ভারতের জনগণ এবার আসল প্রতিদ্বন্দ্বিতা চায়

ভারতের জনগণ এবার আসল প্রতিদ্বন্দ্বিতা চায়

মহুয়া মৈত্র :

এক সময়ের প্রাণবন্ত এবং ইদানীং ক্ষতবিক্ষত ভারতীয় গণতন্ত্রে প্রধানমন্ত্রীর শাসন পদ্ধতির লক্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো ধর্মীয় মেরূকরণ ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে দাসানুদাসে পরিণত করা এবং বিরোধীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত সংস্থাগুলোর অপব্যবহার। প্রচারণায় তিনি এবং তাঁর দল বক্তৃতাগুলোতে মুসলিমবিরোধী ঝাঁজ মেশাতে ব্যস্ত; যদিও তা ভারতের নির্বাচনী আইন লঙ্ঘন করে, যেখানে ধর্ম-বর্ণ-ভাষা বা আঞ্চলিকতার ভিত্তিতে ভোট চাওয়াকে স্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ অবস্থায় কেমন হতে পারে আজকের ভারতে বিরোধী প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ানোর অর্থ? কীসের সঙ্গে আমাদের লড়তে হচ্ছে, তার একটা ধারণা আমি এখানে দিতে চাই।

ভোটের অধিকার সুরক্ষার প্রথম প্রতিষ্ঠান হলো ভারতের নির্বাচন কমিশন (ইসিআই), যার অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করার কথা। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি অসহায় দর্শকে পরিণত হয়েছে। অতীতে সরকার সর্বদা ইসি সদস্যদের নিয়োগ দিত, তবে প্রতিষ্ঠানটি আগে কখনও এত পক্ষপাতদুষ্ট হয়নি। এই প্রেক্ষাপটেই সুপ্রিম কোর্ট গত বছর বলেছিলেন, এখন থেকে নির্বাচন কমিশনারদের এমন একটি প্যানেল গঠন করা উচিত, যেখানে সরকারের সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। আদালত প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা এবং ভারতের সর্বোচ্চ পদমর্যাদার বিচারকের সমন্বয়ে তিন সদস্যের একটি প্যানেলের সুপারিশ করেছিলেন। কিন্তু মোদি এমন একটি আইন পাস করলেন, যার ফলে প্যানেলের তৃতীয় সদস্য হিসেবে কেবল সরকারের অন্য কোনো মন্ত্রীকে বেছে নেওয়া হয়। এই ত্রুটিপূর্ণ প্যানেলের মাধ্যমে দুটি ইসি সদস্যপদ পূরণ করা হলো।
ফলে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, মোদি এবং তাঁর ক্ষমতাসীন দল বিজেপির সদস্যদের নির্বাচনী আইনের গুরুতর লঙ্ঘনের অভিযোগ ইসি এখন মূলত নীরবে হজম করছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ, প্রচারণার মৌসুমে বিভিন্ন সরকারি সংস্থার দ্বারা বিরোধী দলগুলোকে সরকারের নির্লজ্জ হয়রানির মুখেও ইসি হস্তক্ষেপ করতে অস্বীকার করেছে, যা আগে দেখা যায়নি।

নির্বাচনের প্রাক্কাল অর্থ মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রিত আয়কর কর্তৃপক্ষ ভারতের বৃহত্তম বিরোধী দল কংগ্রেস পার্টির ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করে। (কর্তৃপক্ষ বলেছে, এটি খেলাপিদের বিরুদ্ধে একটি ‘নিয়মিত প্রক্রিয়া’ ছিল।) এতে দলটি প্রচারের জন্য তহবিল সরবরাহে অসুবিধায় পড়ে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনৈতিক অপরাধ শাখা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট বিরোধী দুই মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেপ্তার করেছে এবং বিরোধী রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে সমন জারি করে চলেছে, যা ইতোমধ্যে অর্থহীন মামলা হিসেবে নিন্দার শিকার হয়েছে। যখন ফেডারেল বা রাজ্য স্তরের সরকারি সংস্থাগুলো নির্বাচনী ফলকে প্রভাবিত করার মতো কর্মে নিয়োজিত হয়, তখন সংবিধানের অধীনে ইসির হস্তক্ষেপ করার একটি জোরালো বিধান আছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশনাররা সামান্য উস্কানিতে বিরোধী দল চালিত রাজ্য সরকারগুলোর বিরুদ্ধে কাজ করতে আগ্রহী হলেও, মোদির ফেডারেল সংস্থাগুলোর স্পষ্ট অপব্যবহারে উদ্বিগ্ন হন না।

ভারতের বিরোধী দলগুলোকে মোদি সরকারের ‘নির্বাচনী বন্ড’ প্রকল্পের মধ্যে যেভাবে কাজ করতে হচ্ছে, তা এমন এক অসমতল নির্বাচনী মাঠের ইঙ্গিত দেয়, যার তুলনা নেই। বন্ডের এই প্রকল্প অস্বচ্ছ ও বেনামি রাজনৈতিক অর্থায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে গঠিত। অবশ্য মার্চ মাসে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নেন এবং প্রকল্পটি নিষিদ্ধ করেন। দেশের বৃহত্তম সরকারি ব্যাংক স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া ও নির্বাচন কমিশনকে দাতাদের এবং তাদের তহবিলের সব বিবরণ সংশ্লিষ্ট দলগুলোর কাছে প্রকাশ্যে তুলে ধরার নির্দেশ দেন। ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং ইসিআইর ব্যাপক সন্দেহ থাকা সত্ত্বেও মোদি প্রবর্তিত ২০১৭ সালের এই প্রকল্প কার্যকরভাবে শেল কোম্পানি তথা ছদ্মবেশী ব্যবসায় এবং বেনামি দাতাদের রাজনৈতিক দলগুলোকে বিপুল পরিমাণ অর্থ দেওয়ার সুযোগ দেয়।

অর্থের সবচেয়ে বড় অংশ, প্রায় ৫০ শতাংশ গেছে মোদির বিজেপিতে। প্রথমদিকে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করতে অস্বীকার করেছিল। কিন্তু পরে তিনজন বিচারকের একটি বেঞ্চ একটানা জোরালো অবস্থান নিলে ব্যাংক তথ্য প্রকাশ করে। তথ্যগুলো কারও কারও কাছে আশ্চর্যজনক ঠেকছে। তবে ভারতের বিরোধীরা বছরের পর বছর ধরে যা বলে আসছে, তা-ই নিশ্চিত বলে মনে হচ্ছে– এই পরিকল্পনাটি বিজেপির স্বার্থে পরিচালিত হয়েছিল। ভারতীয় মিডিয়া তখন থেকে বেশ কয়েকটি কোম্পানির বিষয়ে প্রতিবেদন বের করেছিল, যেখানে দেখা গেছে– কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থাগুলো অভিযান চালানোর পরে অনেক কোম্পানি নির্বাচনী বন্ড কিনেছিল। এ কারণে নির্বাচনী তহবিল সংগ্রহের নামে ‘চাঁদাবাজি’র অভিযোগ উঠেছে। বিরোধী রাজনীতিবিদরা কোম্পানিগুলোর বিরুদ্ধে বিজেপিকে অনুদান দেওয়া এবং এর বিনিময়ে সরকারি চুক্তি পাওয়ার ব্যাপারে তুমুল অভিযোগ করেছেন।

নির্বাচনী প্রচারণায় সমর্থকদের উদ্দেশে বক্তব্য দিচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি 	এএফপি

নির্বাচনী প্রচারণায় সমর্থকদের উদ্দেশে বক্তব্য দিচ্ছেন নরেন্দ্র মোদি এএফপি

প্রতিটি নির্বাচনে তহবিল সংগ্রহে বিরোধীদের ব্যাপক পেছনে ফেলার পাশাপাশি বিজেপি মিডিয়ার বড় অংশকে আর্থিক সুবিধা দিয়ে অধীন করেছে। বেকারত্ব, মুদ্রাস্ফীতি ও ভারতীয় ভূখণ্ডে চীনের অনুপ্রবেশের মতো প্রতিটি তাৎপর্যপূর্ণ জাতীয় ইস্যু জনদৃষ্টির আড়াল করতে মরিয়া হয়ে প্রোপাগান্ডা চালিয়েছে। এ ছাড়া পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুরে গৃহযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যেখানে দুই শতাধিক লোক নিহত হয়েছে এবং মোদি এই ঘটনার সমাধান দিতে ব্যর্থ। খুব নিবিড়ভাবে দেখলে, বড় বড় মিডিয়া মোদির ধর্মভিত্তিক ব্যক্তিত্বের সমর্থক। এই সপ্তাহে প্রথম সারির একটি টিভি নিউজ চ্যানেল তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘কোন শক্তি আপনাকে এগিয়ে যাওয়ার এই দৃঢ় সংকল্প দেয়?’ উত্তরে মোদি বলেন, ‘ঈশ্বর সম্ভবত আমাকে এই কাজ করতে পাঠিয়েছেন’।
তবে মোদির জন্য দুর্ভাগ্য, ভোট গ্রহণকে অকারণ লম্বা করার মাধ্যমে তিনি যে বিরোধীদের ক্লান্ত করার আশা করেছিলেন, তা এক প্রকার বুমেরাং হতে চলেছে। প্রথম চারটি ধাপে ভোটারদের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে, যা টানা তৃতীয়বারের জন্য নির্বাচিত হওয়ার বিজেপির আশা পূরণের পক্ষে ভালো নয়।

ভারতের ভোটাররা নির্বাচনকে একটি উৎসব হিসেবে বিবেচনা করতে অভ্যস্ত যেখানে; প্রতি পাঁচ বছরে একবার দরিদ্রতম নাগরিকরা তাদের কার্ডগুলো বুকের কাছে রেখে তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারে। বিজেপি মরিয়া হয়ে তার সাম্প্রদায়িক কার্ড খেলে যাচ্ছে। তবে এবার সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য তা যথেষ্ট না-ও হতে পারে। মোদি ট্র্যাকের মালিক, রেফারিও তাঁর লোক। কিন্তু জনতা একটি আসল প্রতিযোগিতা চায় বলেই মনে হয়।

মহুয়া মৈত্র: তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা; দ্য গার্ডিয়ান থেকে অনুবাদ করেছেন ইফতেখারুল ইসলাম

samakal