টাঙ্গাইল শাড়ি কোনোভাবেই ভারতের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হতে পারে না বলে মন্তব্য করেছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সংগঠন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, জিআই পণ্য ভৌগোলিক এলাকার সঙ্গে সম্পর্কিত, কোনো ব্যক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। কাজেই এটি তৈরির কারিগররা স্থানাস্তরিত হলেও পণ্যের জিআই ট্যাগ স্থানান্তর হওয়ার সুযোগ নেই। কাজেই টাঙ্গাইল শাড়ির ওপর বাংলাদেশের নিরঙ্কুশ জিআই স্বত্ব প্রতিষ্ঠায় অবিলম্বে ভারতের আদালতে বাংলাদেশের মামলা করা উচিত বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। ভারতের সংশ্লিষ্ট আইনেই এ সুযোগ রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
রাজধানীর ধানমন্ডিতে সিপিডির নিজস্ব কার্যালয়ে গতকাল ‘টাঙ্গাইল শাড়িকে পশ্চিমবঙ্গের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি: প্রক্রিয়া, পরিস্থিতি ও বাংলাদেশের করণীয়’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান।
ভারতের শিল্প মন্ত্রণালয় সম্প্রতি ‘বাংলার টাঙ্গাইল শাড়ি’ বা ‘টাঙ্গাইল শাড়ি অব বেঙ্গল’ নামে একটি শাড়িকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই উদ্যোগ নিয়ে বাংলাদেশে সমালোচনা হয়। টাঙ্গাইল শাড়ির ব্যবসায়ীসহ জিআই বিশেষজ্ঞ, আইনজ্ঞ ও অধিকারকর্মীরা বলেন, ‘টাঙ্গাইল শাড়ি বাংলাদেশের নিজস্ব পণ্য। ভারতে ‘টাঙ্গাইল’ নামে কোনো এলাকা নেই। তাই ভারতের উদ্যোগ অন্যায্য।’
ভারতে টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই আবেদনের নানা অসংগতি তুলে ধরে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘সেখানে বলা হয়েছে, দেশভাগের সময় টাঙ্গাইল থেকে হিন্দুদের তন্তুবায় সম্প্রদায় দেশত্যাগ করে পশ্চিমবঙ্গের শান্তিপুর ও ফুলিয়া এলাকায় বসবাস শুরু করেন। তারাই এই শাড়ি বানানোর সঙ্গে জড়িত। কাজেই এ শাড়ির স্বত্ব এখন বাংলাদেশ থেকে যাওয়া ভারতীয়দের প্রাপ্য। কিন্তু ভারতের এ দাবি সত্য নয়। টাঙ্গাইলের কেবল হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষরাই এটি তৈরি করতেন না, মুসলিমরাও তৈরি করতেন। আর মুসলিমরা এখনও সেই শাড়ি তৈরি করে চলেছেন। তাছাড়া তাঁতশিল্প কোনো ধর্মভিত্তিক শিল্প নয়, এটি পেশাভিত্তিক শিল্প। কাজেই কেবল হিন্দুরাই এটি তৈরি করতেন, এ কথা সত্য নয়। বাস্তবে টাঙ্গাইল অঞ্চলে দীর্ঘসময় ধরে শুধু হিন্দু নয়, মুসলিম সম্প্রদায়ের অনেকে এই শাড়ি বানিয়ে আসছেন। আর এখন হিন্দুদের চেয়ে এই শাড়ি উৎপাদনের সঙ্গে মুসলিমরাই বেশি জড়িত।’
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, ‘কোনো পণ্যের জিআই স্বীকৃতির সঙ্গে তার ভৌগোলিক উৎস, মান ও সুরক্ষার বিষয় জড়িত। টাঙ্গাইল শাড়ি তৈরির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের অনেকেই দেশ বিভাগের সময় পশ্চিমবঙ্গ চলে গেছেন। কিন্তু এই শাড়ির ভৌগোলিক পরিচয় তো তাতে পাল্টে যেতে পারে না। ভারতে এই শাড়িকে জিআই করতে গিয়ে প্রতারণামূলক তথ্যের আশ্রয় নেয়া হয়েছে।’
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘ভারতের জিআই আইন অনুযায়ী, তাদের এ নিবন্ধনের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ কোনো ব্যক্তি বা সংস্থা তিন মাসের মধ্যে আপত্তি তুলে দেশটির আদালতে মামলা করতে পারে। কাজেই বাংলাদেশের উচিত ভারতের আদালতে গিয়ে মামলা করা। আর সেটা সনদ প্রাপ্তির পরবর্তী মাসের মধ্যে করতে হবে। ভারত পণ্যটির জিআই সনদ দিয়েছে গত ২ জানুয়ারি। কাজেই এর পরবর্তী তিন মাস বা ২ এপ্রিলের আগেই মামলা করতে হবে। এ লক্ষ্যে ভারতের একজন দক্ষ আইনজীবীর সঙ্গে চুক্তি করতে হবে।’ তিনি বলেন, ভারত যেসব যুক্তিতে টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই করেছে, সেগুলো তথ্যনির্ভর নয়। সেগুলো ধোপে টিকবে না। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পাল্লাই ভারী। কিন্তু সে বিষয়টিকে কাজে লাগাতে হবে।
এদিকে ভারতে টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই স্বীকৃতি দেয়ার পর বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো নড়েচড়ে বসে। এরপর দ্রুততার সঙ্গে টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে শাড়ির জিআইয়ের আবেদন করা হয় গত ৬ ফেব্রুয়ারি। আর তা গ্রহণ করে সেদিনই অনুমোদন গেজেটের জন্য বিজি প্রেসে পাঠায় ডিপিডিটি।
এ ধরনের তাড়াহুড়ার সমালোচনা করে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ভারতে টাঙ্গাইল শাড়িকে জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করা হয়েছে ২০২০ সালে। এরপর চার বছর চলে গেছে। এসব তথ্য ওয়েবসাইটেই ছিল। কিন্তু এত দিন ধরে আমাদের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো কী করল? শুধু সরকার নয়, ব্যবসায়িক গোষ্ঠীরাও কেউ কোনো প্রশ্ন তোলেনি। এটা আমাদের অজ্ঞতা ও ব্যর্থতা। কিন্তু এখন যেভাবে তাড়াহুড়া করে এর জিআই করা হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে, তা অমূলক। এত তাড়াহুড়ায় আমরা আবার ভুল করে বসতে পারি।
বাংলাদেশ ও ভারতের কিছু সমনামি এবং অভিন্ন পণ্য আছে। এসব পণ্যের জিআই নিয়ে সতর্কতার সঙ্গে বাংলাদেশকে এগোতে হবে বলে মনে করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি এসব পণ্যের ন্যায্য সুরক্ষার জন্য বেশ কিছু আন্তর্জাতিক আইনের উল্লেখ করেন। এর মধ্যে আছে প্যারিস কনভেনশন ফর দ্য প্রোটেকশন অব ইন্ডাস্ট্রিয়াল প্রোপার্টি (১৮৮৩), মাদ্রিদি এগ্রিমেন্ট অন ইনডিকেটর অব সোর্স (১৮৯১), লিসবনি এগ্রিমেন্ট ফর দ্য প্রোটেকশন অব অরিজিন অ্যান্ড দেয়ার ইন্টারন্যাশনাল রেজিস্ট্রেশন (১৯৫৮) এবং ডব্লিউটিওর বাণিজ্যবিষয়ক মেধাস্বত্ব আইন (ট্রিপস-১৯৯৪)।
sharebiz