এলএনজিতে সামিট বৃহৎ জ্বালানি তেল পরিশোধনাগারে এস আলম

জ্বালানি তেল পরিশোধনাগার চট্টগ্রামভিত্তিক ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের  দ্বিতীয় ইউনিট (ইআরএল-২) নির্মাণে যুক্ত হতে যাচ্ছে এস আলম গ্রুপ। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) ভিত্তিতে। এ নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা চলছে এস আলম গ্রুপের। দেশের গ্যাস খাতের অবকাঠামো ও সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় বড় বিনিয়োগ করছে জ্বালানি খাতের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি সামিট গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির বিনিয়োগে দেশের তৃতীয় ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের বিষয়টি এরই মধ্যে সরকারের নীতিগত অনুমোদন পেয়েছে। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদে এলএনজি সরবরাহ নিয়ে সরকারের সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির একটি চুক্তি এখন চূড়ান্তভাবে সইয়ের অপেক্ষায় রয়েছে।

ইআরএলের দ্বিতীয় ইউনিট নির্মাণ নিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে সম্প্রতি একটি চিঠি ইস্যু করা হয়। চলতি মাসে ইস্যুকৃত ও মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. হাসানুজ্জামান স্বাক্ষরিত ওই চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি) বা এর সাবসিডিয়ারি ইআরএল এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এস আলম গ্রুপ প্রকল্পের কারিগরি ও আর্থিক, বাস্তবায়নের মোডালিটি, বাস্তবায়নোত্তর ব্যবস্থাপনা কৌশল ও ইকুইটি হিস্যাসহ আনুষঙ্গিক সব বিষয় আলোচনার মাধ্যমে নির্ধারণ করবে। যৌথ চুক্তির আওতায় বিপিসির নিজস্ব জমিতে তিন-পাঁচ মিলিয়ন টন ক্ষমতাসম্পন্ন এ রিফাইনারি স্থাপনে এস আলম গ্রুপের সমঝোতা স্মারক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য একটি কমিটি গঠনের কথাও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়। ঐকমত্যে পৌঁছলে দুই পক্ষ একযোগে এসপিভি (স্পেশাল পারপাস ভেহিকল) কোম্পানি গঠন অথবা অন্য কোনো পদ্ধতিতে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে।

বিষয়টি নিয়ে জানতে বিপিসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাৎক্ষণিক কোনো বক্তব্য পাওয়া সম্ভব হয়নি। জ্বালানি বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা হলেও তারা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

তবে প্রকল্পটির বিষয়ে এস আলম গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে কোম্পানির নির্বাহী পরিচালক সুব্রত ভৌমিক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ইআরএল ইউনিট-২ প্রকল্পটি জ্বালানি খাতের বড় একটি প্রকল্প। এটি এগিয়ে নিতে বেসরকারি উদ্যোক্তা হিসেবে এস আলম আগ্রহ দেখিয়েছে। এরই মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ঐকমত্যে পৌঁছানো গেছে। তবে এখনো বিষয়টি দুই পক্ষের আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে। প্রকল্পটি নিয়ে আমরা আশাবাদী।’

প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সময় ধরা হয়েছে ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ২০২৮ সালের জুন পর্যন্ত। ইআরএল ইউনিট-২ নির্মাণ করা গেলে দেশে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের বার্ষিক প্রক্রিয়াকরণ সক্ষমতা দাঁড়াবে ৪৫ লাখ টনে, যা দেশের বিদ্যমান জ্বালানি পরিশোধন সক্ষমতার তিন গুণ।

ইআরএল-২ নির্মাণের সম্ভাব্য ব্যয় এখনো নির্ধারণ করা হয়নি। তবে জ্বালানি বিভাগের এ-সংক্রান্ত আগেকার কিছু প্রাক্কলনে দেখা গেছে, এতে সম্ভাব্য ব্যয়ের পরিমাণ হতে পারে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে এ ব্যয়ের পরিমাণ আরো বেশি হওয়ার কথা বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।

দেশে এখন জ্বালানি তেল পরিশোধনাগার রয়েছে একটি। ইস্টার্ন রিফাইনারির এ পরিশোধনাগারটি নির্মাণ করা হয় স্বাধীনতার আগে ১৯৬৮ সালে। এটির বার্ষিক প্রক্রিয়াকরণ ক্ষমতা বছরে ১৫ লাখ টন। ৫৬ বছর ধরে পরিশোধনাগারটি একনাগাড়ে জ্বালানি তেল পরিশোধন করছে। বর্তমানে বিপিসির বার্ষিক জ্বালানি তেলের (পরিশোধিত ও অপরিশোধিত) চাহিদা ৬০ লাখ টন।

অন্যদিকে বেসরকারি খাতের আরেক জায়ান্ট সামিট গ্রুপ এখন বিদ্যুতের পাশাপাশি এলএনজি খাতে ক্রমেই বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে। দেশের তৃতীয় ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল (এফএসআরইউ) নির্মাণে এরই মধ্যে পেট্রোবাংলার সঙ্গে চুক্তি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। গত বছরের ১৪ জুন অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে (একনেক) এ-সংক্রান্ত প্রস্তাবের নীতিগত অনুমোদনও দেয়া হয়েছে। কোম্পানিটি এখন টার্মিনাল ব্যবহারের জন্য টিইউএ (টার্মিনাল ইউজ অ্যাগ্রিমেন্ট) নিয়ে কাজ করছে।

জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, মহেশখালীতে দৈনিক ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ সক্ষমতার টার্মিনাল নির্মাণ করবে সামিট। বর্তমানে সেখানে সামিটের ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট সরবরাহ সক্ষমতার আরো একটি টার্মিনাল রয়েছে। পরিকল্পনাধীন টার্মিনালটির নির্মাণকাজ শেষ হলে সামিটের দৈনিক এলএনজি সরবরাহের সক্ষমতা দাঁড়াবে ১ হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুটে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সামিট গ্রুপের পরিচালক ফয়সাল করিম খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে অবদান রাখতে আগ্রহী সামিট। আমরা এখন এলএনজির তৃতীয় ভাসমান টার্মিনাল ও সরবরাহ বৃদ্ধি নিয়ে কাজ করছি। বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য আমাদের নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানি অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে।’

এছাড়া দেশে দীর্ঘমেয়াদে এলএনজি সরবরাহের জন্য পেট্রোবাংলার সঙ্গে ১৫ বছর মেয়াদি একটি প্রাথমিক চুক্তি হয়েছে বলে সম্প্রতি বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে নিশ্চিত করেছেন সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজিজ খান। যেকোনো সময় চুক্তিটি আনুষ্ঠানিক ও চূড়ান্তভাবে স্বাক্ষর হতে পারে। এ চুক্তি স্বাক্ষরিত হলে ২০২৬ সাল থেকে পেট্রোবাংলাকে বছরে ১৫ লাখ টন এলএনজি সরবরাহ করবে সামিট।

সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের সাবসিডিয়ারি সামিট করপোরেশন ও জ্বালানি খাতের জাপানি জায়ান্ট প্রতিষ্ঠান জেরা-এশিয়ার মধ্যে গত বছর একটি সমঝোতা চুক্তি সই হয়। ২০০ কোটি ডলারের এ চুক্তির ভিত্তিতে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দীর্ঘমেয়াদে এলএনজি ও অন্যান্য জ্বালানি সরবরাহ, উপকূল ও সমুদ্রতীরের দূরে জ্বালানি সংরক্ষণ ও এফএসআরইউ অবকাঠামো উন্নয়নে যৌথভাবে বিনিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির।

এছাড়া দেশের বিদ্যুৎ খাতে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সামিটই এখন শীর্ষস্থানে রয়েছে। সামিট গ্রুপের অধীন বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর মোট সক্ষমতা প্রায় দুই গিগাওয়াট।

দেশে গ্যাস সরবরাহ কার্যক্রমে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বেড়ে চলাকে ইতিবাচকভাবে দেখছে পেট্রোবাংলা। বিশেষ করে সরবরাহ অবকাঠামোয় বেসরকারি বিনিয়োগ পেট্রোবাংলার কার্যক্রমে বড় ধরনের সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে মনে করে সংস্থাটি।

পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) প্রকৌশলী কামরুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশের গ্যাস খাতের উন্নয়নে পেট্রোবাংলার কোম্পানিগুলোর পাশাপাশি বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ জরুরি। বিশেষ করে আমদানির অবকাঠামোয় বেসরকারি খাত এগিয়ে এলে গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় পেট্রোবাংলার সুবিধা হয়। কারণ এখানে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের বিষয়টি জড়িত। এর বাইরে এলএনজি আমদানিতে বেসরকারি খাত বিনিয়োগ করলেও তার নিয়ন্ত্রণটা কিন্তু পেট্রোবাংলার হাতে। কারণ এখানে আমাদের চাহিদার ওপর নির্ভর করেই বেসরকারি খাত জ্বালানি সরবরাহ করবে।’

বনিক বার্তা