ভারতের মনিপুরে অস্থিরতা : সমাধান কী

  • আসগর মতিন
  •  ০৫ জুলাই ২০২৩, ২০:২৪, আপডেট: ০৬ জুলাই ২০২৩, ০৫:৩৯
ভারতের মনিপুরে অস্থিরতা : সমাধান কী। – ছবি : সংগৃহীত

ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মনিপুরে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে শুরু হয় জাতিগত দাঙ্গা। এতে এ পর্যন্ত শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কম জনসংখ্যার এই রাজ্যে এই মৃত্যু অনেক বড় ঘটনা। সেখানে সহিংসতা এখনো চলছে। বহু ঘরবাড়ি ও যানবাহনে আগুন দেয়া হয়েছে, কয়েক হাজার মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। সর্বশেষ খবরে কলকাতার দৈনিক পুবের কলম অনলাইন ২ জুলাই জানাচ্ছে, গত ৩ মে থেকে শুরু হওয়া জাতিদাঙ্গার উত্তর-পূর্বের পাহাড়ি এই রাজ্যে কুকি ও মৈতেই জনজাতির মধ্যে সংঘর্ষের ফলে এখনো পর্যন্ত শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে। পত্রিকাটি আরো লিখেছে- বর্ষীয়ান কংগ্রেস নেতা পি চিদম্বরম বলেছেন, অসমের মুখ্যমন্ত্রী মনিপুরে না নাক গলালে ভালো হবে। রোববার টুইটারে তিনি লিখেছেন, ‘অসমের মুখ্যমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, এক সপ্তাহের মধ্যে মনিপুরে শান্তি ফিরে আসবে। তবে তা সহজ হবে যদি অসমের মুখ্যমন্ত্রী মনিপুরে সঙ্ঘাতে নাক না গলান ও দূরে থাকেন।’ একই সাথে তিনি বলেন, ‘যদি বীরেন সিং (মনিপুরের) মুখ্যমন্ত্রী ইস্তফা দেন এবং কয়েক মাসের জন্য মনিপুরে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা হয় তাতেও মনিপুরে শান্তি স্থাপনের বিষয়টি সহজ হবে।’

বার্তা সংস্থাকে উদ্ধৃত করে পত্রিকাগলো বলছে, একই দিন বীরেন সিং পদত্যাগে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এএনআই অনলাইন ৩ জুলাই জানাচ্ছে, বিজেপির সহায়ক দল শিবসেনা (ইউবিটি) এমপি সঞ্জয় রাউত ২ জুলাই বলেছেন, ‘প্রধানমন্ত্রী মোদি কেন এখনো মনিপুর সফর করছেন না? কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী মনিপুরে সফর করেছেন কিন্তু তিনি আসেননি। মনিপুরের ঘটনায় চীন জড়িত, আমরা জানতে চাই এ বিষয়ে কেন্দ্র সরকার কী করেছে। মনিপুরের মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংয়ের পদত্যাগ করা ও রাজ্যটিতে রাষ্ট্রপতির শাসন জারি করা উচিত। এদিকে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী দু’দিন সফর করে ত্রাণ বিতরণ করে ফিরেছেন ৩০ জুন।

বিরোধীদলগুলো মনিপুরের ঘটনায় নরেন্দ্র মোদি ও বিজেপি সরকারের সমালোচনা করেছে এবং এই দাঙ্গার জন্য সরকারকেই দায়ী করেছে। ভারতের সেভেন সিস্টার্স রাজ্যগুলোতে সঙ্ঘাত হলে প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশেও উদ্বেগ থাকা স্বাভাবিক। এখন প্রশ্ন দাঁড়াচ্ছে, সমাধান কোন পথে?

উত্তর-পূর্ব ভারতের সেভেন সিস্টার্স বলা হয় যে সাত রাজ্যকে তার একটি মনিপুর। রাজধানী ইম্ফল। জনসংখ্যা ৩৬ লাখের মতো। রাজ্যে বিধানসভার আসনসংখ্যা ৬০। বর্তমানে বিজেপি রয়েছে ক্ষমতায়। এ রাজ্যের উত্তরে নাগাল্যান্ড, দক্ষিণে মিজোরাম, পশ্চিমে আসাম ও পূর্বদিকে মিয়ানমার। আয়তন ২২ হাজার ৩২৭ বর্গকিলোমিটার। মৈতেই উপজাতি এ রাজ্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী (জনসংখ্যার ৬০ শতাংশ)।

মনীপুরি বা মৈতেইরা পাঁচটি সামাজিক গোষ্ঠীতে বিভক্ত। মৈতেইদের মধ্যে সনাতন ধর্মাবলম্বী বা হিন্দুই বেশি। তবে কিছু খ্রিষ্টান ও মুসলমানও আছেন। মারুপ (মৈতেই সংস্কৃতি ও ধর্মে বিশ্বাসী), মৈতেই খ্রিষ্টান, মৈতেই গৌর চৈতন্য (মৈতেই ও হিন্দুধর্ম উভয়েই বিশ্বাসী), মৈতেই ব্রাহ্মণ (স্থানীয় নাম বামোন) ও মনিপুরি মুসলমান (স্থানীয় নাম মিয়া মৈতেই বা পাঙাল)। মনিপুরী ভাষা তাদের মাতৃভাষা এবং রাজ্যের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা। এখানে রাজতন্ত্র ছিল। পীতাম্বর চারাইরঙবা প্রথম রাজা। ১৮২৪ সালে বার্মার আসাম আক্রমণ থেকে নিষ্কৃতি পেতে মণিপুর রাজ গম্ভীর সিং ব্রিটিশ সাহায্য চাইলে তৎকালীন ভারতের গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম আমহার্স্টের নেতৃত্বে প্রথম অ্যাংলো-বার্মা যুদ্ধ হয়। যুদ্ধের পর মনিপুর ভারতের একটি দেশীয় রাজ্য হিসেবে ব্রিটিশ রাজ্যের অঙ্গীভ‚ত হয়। ১৮৯১ সালে রাজা কুলচন্দ্র সিংয়ের সময়কালে লর্ড ল্যান্সডাউনের সময়কালে ব্রিটিশদের সাথে বিরোধ বাধে। এক বছরের মধ্যে তিনি অপসারিত হন। তার নাবালক পুত্র চুড়াচন্দ্র সিং ক্ষমতায় আসেন। বোধচন্দ্র সিং শেষ রাজা। ১৯৪৭ সালে মনিপুর স্বাধীন রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশের ইচ্ছা প্রকাশ করে। বার্মার (বর্তমান মিয়ানমার) আগ্রাসী মনোভাবে ১৯৪৯ সালে রাজা বোধচন্দ্র সিং ভারত অন্তর্ভুক্তির সম্মতিপত্রে সই করেন। ১৯৫৬ সালে এটি ভারতের কেন্দ্রশাসিত রাজ্য হয়, ১৯৭২ এ পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা পায়।

যা জানা যাচ্ছে, বিজেপি সরকারই রাজ্যে সঙ্কটের মূলে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার দাবি করা হলেও মনিপুরে অস্থিতিশীলতার দু’মাস পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু পরিস্থিতি জটিলই রয়ে গেছে। জাতিগতভাবে বৈচিত্র্যময় ও প্রান্তিক এই জনপদে দশকের পর দশক ধরে বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন, সহিংসতা ও প্রান্তিকীকরণের রাজনীতি সেখানকার মূল সঙ্কট হয়েই থেকে গেছে।

সিএনএন জানায়, গত ৩ মে মনিপুরের চন্দ্রচুড় জেলায় হাইকোর্টের একটি আদেশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিলের ডাক দেয় রাজ্যের আদিবাসী ছাত্রদের ইউনিয়ন ‘অল ট্রাইবাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন’ (এটিএসইউএম)। ওই মিছিলে স্থানীয় নাগা ও কুকি সম্প্রদায়ের হাজার হাজার মানুষ অংশ নেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের সাথে রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় মৈতেই বা মনিপুরীদের সংঘর্ষ বাধে এবং তা দাঙ্গায় রূপ নেয়। মনিপুরের ৩৬ লাখ জনগোষ্ঠীর ৫৩ শতাংশ মৈতেই জাতিগোষ্ঠীর সদস্য, যারা মূলত সনাতন ধর্মাবলম্বী। মনিপুরে মৈতেইরা ‘শিডিউলড ট্রাইব’ (তফসিলি জাতিগোষ্ঠী) হিসেবে গণ্য হয় না। যে কারণে সরকারি চাকরি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষাব্যবস্থায় সংরক্ষণ সুবিধার সুযোগ থেকে তারা বঞ্চিত হয়ে আসছে বলে দাবি মৈতেইদের। ভারতে সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি করতে সে দেশের সংবিধানে এই ‘শিডিউলড ট্রাইব’ স্বীকৃতির বিধান রাখা হয়েছে। সংবিধানে ‘শিডিউলড কাস্ট’ (ভারতে যারা মূলত দলিত বা হরিজন সম্প্রদায়ের সদস্য হিসেবে পরিচিত) ও ‘শিডিউলড ট্রাইব’ ভারতের রাজনীতিতে দীর্ঘ দিনের আলোচনার বিষয়বস্তু। ভারতে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী হিসেবে পরিগণিত হলেও মনিপুরে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় মৈতেইদের ‘শিডিউলড ট্রাইব’ স্বীকৃতি দিলে অন্য সংখ্যালঘু আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর জন্য ওই রাজ্যে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাবে- এই আশঙ্কা থেকে মৈতেইদের ‘শিডিউলড ট্রাইব’ স্বীকৃতির বিরোধিতা করছে রাজ্যের অন্য আদিবাসী সংখ্যালঘুরা, যাদের একটি বড় অংশ ধর্মীয়ভাবে খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী। ভারতের কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপিও মৈতেইদের দাবির পক্ষে সহানুভূতিশীল। তাদের দাবি সমর্থন করেই মনিপুরে বিধানসভা নির্বাচনে জয়লাভ করে বিজেপি। এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গন সরগরম হওয়ার মধ্যেই গত এপ্রিল মাসে মনিপুর হাইকোর্ট রাজ্যসরকারকে মৈতেইদের দাবি বিবেচনার নির্দেশ দেয়। কিন্তু রাজ্যের অন্য আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে এতে উদ্বেগ সৃষ্টি হয় এবং হাইকোর্টের ওই আদেশের প্রতিক্রিয়ায় মনিপুরের অল ট্রাইবাল স্টুডেন্টস ইউনিয়নের ডাকা মিছিল শুরু হলে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে।

সহিংস সংঘর্ষের ভিডিওচিত্রে দেখা যায়, উন্মত্ত জনতা বিভিন্ন ঘরবাড়ি ও যানবাহনে আগুন দিচ্ছে।

প্রত্যক্ষদর্শীরা সিএনএনকে জানিয়েছে, তাদের ঘরবাড়ি ও গির্জা আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। ভীতসন্ত্রস্ত পরিবারগুলো সহিংসতাপূর্ণ এলাকা ছেড়ে পালিয়েছে এবং অনেকেই সামরিক বাহিনীর আশ্রয়শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। সংঘর্ষের জেরে ৩ মে মনিপুরজুড়ে প্রায় ৩৬ লাখ বাসিন্দার ইন্টারনেটসেবা বন্ধ করে দেয়া হয়। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে সব গোষ্ঠীকে শান্তি বজায় রাখার অনুরোধ জানানো হয়। রাজ্যের সাধারণ নাগরিকরা জানাচ্ছেন, সেখানে আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। রাজ্যে ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সরকার দাঙ্গার পর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ‘উপায়ান্তর’ না পেলে ‘দেখামাত্র গুলি করার’ নির্দেশ জারি করে।

আগেই বলেছি, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ‘সেভেন সিস্টার্স’ নামে পরিচিত যে সাতটি রাজ্য রয়েছে তার একটি মনিপুর। মনিপুরের পূর্বাংশে মিয়ানমারের সাথে সীমান্ত রয়েছে এবং ওই সীমান্তে যথেষ্ট অস্থিরতাও রয়েছে। বাংলাদেশের সিলেট থেকে পূর্বদিকে আসামের শিলচর জেলা পার হয়ে মনিপুর রাজ্যের সীমানা শুরু।

বাংলাদেশের সাথে মনিপুরের সীমান্ত নেই। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে ভারতে ‘প্রিন্সলি স্টেট’ হিসেবে যে রাজ্যগুলোর মর্যাদা ছিল, তার একটি মনিপুর। কাশ্মিরের মতো মণিপুরও ভারত স্বাধীন হওয়ার পরপরই ভারতে যুক্ত হয়নি; বরং ১৯৪৯ সালে তারা ভারতের যুক্তরাজ্য ব্যবস্থায় যুক্ত হয়। মনিপুরের শাসক মহারাজা বুদ্ধচরণ ভারত সরকারের সাথে এ বিষয়ে চুক্তি সই করেন। আর তা থেকেই ওই রাজ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদের আন্দোলনেরও সূত্রপাত। তবে গত মে মাসে শুরু হওয়া দাঙ্গা ও সহিংস পরিস্থিতি গত কয়েক বছরের মধ্যে সেখানে সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ ও অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে।

সহিংসতা মাথাচাড়া দেয়ার কারণ কী? নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইম্ফলের এক আদিবাসী যুবনেতা সিএনএনকে বলেন, তাদের বাড়ি লুটপাট করে ভাঙচুর করা হয়েছে এবং পরিবারকে সামরিক আশ্রয়শিবিরে শরণার্থী হতে বাধ্য করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমরা এখানে যা দেখছি, দুর্ভাগ্যজনক হলেও মনে হচ্ছে, খুবই পরিকল্পনামাফিকই এই দাঙ্গা বাধানো হয়েছে এবং বিরোধীদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। তারা স্পষ্টভাবে জানে কোন বাড়িগুলোতে সংখ্যালঘু আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোকজন বাস করে এবং সেখানেই হামলা ও অভিযান চালানো হচ্ছে।’

দ্বন্দ্ব কোথায়? মনিপুরে মৈতেই এবং অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে বিভেদটি রাজনৈতিক ও ভৌগোলিকভাবে স্পষ্ট। গত সপ্তাহের দাঙ্গায় এই বিভেদের চিত্রটি সামনে এলেও দুই পক্ষের মধ্যকার উত্তেজনা দীর্ঘ দিনের এবং ভূমি অধিকার, সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন থেকে শুরু করে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে এই দূরত্ব ও বিভেদ চলছে। রাজ্য সরকার এবং প্রশাসনের বিভিন্ন পদে মৈতেইদের আধিপত্য চোখে পড়ার মতো এবং সেখানে অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নতির সুবিধা অন্য আদিবাসী গোষ্ঠীগুলোর তুলনায় তারাই বেশি ভোগ করে। সম্প্রতি বিজেপি ক্ষমতা গ্রহণের পর সেখানে হিন্দু ও খ্রিষ্টানদের মধ্যে ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টির প্রবণতা স্পষ্ট হয়েছে। ‘শিডিউলড ট্রাইব’ না হওয়ায় মৈতেইরা সংরক্ষিত এলাকায় ভূমির মালিকানা নিতে পারে না। এখন মনিপুর হাইকোর্টের রায়ের পর নাগা ও কুকি সম্প্রদায়ের সদস্যদের মধ্যে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে, এই দাবি পূরণ হলে তারা সরকারের বিভিন্ন সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে বড় প্রতিযোগিতায় পড়বে এবং মৈতেইরা তাদের এলাকায় ভূমি দখল করতে শুরু করবে। তার ওপর ভূ-রাজনৈতিক সঙ্কট তো রয়েছেই। ২০২১ সালে প্রতিবেশী মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান ও সামরিক বাহিনীর অভিযানের ফলে সে দেশের আদিবাসী গোষ্ঠী চিন সম্প্রদায়ের অনেকে সীমানা পেরিয়ে মনিপুরে আশ্রয় নেয়। মনিপুরের কুকিরা, যারা জাতিগতভাবে চিন সম্প্রদায়ের সমগোত্রীয়, বলছে, ভারতে আশ্রয় নেয়া এই শরণার্থীদের বিরুদ্ধে অনৈতিক অভিযান পরিচালনা করছে রাজ্য সরকার। যে কারণে কুকিরা নিজেদের জাতিগত বিদ্বেষের শিকার ভাবছে এবং অসহায়বোধ করছে।

কী বলছে প্রশাসন? মনিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং বলেছেন, তিনি ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সাথে ধারাবাহিক যোগাযোগ বজায় রেখে চলছেন এবং পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন। পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে বলেও দাবি করেন তিনি। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ইন্ডিয়া টুডেকে বলেন, মনিপুরের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণেই আছে। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ভয় পাওয়ার বা শঙ্কিত হওয়ার কারণ নেই।

সর্বশেষ পরিস্থিতি কী? রাজ্যজুড়ে বিচ্ছিন্নভাবে এখনো সহিংসতার খবর পাওয়া যাচ্ছে। কুকি সম্প্রদায়ের কিছু বসতিতে বাঁশ-কাঠের ব্যারিকেড দিয়ে সুরক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। মণিপুরের অনেক বাসিন্দাই প্রাণ বাঁচাতে পাশের রাজ্য নাগাল্যান্ড, মিজোরাম ও মেঘালয়ে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের অনেকে বাড়ি ফিরতে শুরু করেছে বলে রয়টার্স জানিয়েছে।

মনিপুরের ঘটনায় ভারতের বিরোধী দলগুলো বসে নেই। সর্বদলীয় প্রতিনিধিদল পাঠানোর দাবি করেছিল বিরোধী দল কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেসসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। ২৪ জুন এক বৈঠকে বিরোধী নেতারা বলেন, সরকারের উচিত কোনো টালবাহানা না করে অবিলম্বে অস্ত্র উদ্ধারের যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা। সে সব অস্ত্র একে অন্যের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হচ্ছে। মনিপুরের তিনবারের মুখ্যমন্ত্রী কংগ্রেস নেতা ইবোবি সিং বলেন, এর পাশাপাশি সরকারকে দ্রুত ত্রাণ ও পুনর্বাসনের বন্দোবস্ত করতে হবে। মনিপুরবাসীকে বোঝাতে হবে, তারা দেশের মূলধারার অঙ্গ। তিনি বলেন, দুঃখের বিষয়, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের চূড়ান্ত ব্যর্থতা আজ মনিপুরকে এ অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে।

বিরোধীদের অভিযোগ, যা ছিল গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, ক্রমে তা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় পরিণত হয়েছে। তাদের দাবির পর আর সহিংসতা শুরুর ৫২ দিন পর কেন্দ্রীয় সরকার সর্বদলীয় বৈঠক ডাকার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেছে। অথচ ৪ মে থেকে কংগ্রেস এই দাবি জানিয়ে আসছে। বিরোধীরা প্রত্যেকেই বলেন, সরকার কতটা উদাসীন, তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নীরবতা। বিজেপি শাসিত একটি রাজ্য দেড় মাস ধরে জ্বলছে, অথচ প্রধানমন্ত্রী নির্বিকার!

রাজ্যের পরিস্থিতি কেমন ও সরকার এতদিন ধরে সামাল দিতে কী কী করেছে, বৈঠকে বিরোধীদের কাছে সরকারের পক্ষে তার খতিয়ান তুলে ধরা হয়। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কিভাবে প্রতিদিন খবর নিচ্ছেন, তা জানানো হয়। কিন্তু সরকার বিরোধীদের দাবি মেনে সর্বদলীয় প্রতিনিধিদল পাঠানোর বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি। বিরোধী নেতাদের জানানো হয়, মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে রাজ্যের সীমান্তে ১০ কিলোমিটারজুড়ে কাঁটাতারের বেড়া দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ছাড়াও ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সংসদীয় মন্ত্রী প্রহ্লাদ যোশি। উপস্থিত ছিলেন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডা। একমাত্র মণিপুরি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন তিনবারের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী কংগ্রেস নেতা ইবোবি সিং। অন্যান্যের মধ্যে ছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভার সদস্য ডেরেক ওব্রায়ান, আম আদমি পার্টির সংসদ সদস্য সঞ্জয় সিং, শিবসেনা (উদ্ধব) মুখপাত্র প্রিয়াঙ্কা চতুর্বেদি, ডিএমকের তিরুচি শিবা, আরজেডির মনোজ ঝা, সিপিএমের জন ব্রিটাস, এআইএডিএমকের এম থাম্বিদুরাই, এসপির সংসদ সদস্য রামগোপাল যাদব প্রমুখ।

মনিপুরের সংখ্যাগুরু মৈতেই সম্প্রদায়কে তফসিলি উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া যায় কি-না, তা খতিয়ে দেখতে হাইকোর্ট একটি সুপারিশ করার পর থেকে সহিংসতা চলছে। তবে ইতোমধ্যে বিজেপিরই এক বিধায়ক মৈতেই সম্প্রদায়ের জন্য তফসিলি উপজাতির মর্যাদা সম্পর্কিত মনিপুর হাইকোর্টের আদেশকে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে একটি আবেদন করেছেন। মনিপুর বিধানসভার পার্বত্য অঞ্চল কমিটির (এইচএসি) চেয়ারম্যান, ডিঙ্গাংলুং গ্যাংমেই যিনি রাজ্য বিধানসভায় ক্ষমতাসীন বিজেপিরই একজন এমএলএও বটে, তিনি তার আবেদনে বলেছেন, তফসিলি উপজাতির তালিকায় কোন সম্প্রদায় অন্তর্ভুক্ত হবে বা হবে না, তা দেখার এবং বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব একমাত্র রাজ্য সরকারের, হাইকোর্টের নয়। হাইকোর্টের অপ্রীতিকর আদেশের ফলে মনিপুরে অশান্তি সৃষ্টি হয়েছে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, সঙ্কটের বীজ যেখানে লুক্কায়িত সে বিষয়টি সামনে এনে সুরাহা করতে চাইলে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার ভালো করবে। পাশে চীন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। চীনের সাথে ভারতের সম্পর্ক ভালো নয়। চীন মনিপুর ঘটনায় জড়িত এমন অভিযোগও করা হয়েছে। সাম্প্রতিক কিছু কর্মকাণ্ডে মিয়ানমারের সাথে সম্পর্কেরও অবনতির শঙ্কা আছে। তা ছাড়া দেশটিতে যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজমান। বাংলাদেশের কোনো স্বার্থহানির আপাত শঙ্কা না থাকলেও, ভৌগোলিক সন্নিহিতির কারণেই সেভেন সিস্টার্সের ঘটনাবলিতে বাংলাদেশের শঙ্কামুক্ত থাকার সুযোগ নেই।

লেখক : কলামিস্ট ও আন্তর্জাতিক ঘটনাবলির বিশ্লেষক