বাংলাদেশে যখন ঈদ ও নতুন বছরের ছুটি শেষে সবাই কাজে ফিরতে শুরু করবে, তখন ভারতে জাতীয় ভোটযুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। আসন্ন এই নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা প্রায় ৯৭ কোটি। এর মধ্যে জনসংখ্যার হিসাব অনুযায়ী মুসলমান ভোটার প্রায় ১৪ শতাংশ। অর্থাৎ ১৩ থেকে ১৪ কোটি ভোট আছে মুসলমানদের। প্রশ্ন হলো, এই ভোট কোন দল পাবে? কারা মুসলমানদের পছন্দে আছে? মুসলমানরা কি প্রত্যাশিত মাত্রায় প্রতিনিধি বাছাই করতে পারছেন?
ভোট আছে আসন নেই
ভারতীয় লোকসভায় আসনসংখ্যা ৫৪৫ হলেও ভোট হয় ৫৪৩টি আসনে। জনসংখ্যার হিস্যা অনুযায়ী লোকসভায় মুসলমান সদস্য থাকার কথা ৭৫ থেকে ৭৬ জন। কিন্তু গত নির্বাচনে লোকসভায় মুসলমান সদস্য ছিলেন মাত্র ২৭ জন। আগের নির্বাচনে ছিলেন ২৩ জন।
লোকসভায় জনপ্রতিনিধি হিসেবে মুসলমানদের দুর্বল অবস্থার পেছনে তিন ধরনের কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। প্রথমত, প্রধান প্রধান দল হিন্দু ভোট হারানোর ভয়ে মুসলমানদের প্রার্থী করতে চাইছে না। দ্বিতীয়ত, অনেক জায়গাতেই নির্বাচন–পরবর্তী মারধরের ভয়ে মুসলমানরা এলাকার শক্তিশালী অমুসলিম প্রার্থীকে ভোট দিচ্ছেন। তৃতীয়ত, অপেক্ষাকৃত সংখ্যালঘুবান্ধব মনে করে মুসলমানরা কংগ্রেস, সিপিএম ও তৃণমূলের মতো দলকে ভোট দিতে গিয়ে সেই ভোট ভাগ হয়ে যাচ্ছে। এ রকম ভাগাভাগির কারণে সংখ্যালঘুরা তাঁদের ধর্মের কাউকেই জিতিয়ে আনতে পারছেন না।
এ অবস্থার সবচেয়ে করুণ দৃশ্য দেখা যায় উত্তর প্রদেশে। লোকসভায় এই প্রদেশের প্রতিনিধি সবচেয়ে বেশি, ৮০ জন। প্রায় চার কোটি মুসলমানের বাস এখানে। গত লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি এখানে একজন মুসলমানকেও প্রার্থী করেনি। ভোটে ধর্মীয় মেরুকরণে তারা এত আস্থাশীল ছিল, মুসলমানদের প্রার্থী না করার বিষয় নির্বাচনী প্রচারে তাদের তরফ থেকে একটা বলার ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
এ রকম প্রবণতা ভারতজুড়েই বাড়ছে। যেমন রাজস্থানে মুসলমান ভোটার প্রায় ১০ শতাংশ। এখানকার কিছু আসনে বেশ বড় অঙ্কে মুসলমান ভোট আছে। কিন্তু বিজেপি তো নয়ই, কংগ্রেসও এবার এখানে কোনো মুসলমানকে প্রার্থী করেনি। দুই দলই ২৫টি আসন সংখ্যাগুরুদের দিয়ে পূরণ করেছে। বিজেপি রাজস্থানে কখনোই কোনো মুসলমানকে প্রার্থী করেনি। কংগ্রেস অতীতে সেটা করলেও এখন সেই নীতি থেকে সরেছে।
ভারতীয় ক্রিকেটার আজাহারউদ্দিন ২০১৪ সালে কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে রাজস্থান থেকে নির্বাচন করে হেরে গিয়েছিলেন। ২০২৩ সালে তেলেঙ্গনা থেকে বিধানসভা ভোটে অংশ নিয়েও তিনি হেরে যান। ক্রিকেটের তিনটি বিশ্বকাপে ভারতীয় দলকে নেতৃত্ব দিলেও ভোটের মাঠে তিনি আর এখন গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছেন না। ভারতে অমুসলিমদের ভোট মুসলমান প্রার্থীদের দিকে নেওয়া প্রায় সব দলের জন্য বেশ দুরূহ এখন। সমাজজীবনে হিন্দুত্ববাদী মনস্তত্ত্বের প্রভাব এ অবস্থা তৈরি করেছে।
মুসলমান ভোটের ভাগাভাগি
ভারতজুড়ে মাত্র ১৫টি আসন আছে, যেখানে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। তবে এর বাইরে আরও প্রায় ৩৫টি আসন আছে, যেখানে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ না হলেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় আছে। অন্তত ৩০ শতাংশের বেশি আছে। এ রকম আসনে চাইলে তারা ভোটে সিদ্ধান্তসূচক ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এখন এ রকম আসনগুলোতেও মুসলমান প্রার্থীরা জিতে আসতে পারছেন না বিজেপির রাজনীতির কারণে। এসব আসনে সাম্প্রদায়িক ভঙ্গিতে এমনভাবে প্রচার চলে, যাতে সমস্ত হিন্দু ভোটকে একটা বিশেষ মার্কায় টেনে নেওয়া হয়।
উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া ‘মালদা উত্তরের’ কথা বলা যায়। এখানে মুসলমানরা প্রায় অর্ধেক ভোটার। গত নির্বাচনে তাদের সমর্থন জাতীয় কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেসে বিভক্ত হয়ে গিয়েছিল। এই ফাঁকে বিজেপি প্রার্থী খগেন মুর্মু সব হিন্দু ভোট তাদের মার্কায় জড়ো করে জিতে যান। তিনি ভোট পেয়েছেন প্রদত্ত ভোটের মাত্র ৩৮ শতাংশ—৫ লাখ ৯ হাজার। কংগ্রেস ও তৃণমূলের দুই মুসলমান প্রার্থী ভোট পান ৭ লাখ ৩০ হাজার। ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতায় খগেন মুর্মুর জিততে সমস্যা হয়নি।
আগের দুটি জাতীয় নির্বাচনে (২০০৯, ২০১৪) মুসলমান ভোট একত্র থাকায় এখানে সংসদ সদস্য হন এককালের জাঁদরেল রাজনীতিবিদ গনি খান চৌধুরীর ভাগনি মৌসুম বেনজীর নুর। এবার তৃণমূল এই আসনে একজন হিন্দু প্রার্থী দিয়েছে। অর্থাৎ খগেন মুর্মুর বিজয় এমন বার্তা দিয়েছে যে মালদার এই আসনে বিপুল মুসলমান ভোট থাকার পরও রাজ্যের শাসক দল সেখানে মুসলমান কাউকে প্রার্থী করতে সাহস পায়নি।
বিজেপি প্রার্থী পুরোনো খগেন মুর্মুই আছেন। অর্থাৎ যিনিই জিতবেন, অমুসলিম কেউ এবার এমপি হবেন এই আসনে। অথচ এই আসনে অতীতে গনি খান চৌধুরী আটবার জিতেছিলেন। পশ্চিমবঙ্গজুড়ে এভাবে মুসলমান ভোট কংগ্রেস-সিপিএম-তৃণমূলে বিভক্ত হচ্ছে। কেরালায় সেটা ঘটছে স্থানীয় দল মুসলিম লিগ, সিপিএম ও কংগ্রেসের মধ্যে; উত্তর প্রদেশে সমাজবাদী দল ও কংগ্রেসের ভেতর; আসামে মাওলানা আজমলের দল ও কংগ্রেসের মধ্যে। সব রাজ্যে এ রকম বাঁটোয়ারার ফায়দা পায় পদ্মফুল মার্কা ও তার মিত্ররা।
‘মুসলমানদের দল’গুলোও মুসলমানদের আসন বাড়াতে ব্যর্থ
ভারতে ঐতিহাসিকভাবে মুসলমানদের প্রিয় দল ছিল কংগ্রেস। পরবর্তীকালে কেরালা ও পশ্চিমবঙ্গে সিপিএম তাদের ভোট পেত অনেক। এসব পছন্দে ইতিমধ্যে অনেক ক্ষয় ধরেছে। এর মধ্যে দেশজুড়ে মুসলমানপ্রধান অনেক দলও গড়ে উঠেছে। এই তালিকায় আছে দক্ষিণে মুসলিম লিগ ও ইত্তেহাদুল মুসলিমিন, আসামে ইউডিএফ, জম্মু ও কাশ্মীরে ন্যাশনাল কংগ্রেস ও পিডিপি। এসব দল আঞ্চলিক ধাঁচের হলেও মুসলমানদের স্বার্থে প্রতিনিয়ত সোচ্চার। কিন্তু ভোটের মাঠে তারা লোকসভায় মুসলমান প্রতিনিধি বাড়াতে পারেনি খুব বেশি।
সে জন্য এসব দলকে ‘এক এমপি, দুই এমপি’র দল বলা হয়। এবারও এ রকম দলগুলো কেরালা, আসাম, কাশ্মীর ও তেলেঙ্গনায় দু–একটি করে আসন পাবে। তবে এত অল্প এমপি নিয়ে বিশাল ভারতে সব মুসলমানের কণ্ঠস্বর হওয়া অসম্ভব। উল্টো দিকে এসব দল প্রার্থী দেওয়ায় কংগ্রেস, তৃণমূল, সিপিএম ও সমাজবাদী পার্টির মতো জাতীয় দলগুলো মুসলমান ভোট পাচ্ছে কম। এ রকম অভিযোগ সবচেয়ে বেশি উঠছে ইত্তেহাদে মুসলিমিন বা ‘মিম’ নামে পরিচিত দলটির বিরুদ্ধে।
কংগ্রেস প্রায়ই অভিযোগ করে, তাদের প্রতীকে মুসলমান ভোট কমাতে ‘মিম’ বিজেপির হয়ে কাজ করছে। অন্যদিকে ‘মিমে’র নেতা আসাদউদ্দিন ওয়াইসি বলছেন, কংগ্রেসের মতো কথিত মুসলমানবান্ধব দলগুলো এই সম্প্রদায়কে কিছু দিতে পারেনি, ফলে মুসলমানদের এখন ‘নিজেদের দলে’ সংগঠিত হওয়া জরুরি।
আসাদউদ্দিনের ‘মিম’ হলো একমাত্র মুসলমানপ্রধান দল, যারা জাতীয় দল হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। জ্বালাময়ী ভাষণের কারণে ভক্তরা আসাদউদ্দিনকে বলে ‘নকিব-ই-মিল্লাত’। অর্থাৎ ‘সম্প্রদায়ের ভবিষ্যতের বাহক’। কিন্তু গত দুই দশকে ‘মিম’ মুসলমান সম্প্রদায়ের কেন্দ্রীয় ভরসার জায়গা পায়নি। ফলে মুসলমান ভোটব্যাংক এবারও যথারীতি বিভক্তই থাকছে। এই বিভক্তিতে এই সম্প্রদায়ের ভেতরকার ‘আশরাফ-আজলাফ-আরজাল’ নামীয় মর্যাদার ব্যাপারও আছে।
শেষোক্ত দুই গোষ্ঠী অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতার কারণে অনেক সময় তাদের ‘পছন্দ’কে আশরাফদের সঙ্গে মিলাতে পারে না। উত্তর প্রদেশে মুসলমান সমাজে এ রকম বিভাজন আছে। সেই সূত্রেই ওখানে ‘ওবিসি-মুসলমান’ বলে একটা নতুন সামাজিক বর্গ তৈরি হয়েছে। মুসলমান সমাজের ভেতরকার এ রকম বর্ণ-বিভাজনের একদিকে যেমন সামাজিক বাস্তবতা আছে, তেমনি এ–ও প্রবল সত্য যে বিজেপি এই বিভাজনকে উসকেও দিচ্ছে।
তারা ‘দলিত-মুসলমান’দের জন্য পৃথক ধাঁচের কিছু উন্নয়নসুবিধা দিতে আগ্রহী। এর মাধ্যমে তারা মুসলমান ভোটব্যাংককে কাস্ট ধারায় ভাগ করার কৌশল নিয়েছে। ‘আজলাফ’ ও ‘আরজাল’ মুসলমানরা বিজেপির উন্নয়ন-উদ্যোগগুলোয় এ কারণেও সাড়া দিচ্ছে যে কংগ্রেস ক্ষমতায় থাকার দিনগুলোয় কেবল ‘আশরাফ-মুসলমান’দের সঙ্গে রেখেছিল। বিজেপি মুসলমান সম্প্রদায়ের ভেতরকার এ রকম ব্যবধানগুলো নিয়ে রাজনীতি করতে গিয়ে শিয়াদেরও কাছে টানছে। সুন্নিদের বেরলভি ও দেওবন্দিদের মধ্যকার দ্বন্দ্বও তারা ব্যবহার করছে খোলাখুলিভাবে। উত্তর প্রদেশে বেরলভিরা বিজেপির বিরুদ্ধে থাকলেও দেওবন্দিরা ততটা নয়।
তবে এসব কৌশলের মধ্যে এবার এমন এক পরিবেশে ভোট হচ্ছে, যখন ভারতজুড়ে মুসলমানরা সাধারণভাবে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতায় বেশ কোণঠাসা বোধ করছে। অযোধ্যাসহ বিভিন্ন স্থানে অনেকগুলো বড় মসজিদ তাদের হাতছাড়া হয়েছে। মুসলমানপ্রধান জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্য পরিচয় কেড়ে নেওয়া হয়েছে। দ্বিতীয় মুসলমানপ্রধান আসামে এই সম্প্রদায় সাংস্কৃতিক স্বাধীনতায় বেশ চাপে রয়েছে। তৃতীয় মুসলমানপ্রধান রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে এনআরসির খড়্গ ঝুলছে।
এসব কারণে অনেকে বলছেন, তীব্র চাপের মুখে মুসলমান ভোটাররা এবার হয়তো তাদের সিদ্ধান্তের অতীত ধরন পাল্টাবেন। হয়তো তারা বর্ণ ও শ্রেণি বিবেচনাকে আমলে না নিয়ে প্রতিটি আসনে বিজেপিবিরোধী মূল প্রার্থীকে ভোট দেবেন, তিনি যে দলেরই হোন। গত দু–তিন বছরে কিছু রাজ্য-নির্বাচনের ভোটের ফলে এ রকম প্রবণতা দেখা গেছে। এ নিয়ে কিছু গবেষণাও হয়েছে (দেখুন, Feyaad Allie, Carnegieendowment.org)।
২০২০ সালে বিহারে দেখা গেছে, বিধানসভার ভোটে ৭৭ শতাংশ মুসলমান ভোট পড়েছে পদ্মফুলের প্রতিদ্বন্দ্বী মার্কায়। পরের বছরের পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনে এই সম্প্রদায়ের ৭৭ শতাংশ ভোট পড়েছে বিজেপিবিরোধী তৃণমূলের পক্ষে। ২০২২ সালে উত্তর প্রদেশে ৭৯ শতাংশ মুসলমান স্থানীয় সমাজবাদী দলকে ভোট দেয়।
এ রকম প্রবণতার একটা বিপদের দিক হলো, তাতে হিন্দু ভোটও আরও বেশি ধর্মীয় চরিত্র পেয়ে একক মার্কার দিকে ছুটছেন। অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ার নির্বাচনী অভ্যাস ক্রমে চূড়ান্ত এমন এক সাম্প্রদায়িক চেহারা নিচ্ছে, যাতে কোনো জায়গার কোনো সংখ্যালঘুর জন্য স্বস্তির বার্তা নেই। তারপরও মানুষ চায় সুষ্ঠু ভোট হোক। গণতন্ত্রের এই শেষ শিখাটুকু অন্তত জ্বলুক। সেটাও অবশ্য দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে ঠিকমতো হচ্ছে না।
- আলতাফ পারভেজ: দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে গবেষক
- prothom alo