শেখ হাসিনার মিথ্যা বচন:
দশ টাকা কেজি চাল
পাচ টাকা কেজি মরিচ
বিনামূল্যে সার
ডিজিটাল বাংলাদেশ
ঘরে ঘরে চাকুরি দেয়ার প্রতিশ্রুতি
৫৭ বছর হলে অবসর নেয়ার ঘোষণা
মদিনা সনদের আলোকে দেশ চলবে
ভোট দিয়ে জনগণ আওয়ামী লীগকে নির্বাচিত করেছে
জিয়া মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি বাহিনীর হয়ে কাজ করেছিল
।। আরিক শামস ।।
লণ্ডন, ০১ অক্টোবর : সত্য আর মিথ্যার ব্যবধান দিন ও রাতের ব্যবধানের মতই। বিশ্বের দেশে দেশে রাজনীতিকরা একথা বিশ্বাস করলেও বাংলাদেশের বর্তমান শাসক গোষ্ঠী ও তার প্রধানমন্ত্রী সম্ভবত এই সত্যটি বেমালুম ভুলে গেছেন। তিনি মিথ্যা, মিথ্যা এবং ডাহামিথ্যাকে শত সহস্রবার উল্লেখ করে সত্যে পরিণত করার অপরিপক্ক লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছেন। এক দশকেরও বেশী সময় তাঁর দেশের জনগণের ভোটের অধিকার, দুর্নীতি-অনিয়ম, সন্ত্রাস ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অসংখ্য মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছেন এবং বারবার সেই মিথ্যাকে উচ্চারণের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় মিথ্যাচারের ক্ষেত্রে এক বিশেষ রেকর্ড তৈরী করেছেন। মসজিদের ইমাম, গণমাধ্যমে কর্মরত সাংবাদিক কিংবা ব্যবসায়ী বা আমলা অসত্য উচ্চারণ করলে বা অনিয়ম করলে তা বলা যাবে। লেখা যাবে। কিন্তু রাজনীতিকরা অনিয়ম করলে, মিথ্যা কথা বললে তা লেখা যাবেনা, বলা যাবেনা! আর তিনি যদি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হন, তাহলে সেটা উচ্চারণ তো দূরে থাক, চিন্তাও করা যাবে না! এমন একটা হুমকিপূর্ণ আবহাওয়া শেখ হাসিনা তাঁর দেশে কায়েম করেছেন। এটা কেমন কথা? এই ব্যাপারটি কি মধ্যযুগের কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় না?
এই সপ্তাহে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিউ ইয়র্কে তাঁর ডাহা মিথ্যা দাবী পুনরুল্লেখ করে বলেন— ‘জনগণের ভোটে আমরা ক্ষমতায় আছি।’ ২০১৪ সালের ভোটারবিহীন নির্বাচন, যেখানে ৩০০’র মধ্যে ১৫৪ আসনে তিনি তাঁর মনোনীতদের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতিয়ে নিয়েছেন। সংসদের বাকি অংশ দখল করেছেন ভোটারবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে। ২০১৪ সালের কথিত নির্বাচনের দিন কোনো কোনো কেন্দ্রে কুকুর ভোট দিতে গেছে। সেই দৃশ্য বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচন হয়েছে আরো ভয়াবহ বাস্তবতায়। যেখানে কেন্দ্রে কুকুর যেতে দেখা যায়নি, যেতে পারেনি। কারণ ভোট হয়ে গেছে রাতের বেলা। ভোটে নির্ধারিত সময়ের আগেই ব্যালট ভর্তি বাক্সের ছবি ছেপে দিয়েছিল আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম বিবিসি। এইসব নির্বাচনে সাফল্যের গল্প গর্ব সহকারে প্রধানমন্ত্রী বলে বেড়াচ্ছেন দুনিয়াজুড়ে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ওই ভোটারবিহীন নির্বাচনগুলো সম্পর্কে তাদের অভিন্ন পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করে। তারপরও ঐসব দেশে নির্বাচিত সরকার দাবী করে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ করছেন বারংবার। তবে মুখফস্কে সত্য কথাটিও তাঁর মুখ থেকে কখনো বেরিয়ে পড়ে। নিউ ইয়র্কে দলীয় কর্মীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখার এক পর্যায়ে তিনি বলে ফেলেন— ‘আমরা বৈধ অবৈধ যা-ই হইনা কেনো, আমরা ডিজিটাল করে দিয়েছি বলেইতো তারা বিদেশে বসে আমাদের সমালোচনা করতে পারছে।
বাংলাদেশ ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করেছে এই শতাব্দীর একেবারে গোড়ার দিকে, এ ব্যাপরে পর্যাপ্ত প্রমাণ রয়েছে। শেখ হাসিনার ক্ষমতা গ্রহণেরও কয়েক বছর আগে ২০০৪ সালে কাতারের রাজধানী দোহায় অনুষ্ঠিত ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের বৈঠকে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে তথ্যপ্রযুক্তির যুগে প্রবেশ করেছে — যুক্তরাষ্ট্র সরকারের রেফারেন্সে তা উল্লেখ করা হয়েছিলো। তারপরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলছেন তাঁর সরকারই বাংলাদেশকে ডিজিটালাইজ করেছে। এবার এক পা এগিয়ে বলেছেন, আমরা যে ডিজিটাইজেশন বিশ্বব্যাপী (?) করেছি, তা দিয়ে অন্যরা তার সমালোচনা কেন করছেন? অবশ্য তাঁর পুত্র ও উপদেষ্টা দাবী করেছিলেন তিনি গুগলের আগেই সার্চ ইঞ্জিন আবিষ্কার করেছিলেন, যদিও সেই অসার ও ভিত্তিহীন দাবির পক্ষে কোনো তথ্য প্রমাণ দিতে পারেননি। তথ্যপ্রযুক্তির বিভিন্ন উদ্ভাবন ও উপকরণ (কম্পিউটার, মোবাইল প্রযুক্তি, স্যাটেলাইট প্রযুক্তি) ইউরোপ এবং আমেরিকান বিজ্ঞানী এবং বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর উদ্ভাবন ও সংযোজন। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইউটিউব-ফেসবুক-টুইটার এগুলো যুক্তরাষ্ট্রের অবদান। তাহলে এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকার ও তার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদান কোথায় এটা একটা সত্যের অপলাপ অথবা ভয়াবহ মিথ্যাচার মাত্র!! বিশ্বের সর্বশেষ গরীব দেশটিতেও এখন ডিজিটাল প্রযুক্তি পৌঁছে গেছে। সুতরাং এরকম বড় ধরনের দাবী করার আগে এই সত্যটুকু উপলব্ধি করা একজন দায়িত্বশীল রাজনীতিকের অবশ্যই কর্তব্য।
দশ টাকা দামের চাল আর বিনামূল্যে সারের নিশ্চয়তা দিয়েছিলেন ২০০৮ সালে নির্বাচনের আগে। এসব প্রতিশ্রুতির মাধ্যমেই তিনি ক্ষমতায় এসেছিলেন। সেই দ্রব্যমূল্য এবং কৃষকের স্বার্থের কথা প্রধানমন্ত্রী সবসময় বলে যাচ্ছেন— মতাঁর সরকার এ বিষয়গুলোতে সাফল্যের স্বাক্ষর রেখেছে। সাপ্তাহিক সুরমার কাছে পর্যাপ্ত তথ্য এবং প্রমাণ রয়েছে বর্তমান সময়ে কৃষক তার উৎপাদিত পণ্যের সর্বোচ্চ ৪১ শতাংশ পর্যন্ত দাম পাচ্ছে। ৫৯শতাংশ অর্থাৎ বেশিরভাগ অংশ শুষে নিচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগী আর রাজনৈতিক ফড়িয়া শ্রেণী, যাদের পরিচয় মূলত তারা শাসক দলের লোক। কোটি কোটি কৃষক পাচ্ছেনা তার ফসলের মূল্য, অন্যদিকে ভোক্তারা পরিশোধ করছে আকাশচুম্বী দাম। এইযে কৃষককে বিনামূল্যে সারের কথা বলে বরখেলাপ, এমনকি ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে বছরের পর বছর। আর দশ টাকা চালের কথা বলে দলীয় চেলা চামু-াদের কারণে খাদ্যদ্রব্য’র আকাশচুম্বী মূল্যে উন্নীতকরণ, সত্যের এই অপলাপকে মিথ্যাচার ছাড়া আর কি বলা যায়?
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বারবার বলেছেন, তিনি মদীনা সনদের আলোকে দেশ পরিচালনা করছেন। অথচ তাঁর শাসনামলে কুরআন-হাদীসের বইকে জিহাদী বই দেখিয়ে অনেক মাদ্রাসা ছাত্র ও আলেম ওলামাকে গ্রেফতার, রিমাণ্ড, নির্যাতন করা, এমনকি জঙ্গী নিধনের নামে বিনা বিচারে খুন করা হয়েছে। এদের মধ্যে কতজন অপরাধী আর কতজন নিরপরাধ, তা জানার সম্ভাবনা নিঃশেষ করেছে মদিনা সনদের আলোকে পরিচালিত তাঁর পুলিশ ও প্রশাসন। অথচ মদিনা সনদ উপযুক্ত তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে এবং নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত কোনো অপরাধের বিচারকে নিষিদ্ধ করেছিল। আইয়ামে জাহেলিয়াত থেকে মদিনা সনদ আধুনিক রাষ্ট্র ও শাসন কায়েম করেছিল। বিরোধী দলের সমর্থক, সাংবাদিক, নিরীহ নাগরিক এমনকি সামরিক বেসামরিক যেকোনো মানুষকে যেকোনো অজুহাতে বিনাবিচারে জঙ্গি নিধন আর ক্রসফায়ারের নামে হত্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার বাংলাদেশের সাধারণ রীতিতে পরিণত করেছেন। এই নৃশংসতাকে জায়েজ করতে যেসব দাবী করা হয়, তাকে কি বলা চলে? সম্ভবতঃ এটাই সমকালের সর্বোচ্চ মিথ্যাচার মিথ্যাচার।
ডোনাল্ড ট্রাম্প বর্তমান কালে মিথ্যাচারের জন্য ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছিলেন। তিনি কতবার মিথ্যাচার করেছিলেন, নিউ ইয়র্ক টাইমস এবং ওয়াশিংটন পোস্ট প্রেসিডেন্ট থাকা অবস্থায়ই তার তালিকা প্রকাশ করেছিলো। শেখ হাসিনার মিথ্যাচার সেই রেকর্ডকে ছাড়িয়ে গেছে। সেই বিবেচনায় শেখ হাসিনার মিথ্যাচারই সমকালের সর্বোচ্চ মিথ্যাচার।