পুতিন, রাইসি ও এরদোগানের মধ্যে যতটা দেখা যাচ্ছে, তার থেকে কম মিল রয়েছে

  • ওসামা আল শরীফ
  •  ০১ আগস্ট ২০২২, ১৯:৪৩
পুতিন, রাইসি ও এরদোগানের মধ্যে যতটা দেখা যাচ্ছে, তার থেকে কম মিল রয়েছে – প্রতীকী ছবি

তেহরানে মঙ্গলবারের ত্রিমুখী শীর্ষ সম্মেলন ২০১৯ সালের পর থেকে প্রথম রাশিয়া, তুরস্ক এবং ইরানের নেতাদেরকে একত্র করেছে। আলোচনার টেবিলে একটি বৈচিত্র্যময় অ্যাজেন্ডাসহ অনেক সাধারণ বিষয় রাখা হয়েছিল। বাস্তব এত বৈচিত্র্যময় যে, ভ্লাদিমির পুতিন, রজব তাইয়েব এরদোগান এবং ইব্রাহিম রাইসির সব বিষয়ে সম্মত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে যখন এই তিন নেতা অনেক দূর থেকে অনন্য চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে যাচ্ছেন।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সৌদি আরবের আয়োজনে এবং উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের (জেসিসি) নেতৃবৃন্দ এবং জর্দান, মিসর ও ইরাকের রাষ্ট্রপ্রধানের অংশগ্রহণে জেদ্দায় একটি ব্যতিক্রমধর্মী উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে বসার কয়েকদিন পর তেহরানে বৈঠক অনুষ্ঠিত হলো। জেদ্দা শীর্ষ সম্মেলনের ফলাফল ছিল মার্কিন ইসরাইল দ্বিপক্ষীয় ঘোষণার বিপরীত বাইডেন যখন শীর্ষ সম্মেলনের মাত্র দু’দিন আগে ইসরাইল সফর করেন তখনই ওই দ্বিপক্ষীয় ঘোষণা স্বাক্ষর হয়েছিল। যদিও তথাকথিত জেরুসালেম ঘোষণার মূল উপাদানটি ছিল ইরানকে তার পারমাণবিক কর্মসূচির সামরিকীকরণের অনুমতি না দেয়ার প্রতিশ্রুতি, জেদ্দা থেকে বার্তাটি এমনভাবে উচ্চারিত হয়েছিল যা ইরানের সাথে আরবদের সমঝোতা বা পুনর্মিলনের দরজা খোলা রাখে। ইসরাইলের একটি সদস্য হিসেবে ন্যাটোর ইরানবিরোধী মধ্যপ্রাচ্য সংস্করণের কোনো উল্লেখ ছিল না।

ইরানের নেতৃত্ব জেদ্দা থেকে আসা বার্তাগুলোর গুরুত্ব মূল্যায়ন করবেন। সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান বলেছেন, রিয়াদ তেহরানের প্রতি হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) ঘোষণা করছে যে, তারা ইরানের রাষ্ট্রদূত পাঠানোর বিষয় বিবেচনা করছে।’ সেটাকে তেহরানও স্বাগত জানিয়েছে।

তবে তেহরানের নেতাদের বৈঠকে অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করার ছিল। পুতিন ইরানের সাথে একটি সমন্বিত কৌশলগত চুক্তি স্বাক্ষর করতে চান যার মূল উদ্দেশ্য হলো, মস্কোর ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কমানো এবং আমেরিকাবিরোধী জোট তৈরি করা। তেহরান পুতিনের পক্ষে যতদূর যেতে পারে, তবে পশ্চিমা তেল নিষেধাজ্ঞার অবসান ঘটাতে একটি সুযোগ হারানোর মূল্যে নয়।

ইরানের জন্য যেখানে দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আলি খামেনির ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা, কামাল খাররাজি এই সপ্তাহে ঘোষণা করেছেন যে, তেহরানের একটি পারমাণবিক বোমা তৈরির সামর্থ্য রয়েছে- তবে এটি বেছে নেয়া হচ্ছে না; ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করার সম্ভাবনা হবে বলে আশা করে। এ পর্যায়ে মস্কোর সাথে একটি পশ্চিমাবিরোধী জোট গঠন করলে তা একটি পাকাপাকি চুক্তি সম্পাদনে সহায়তা করবে না।

তবে পুতিনের জন্য আমেরিকার এ ধরনের সমর্থন কোনো রাষ্ট্র থেকে ছেঁটে ফেলার আভাস পাওয়া একটি ভালো বিষয়। কিন্তু এ ধরনের সমর্থনের সীমাবদ্ধতা আছে। তেহরানের জন্য রিয়াদের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার বিশাল ভূরাজনৈতিক মূল্য রয়েছে। এ ধরনের সম্প্রীতি ওই অঞ্চলের বহু সঙ্ঘাতের অবসান ঘটাতে পারে। দিন শেষে আরব উপসাগরীয় রাষ্ট্রগুলোর প্রতিবেশী হিসেবে ইরান তার ভৌগোলিক ভাগ্য সম্পর্কে সচেতন।

একজন বাস্তববাদী নেতা এরদোগানের পক্ষ পরিবর্তন এবং অবস্থান পরিবর্তনের বিষয়ে কোনো দ্বিধা নেই। দুটি মার্কিনবিরোধী দেশে তার উপস্থিতি এবং প্রভাবকে জোরদার করাই তুরস্ককে আঞ্চলিক এবং এর বাইরে একটি প্রধান ভূ-রাজনৈতিক খেলোয়াড় করার জন্য যথেষ্ট। তিনি কয়েক সপ্তাহ ধরে উত্তর সিরিয়ায় বড় ধরনের সামরিক অভিযান চালানোর হুমকি দিয়ে আসছেন। কিন্তু এ ধরনের অভিযানের ব্যাপারে মস্কো ও তেহরানের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান রয়েছে। আঙ্কারা উত্তর সিরিয়ায় কেন একটি ঝুঁকিপূর্ণ সামরিক অভিযানে জড়িত হতে চায়, তা বোঝা কঠিন।

ইরান বলেছে, তারা সিরিয়ার আঞ্চলিক অখণ্ডতাকে হুমকির মুখে ফেলে এমন যেকোনো অভিযানের বিরোধিতা করে। সিরিয়ায় তুরস্কের হস্তক্ষেপে মস্কোও খুশি নয় যেটিকে যে অঞ্চলে তার নিজস্ব ভ‚-রাজনৈতিক প্রভাবের স¤প্রসারণ হিসেবে দেখে। মস্কো যে ইউক্রেনের জলকাদার মধ্যে আটকা পড়েছে তা সিরিয়ার ক্ষমতার ভারসাম্যের যেকোনো গুরুতর পরিবর্তন সম্পর্কে শঙ্কিত করে তোলে।

এ সবের শীর্ষে এটা সত্য যে, বাইডেনের সফরের পরিপ্রেক্ষিতে ইসরাইল তেহরানের দিকে সরাসরি হুমকি দিয়েছে। সোমবার ইসরাইলের সেনাপ্রধান আভিভ কোচাভি বলেছেন, সামরিক বাহিনী ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।

ইসরাইল এবং ইরান বছরের পর বছর ধরে পরোক্ষ যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ইসরাইল যে ইরানের ওপর হামলার কথা বলে, তা কাউকে খুশি করে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয়রা এবং আরব দেশগুলো এই অঞ্চলে আর কোনো অনাকাঙ্ক্ষিত যুদ্ধ দেখতে চায় না। নিশ্চিতভাবে যখন এই অঞ্চলে আরেকটি যুদ্ধ প্রজ্বলিত করার কথা আসে, তখন ইসরাইল সে ক্ষেত্রে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়। অর্থাৎ তাদের মতামতের কোনো সমর্থন পাওয়া যায় না।

যদিও তেহরান শীর্ষ সম্মেলনটি ছবির সুযোগ, কিছু জ্বালাময়ী বক্তব্যের জন্য একটি প্লাটফর্ম এবং একটি চুক্তির চিত্রের পরিপ্রেক্ষিতে অনেক কিছু প্রস্তাব করেছিল, বাস্তবতা হলো, তিন নেতার মধ্যে যা দেখা যায় তার চেয়ে কম মিল রয়েছে। তাদের ব্যক্তিগত অ্যাজেন্ডাগুলো সমন্বয়ের মধ্যে নেই এবং যৌথ চ্যালেঞ্জগুলো এখন আপাতত তাদের একত্রিত করতে পারে। তবে তাদেরকে একসাথে চলতে হলে পরস্পরের ব্যাপারে আরো অনেক বেশি আশাবাদী হতে হবে।

আরব নিউজের সৌজন্যে ভাষান্তর :
মুহাম্মদ খায়রুল বাশার
লেখক : আম্মানের সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক ভাষ্যকার