শশী থারুর
প্রায় ৯৬ কোটি ৮০ লাখ নিবন্ধিত ভোটার নিয়ে আগামী এপ্রিল ও মে মাসে ভারতে সাধারণ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এই ভোটের মধ্য দিয়ে দেশটিতে মানব–ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক অনুশীলন হবে। তবু এই নির্বাচনকে ঘিরেই ভারতীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ–সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রশ্ন সবার মাথায় চক্কর খাচ্ছে।
বাস্তবতা হলো, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) গদি ধরে রাখার এক দশক পরে এসে দেখা যাচ্ছে, ভারতের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো বলা যায় ধ্বংস হয়ে গেছে।
বিজেপি সরকার গত দশকজুড়ে লাগাতারভাবে ভিন্নমতকে হুমকি দিয়ে আসছে। ধারাবাহিকভাবে ভিন্নমত দমনের ফলে ভারত তার বহুত্ববাদী সংস্কৃতি থেকে কার্যত ছিটকে পড়েছে।
রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, ছাত্রবিক্ষোভে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থী, স্বাধীনচেতা সংবাদ সংস্থা, স্বতন্ত্র সাংবাদিক, মানবাধিকার সংগঠনসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে দমন করা হচ্ছে। তাদের নিরবচ্ছিন্নভাবে ভয় দেখানো ও নির্যাতন করা হচ্ছে।
এ কারণে নাগরিক স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দৃশ্যমানভাবে চাপের মধ্যে পড়ে গেছে। কৃষকদের বিক্ষোভ এবং বিভিন্ন সরকারবিরোধী আন্দোলনের খবর প্রকাশ করার ‘অপরাধে’ অন্য অনেকের মতো সাংবাদিক এবং আন্দোলনকর্মীদের নিশানা করা হয়েছে। রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা দিয়ে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, এখনো করা হচ্ছে।
যেসব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্ল্যাটফর্ম এবং মূলধারার সংবাদপত্র মোদি সরকারের সমালোচনা করে থাকে, তাদের সরকারবিরোধী সব ধরনের কনটেন্ট তুলে নেওয়ার জন্য কর্তৃপক্ষ নিয়মিত চাপ দিয়ে থাকে। দেশের যেসব এলাকায় সরকারবিরোধী আন্দোলনকর্মীরা জড়ো হয়েছেন এবং বিক্ষোভের প্রস্তুতি নিয়েছেন, সেসব এলাকায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাকাউন্ট এবং ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটেছে। বিরোধী নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করার পর তাঁরা যাতে কোনোভাবে জামিন না পান, সে জন্য তাঁদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইন ব্যবহার করা হচ্ছে।
এর মধ্যে সংখ্যালঘুদের অধিকার সবচেয়ে বেশি সংকুচিত হয়েছে। তাঁদের ওপর ধারাবাহিক অত্যাচার–নির্যাতনের কারণে সামাজিক ও সম্প্রদায়গত বিভেদ ও উত্তেজনা অনেক বেড়ে গেছে।
ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু দেশটিতে যে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের সূচনা করেছিলেন, ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রী মোদি সেই ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের অঙ্গীকার থেকে সরে এসেছেন। তিনি শুধু হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠার উদ্দশ্যে ভারতের বহুত্ববাদী উত্তরাধিকারকে অস্বীকার করে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিদ্যমান বৈষম্যকে তীব্রতর করার অনুমতি দিয়েছেন।
এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ, ভারতের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো পাস করা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ)। এই আইনের মাধ্যমে প্রতিবেশী দেশ থেকে আসা উদ্বাস্তু নাগরিকদের নাগরিকত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে ধর্মকে মানদণ্ড হিসেবে প্রবর্তন করা হয়েছে।
ওই আইনে মুসলমানদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না বলে ঘোষণা দেওয়া রয়েছে। এটি একটি সুদূরপ্রসারী বিশদ পরিকল্পনার অংশ মাত্র।
এই মুহূর্তে ভারতের ২০ কোটি মুসলমান (যাঁরা ১৪ শতাংশ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছেন) ক্ষমতাসীন দলের নিশানায় পড়েছেন।
অনেক গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে গুরুতর চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে গেছে। দেশের বিভিন্ন ব্যক্তিও প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির তল্লাশিতে নিয়োজিত সংস্থা সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা সিবিআইকে বশ্যতা মানানোর চেষ্টায় সরকার এতটাই সফল হয়েছে যে সুপ্রিম কোর্ট এই সংস্থাকে ‘মনিবের কথা বলা খাঁচার তোতা পাখি’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
বিজেপি তার সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ানো বিরোধী নেতাদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত দুর্নীতি তদন্তের হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। ট্যাক্স অডিট এবং এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেটের তদন্ত প্রায় একচেটিয়াভাবে বিরোধী নেতা-কর্মী ও সরকারের সমালোচকদের টার্গেট করে করা হচ্ছে।
ভারতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়াকে অত্যন্ত সম্মানের চোখে দেখা হয়। এই প্রতিষ্ঠানও বিজেপির থাবা থেকে রেহাই পায়নি। সরকারের সঙ্গে বিরোধের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকটির দুজন গভর্নর তাঁদের চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। এর ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীনতা নিয়ে অনেকে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
ভারতে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার অপব্যবহারও উদ্বেগজনক অবস্থায় চলে গেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিজেপি ক্রমবর্ধমানভাবে ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করেছে। তারা রাজ্য সরকারগুলোর মাথায় দেশের ট্যাক্স-রাজস্বের একটি বৃহত্তর অংশের বোঝা চাপিয়ে দিচ্ছে। অন্যদিকে বিরোধী দল-শাসিত রাজ্যগুলোতে পক্ষপাতদুষ্ট রাজ্যপাল নিয়োগ করছে। এসবের মাধ্যমে তারা আঞ্চলিক শাসক দলগুলোকে সব দিক থেকে খাটো করছে।
এমনকি ভারতের নির্বাচন কমিশনও (ইসিআই) পক্ষপাতমূলক কাজকারবারের জন্য সমালোচনার মুখে পড়ে গেছে। কিছু পর্যবেক্ষক ও নির্বাচনবিশেষজ্ঞ মনে করছেন, ইসিআই এখন সরকারের এজেন্ট ছাড়া আর কিছুই নয়।
এটি অবশ্যই নির্বাচনী প্রক্রিয়ার অখণ্ডতার বিষয়ে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। এটি ন্যায্যতা ও ন্যায়পরায়ণতাভিত্তিক গণতান্ত্রিক নীতির প্রতি ইসির আনুগত্য থাকবে কি না, সেই প্রশ্নেও উদ্বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে।
এসব কাণ্ড ঘটে যাওয়ার পর ভারতকে আর গণতন্ত্রের আদর্শ বলা চলে না। একসময় বহুত্ববাদের প্রতি প্রতিশ্রুতিশীল অবস্থানে থাকার সুবাদে ভারত প্রশংসিত হলেও বর্তমানে দেশটি বৈশ্বিক গণতন্ত্র র্যাঙ্কিংয়ে অনেক পেছনে পড়ে গেছে।
২০২০ সালে দ্য ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের গণতন্ত্র সূচকে ভারত ২৭তম থেকে একটানে ৫৩তম অবস্থানে নেমে গেছে। এ ছাড়া ফ্রিডম হাউস এবং ভ্যারাইটিজ অব ডেমোক্রেসি ইনস্টিটিউটের (ভি-ডেম) মতো অনেক সংগঠন ভারতকে এখন গণতন্ত্র বলা যাবে কি না, সেই প্রশ্ন তুলেছে। ভি-ডেম ভারতকে একটি ‘নির্বাচিত স্বৈরতন্ত্র’ বলে আখ্যায়িত করেছে।
সরকারের সঙ্গে যেকোনো ধরনের মতপার্থক্যকে ‘দেশবিরোধী’ এবং হিন্দুত্বের যেকোনো সমালোচনাকে ‘হিন্দুবিরোধী’ দাগিয়ে দেওয়ার কাজটি বিজেপি ক্রমাগত করে যাচ্ছে। এসব করে বিজেপি তার শাসনের যেকোনো ধরনের বিরোধিতাকে অন্যায্য ও অবৈধ হিসেবে জনমনে প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে।
ভারতের জনসাধারণের একটি বড় অংশ এখন বিশ্বাস করে, যারা সরকারবিরোধী, তারা ভারতের জাতীয় স্বার্থের বিরুদ্ধে কাজ করছে। এ কারণে সরকারের দমনমূলক পদক্ষেপগুলো ব্যাপকভাবে জনসমর্থন পাচ্ছে।
পিউ রিসার্চ সেন্টারের ২০২৩ সালের গ্লোবাল অ্যাটিচিউড সার্ভেতে দেখা গেছে, তাদের জরিপকারীদের প্রশ্নের জবাবে আশ্চর্যজনকভাবে ৮৫ শতাংশ ভারতীয় উত্তরদাতা বলেছেন, কর্তৃত্ববাদী শাসনকেই তাঁরা তাঁদের দেশের জন্য ভালো মনে করেন। মোট ২৪টি দেশের মধ্যে এই জরিপে এই ধরনের প্রতিক্রিয়া ভারতেই সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে।
অন্যদিকে ভারতীয় নাগরিকদের মধ্যে যাঁরা বিশ্বাস করেন বিরোধী দলগুলোর স্বাধীনভাবে কাজ করতে সক্ষম হওয়াটা অপরিহার্য, তাঁদের সংখ্যা খুবই কম।
জাতীয় স্বার্থকে হৃদয়ে ধারণ করে জাতিকে পথ দেখানো একজন অনন্য শক্তিশালী নেতা হলেন নরেন্দ্র মোদি—এই কথাকে জনমনে গেঁথে দেওয়ার জন্য মোদি নিজে ও তাঁর বিজেপি গণতন্ত্রের প্রতি জনগণের বীতশ্রদ্ধ হয়ে ওঠাকে সুকৌশলে কাজে লাগিয়েছেন।
গণতন্ত্রের প্রতি জনবিরক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিজেপি এমন একটি ভাষ্য দাঁড় করাচ্ছে যে মোদি স্বাধীনভাবে যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন। তাঁর কোনো কাজে পার্লামেন্ট কিংবা বিচার বিভাগের কোনো ধরনের আপত্তি থাকতে পারে না।
এসব গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণ ভারতের ২০২৪ সালে অনুষ্ঠেয় লোকসভা নির্বাচনের সম্ভাব্য অবস্থাকে উন্মোচন করে দেয়।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী দেবাশীষ রায় চৌধুরী ও জন কিন তাঁদের যৌথভাবে লেখা টু কিল এ ডেমোক্রেসি বইয়ে বিচার বিভাগকে বিজেপির দিক থেকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেওয়া এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে ক্রমবর্ধমানভাবে সংকুচিত করাকে ‘গণতন্ত্র হত্যার’ লক্ষণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
ভারতের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কীভাবে ক্রমাগত ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে, তার একটি বিশদ ও অতি উদ্বেগজনক বর্ণনা ওই বইয়ে আছে।
ভিন্নমতকে অপরাধী হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া, বাক্স্বাধীনতাকে ক্ষুণ্ন করা এবং যেকোনো রাজনৈতিক বিরোধিতাকে কঠোর হাতে দমন করার টানা চেষ্টার মাধ্যমে বিজেপি সরকার ভারতের দীর্ঘমেয়াদি সম্ভাবনার পথে একটি গুরুতর হুমকি হিসেবে কাজ করছে।
তবে এত কিছুর পরও ভারতের গণতান্ত্রিক চেতনা একেবারে মরে যায়নি। এখনো দেশটির নাগরিকেরা অত্যন্ত সরবভাবে রাজনৈতিক বিতর্কে জড়িত আছেন এবং তাঁরা তাঁদের অধিকারের পক্ষে প্রচার চালাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ আছেন।
সামনে সাধারণ নির্বাচন। এই ভোটের মধ্য দিয়ে প্রায় ১০০ কোটি ভারতীয় ভোটার তাঁদের দেশকে সেই পথে ফিরিয়ে আনার একটি বড় সুযোগ পাবেন যে পথে প্রায় পৌনে শতাব্দী ধরে ভারত গৌরবের সঙ্গে এগিয়ে যাচ্ছিল। এই সুযোগকে তাঁদের কাজে লাগাতেই হবে।
Prothom alo