরা ফিলিস্তিনকে ইহুদি ভূখণ্ড হিসেবে দেখে। হিন্দুত্ববাদীরাও দক্ষিণ এশিয়াকে হিন্দুদের পবিত্রভূমি হিসেবে দেখে।

এই অভিন্নতা কোনো ভুল থেকে হয়নি। দুটো মতবাদই কঠিন শাসন প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে প্রসার লাভ করেছে। ফ্যাসিবাদ আর নাৎসিবাদ তখন বড় বিষয় ছিল। এমনিতে এটিকে অস্বাভাবিক মনে হবে। হিটলারের জার্মানিতে বহু ইহুদিকে হত্যা করা হয়েছিল। তারা বিভিন্ন জাতির মানুষকে আলাদা শ্রেণিতে ভাগ করেছিল। হিন্দুত্ববাদীরা তাদের এসব কঠোর নীতিকে বরং পছন্দ করেছিল। এমনকি এখনো হিটলারের লেখা ‘মেইন ক্যাম্ফ’ ভারতে ভালো বিক্রি হয়। কঠোর নেতাদের ব্যাপারে জানার জন্য সেখানকার মানুষ এই বই কেনে।

সমালোচকরা দুটো মতবাদের মধ্যেই অভিন্ন ভিত্তি দেখতে পান। তারা দেশকে একটি গ্রুপ ও তাদের বিশ্বাস দিয়ে সংজ্ঞায়িত করে। সংখ্যালঘুদের তারা বিপদ হিসেবে দেখায়। মুসলিমদের তারা দেশের জন্য প্রধান হুমকি হিসেবে তুলে ধরে।

Modi

কৌশলগত ও সামরিক সম্পর্ক

৩০ বছর ধরে ভারত আর ইসরাইল শক্ত সামরিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। ইসরাইল থেকে সবচেয়ে বেশি অস্ত্র কেনে ভারত। গত ১০ বছরে তারা অস্ত্রের পেছনে প্রায় ২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। এসব অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে ড্রোন, মিসাইল এবং গোয়েন্দা সরঞ্জাম। ইসরাইল বলেছে, এসব অস্ত্র সরঞ্জাম সত্যিকারের যুদ্ধে পরীক্ষিত। এর অর্থ হলো গাজা আর পশ্চিমতীরে ফিলিস্তিনিদের বিপক্ষে তারা এসব ব্যবহার করেছে।

কাশ্মীরে এসব সরঞ্জাম দিয়ে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। এ অঞ্চল বহু বছর ধরে ভারতের অধীনে রয়েছে। ভারত নিজেও এখন অস্ত্র বানাচ্ছে। এতে ইসরাইলের কারখানা স্থাপন আর বিক্রির পরিসর আরো বেড়েছে। হিসাবটা হলো দেওয়া আর নেওয়ার। ক্ষতিটা শুধু পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নয়। এটাই বলতে গেলে এখানকার মূল পণ্য।

প্রতীকী লক্ষণগুলোও অতি গুরুত্বপূর্ণ। ফিলিস্তিনিদের ওপর ব্যবহৃত অস্ত্রগুলো কাশ্মীরিদের ওপর ব্যবহার করা হচ্ছে। ভারতের কারখানাগুলো ইসরাইলকে যুদ্ধে শক্তিশালী থাকতে সাহায্য করছে। উভয়েই একে অন্যের থেকে শিখছে। একজন আরেকজনের তৎপরতাকে যেন তারা সঠিক প্রমাণ করে যাচ্ছে।

২০২৫ সালের বিনিয়োগ সুরক্ষা চুক্তি

২০২৫ সালের ৮ জুলাই বিনিয়োগ সুরক্ষার জন্য ভারত আর ইসরাইল একটি চুক্তি করে। মনে হবে, ব্যবসা সম্প্রসারণের জন্য এটা করা হয়েছে। কিন্তু সমালোচকরা বলছেন, এর উদ্দেশ্য আসলে অভিযোগ আড়াল করা। এটা শুধু অর্থ উপার্জনের বিষয় নয়।

গাজায় হামলার কারণে পুরো বিশ্বের ক্ষোভ গিয়ে পড়েছে ইসরাইলের ওপর। তারা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বন্ধু হারাচ্ছে। এই চুক্তির মাধ্যমে দুই পক্ষ বাণিজ্যিক সম্পর্ক সুদৃঢ় করছে। এছাড়া যদি নিষেধাজ্ঞা আসেও, তবু এই চুক্তি অর্থের সুরক্ষা দিতে পারবে।

মানবাধিকার বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এই চুক্তি তাদের নিয়ম ভাঙার সুযোগ করে দিয়েছে। দুই দেশই ভূমি দখল আর মানুষের সঙ্গে অন্যায় আচরণ করে যাচ্ছে। এটিকে তারা বলছে ব্যবসা। এটি প্রবৃদ্ধিতে কোনো সাহায্য করবে না। আন্তর্জাতিক আইনের বিরুদ্ধে যেসব খারাপ কাজ হচ্ছে, সেটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে এটা।

ভারতে ঘৃণাকেন্দ্রিক অপরাধ বাড়ছে

দুই দেশের ঘনিষ্ঠতার নানা ধরনের প্রভাব রয়েছে। ভারতের ক্ষুদ্র গোষ্ঠীগুলো সহিংসতার শিকার হচ্ছে। ২০২৪ থেকে ২০২৫-এর জুনের মধ্যে ঘৃণার প্রসারের বিষয়টি খতিয়ে দেখেছে কয়েকটি গ্রুপ। অ্যাসোসিয়েশন ফর প্রটেকশন অব সিভিল রাইটস অ্যান্ড কুইল ফাউন্ডেশন এ ধরনের ৯৪৭টি ঘটনা খুঁজে পেয়েছে। এগুলো ঘৃণামূলক অপরাধ আর কথাবার্তা। এর মধ্যে ৬০২টি হলো অপরাধ। এর মধ্যে ১৭৩টি হামলার ঘটনায় শিকার ব্যক্তি আহত হয়েছে। ২৫টি ঘটনায় মুসলিম ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। ৩৪৫টি ঘটনায় ঘৃণামূলক কথা ছড়ানো হয়েছে। এগুলো অপরাধের অর্ধেকই করেছে বিজেপির লোকজন আর তাদের বন্ধুরা।

ইন্ডিয়া হেইট ল্যাব দেখতে পেয়েছে, ২০২৪ সালে ভারতে ঘৃণামূলক কথা ৭৪ শতাংশ বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি এর শিকার হয়েছেন মুসলিমরা। খ্রিষ্টানরাও মবের শিকার হয়েছেন। দেড় হাজারের বেশি মানুষ এসব ঘটনায় আহত হয়েছে। অধিকাংশ ঘটনা ঘটেছে বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলোয়। যেসব গোষ্ঠী হামলা করেছে, তাদের সঙ্গে ক্ষমতাসীনদের যোগসূত্রও দেখা গেছে।

কাশ্মীরে গাজার প্রতিধ্বনি

গাজা আর কাশ্মীরকে একই ধরনের দেখা যাচ্ছে। দুই জায়গাতেই প্রচুর সেনা মোতায়েন রয়েছে। সেখানকার মানুষের ওপর নজরদারি করা হচ্ছে। তাদের আটকে রাখা হচ্ছে। তারা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারছে না। আতঙ্ক সৃষ্টির জন্য ঘরবাড়ি আর দোকানপাট ভাঙচুর করা হচ্ছে।

ইসরাইল বলছে, গাজায় ঘরবাড়ি নির্মাণের কোনো অনুমতি নেই। ফিলিস্তিনিদের এ ধরনের অনুমতি কমই দেওয়া হয়। কাশ্মীর আর ভারতেও রাজনৈতিক নেতারা বলছেন, অবৈধভাবে জমির ব্যবহার করা হচ্ছে। তারা মুসলিমদের জায়গাজমিতে বুলডোজার চালিয়ে দিচ্ছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো গ্রুপগুলো এটিকে গোষ্ঠীগত শাস্তি হিসেবে উল্লেখ করেছে।

দুই দেশের ছবির মধ্যেই মিল দেখা যাচ্ছে। ফিলিস্তিনের মতো ভারতের বুলডোজার দিয়ে স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাদের লক্ষ্য একই। প্রতিপক্ষকে লড়াইয়ে নামিয়ে তাদের ভূখণ্ড কেড়ে নেওয়া।

ভারতে মুসলিমদের অভিজ্ঞতা

ভারতে মুসলিমরা আরো মানসিক চাপের মধ্যে আছে। হিন্দুত্ববাদী নেতারা বলছেন, তারা একে অন্যের সমান নয়। ২০২০ সালে বিজেপির সুব্রামানিয়ান স্বামী ভাইস নিউজকে এ কথাটাই বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, মুসলিমরা যদি সংখ্যায় ৩০ শতাংশের বেশি হয়, তাহলে এই ভূখণ্ড ঝুঁকিতে পড়ে যাবে। তিনি বলেন, মুসলিমদের হিন্দুদের একই পর্যায়ের নাগরিক নয়।

লেখিকা রানা আইয়ুব এটিকে দুঃস্বপ্ন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি জানিয়েছেন, তার ওপর সার্বক্ষণিক নজরদারি করা হচ্ছে। তাকে হয়রানি করা হচ্ছে। তাকে হত্যার হুমকি দিয়েও অনেক বার্তা দেওয়া হয়। ব্যাংকগুলো তার অ্যাকাউন্ট আটকে দেয়। তিনি সফর করতে পারেননি। ভিন্নমত পোষণের জায়গাটা সংকুচিত হয়ে গেছে।

আর্থিক বয়কটের কারণে পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। হিন্দুত্ববাদীরা মুসলিমদের দোকানপাটগুলো এড়িয়ে যাওয়ার জন্য প্রচার চালাচ্ছে। তাদের লাভ জিহাদ বা এ ধরনের অপরাধের সঙ্গে অন্যায়ভাবে জড়ানো হচ্ছে। কিছু কিছু রাজ্যে বিক্ষোভ করার অপরাধে ঘরবাড়িতে ভাঙচুর করা হচ্ছে। আদালত এগুলোর নিন্দা করেছে। কিন্তু তারপরও এটি চলছে। মুসলিমরা দেখতে পাচ্ছে কোন আইনই তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়।

অভিন্ন ভাষা আর আদর্শিক মিত্রতা

ভারত ও ইসরাইলের উগ্রবাদীদের কথাবার্তা একই ধরনের। ফিলিস্তিনি আর মুসলিমদের পশু বলা হচ্ছে, সন্ত্রাসী বলা হচ্ছে। এই পরিস্থিতি তাদের ওপর নির্যাতনকে বৈধ করে দিয়েছে। গাজায় বোমা মারা সহজ হয়ে গেছে। ভারতীয় শহরগুলোয় মুসলিম হত্যাও সহজ হয়ে গেছে।

হিন্দুত্ববাদীরা নাৎসি মতবাদ পছন্দ করে। হিন্দুত্ববাদের প্রতিষ্ঠাতারা বলেছেন, নাৎসিরা ইহুদিদের সঙ্গে যে আচরণ করেছে, তোমরা মুসলিমদের সঙ্গে সেই আচরণ করো। এই আতঙ্কজনক বিশ্বাস মোদির উত্থানে সাহায্য করেছে। তিনি ২০০২ সালে দাঙ্গার সময় গুজরাটের শাসক ছিলেন তিনি। এই দাঙ্গার জন্য অনেকেই তাকে দায়ী করে।

এখন গাজার হত্যাকাণ্ডে কট্টর হিন্দুত্ববাদী গ্রুপগুলো উদ্বুদ্ধ হয়েছে। ভারতের ক্ষুদ্র গোষ্ঠীগুলোর বিরুদ্ধেও তারা একই কাজ করতে চায়। এক দেশের অপরাধ আরেক দেশে অপরাধ উসকে দিচ্ছে।

ভারত আর ইসরাইল দাবি করে, তাদের দেশ মুক্তভূমি। কিন্তু ভারতের ২০০ মিলিয়ন মুসলিম আর ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলো আতঙ্কের মধ্যে আছে। বিশ্বকে অবশ্যই এই প্রশ্ন তুলতে হবে—এই অশুভ যোগাযোগকে কি বাড়তে দেওয়া যাবে? না কি সেই মতবাদ আর ধারণাকে থামাতে হবে, যেটি ঘৃণাকে স্বাভাবিক করে তুলেছে আর বিশ্বাসকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের সুযোগ করে দিয়েছে?

ঝুঁকিটা অনেক বড়। এটি দুর্বল জনগোষ্ঠীর জীবনের প্রশ্ন। এটি মুক্ত শাসনব্যবস্থা, বহুমুখী কণ্ঠস্বর এবং অধিকারের প্রশ্ন। যে বিশ্বে অন্যকে নিশ্চিহ্ন করাটাই হলো ক্ষমতার পথ, সেখানে ঝুঁকিটি তাই অনেক বেশি।

লেখক : যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাউথ এশিয়া জার্নালের প্রকাশক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here