ভারতের অভ্যন্তরে মুসলমান নির্যাতন এবং বিজেপির ইসলাম নির্মূল রাজনীতি

Farhad Mazhar    7 June 2022
রাসুলে করিম (সা) সম্পর্কে নূপুর শর্মার মন্তব্য এবং নবীন জিন্দালের টুইট কাতার, সৌদী আরব ও ইরানে যে প্রতিক্রিয়া ঘটিয়েছে সেটা বিশ্বে ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা বদলের লক্ষণ কি? আমি তাই মনে করি। কিন্তু ভারতের অভ্যন্তরে মুসলমান নির্যাতন এবং বিজেপির ইসলাম নির্মূল রাজনীতির অবসান তাতে ঘটবে না। তবে এর সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যের বাস্তব হুমকি যোগ হোল। এইটুকুই গুরুত্বপূর্ণ।
সরকারি ভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। বলা হয় এবং আমিও বলেছি, মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনী আফগানিস্তানে থেকে কার্যত পরাজিত হয়েই পলায়ন করেছে। তবে ভূ-রাজনীতির দিক থেকে বিচার করলে  ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হবার পরে বোঝা যাচ্ছে কথাটা সরল ভাবে বুঝলে হবে না।
এটা পরিষ্কার চিন ও রাশিয়া ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে পস্পরের ঘনিষ্ঠ হয়েছে।  ইউক্রেন যুদ্ধের আগে ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে দুই বৃহৎ পরাশক্তি জোট বাঁধার ঘোষণা দিয়েছে। এতে প্রমাণিত হয় ভূ-রাজনৈতিক বিন্যাসের যে পরিবর্তন ঘটছে বলে গত একদশক ধরে অনেকে বলছিলেন তার একটা পরিণতি ঘটেছে।  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের  জন্য নতুন ভূ-রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জের উদ্ভব ঘটেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সেটা আগেই টের পেয়ে আফগানিস্তান থেকে সমর সজ্জা গুটিয়ে ইউরোপে — অর্থাৎ ইউক্রেনে মনোনিবেশ করতে বাধ্য হয়েছে। নতুন বাস্তবতায় যুদ্ধবাজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তো বটেই, এমনকি ইউরোপকেও নতুন ভূ-রাজনৈতিক বিন্যাস মোকাবিলা করতে হবে। দোনামোনা ভারতও এই নতুন বিন্যাসের বাইরে থাকতে পারবে না। এই পরিস্থিতিতে ইসলাম ও মুসলিম দেশগুলোর প্রতি মার্কিন নীতি বদলাতে হবে। মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা করা কিম্বা অবনতি ঘটানোর ভালমন্দ নির্ধারিত হবে পরাশক্তি হিশাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পতন এবং চিনের উত্থানের আলোকে, নতুন ভু-রাজনৈতিক বিন্যাসের পরিপ্রেক্ষিতে।
এটা পরিষ্কার রাশিয়া নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে ‘স্পেশাল মিলিটারি অপারেশান’ শুরু করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইউক্রেনে প্রক্সি ওয়ার শুরু করেছে রাশিয়ার বিরুদ্ধে। ভূ-রাজনীতির দ্বন্দ্বে ইউক্রেনের বলিদান চলছে। ইউক্রেনের ন্যাটো যোগদানের খায়েশ এতে কিঞ্চিত কমতে পারে।  নিজের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করবার  শর্ত সমূলে বিনষ্ট না করে রাশিয়া যুদ্ধ ক্ষান্ত দেবে না। রাশিয়া ইউক্রেনে নাৎসিদেরও সাফ করতে চায়। এখন ‘ওয়ার মঙ্গার’  হেনরি কিসিঞ্জার শুধু নয়, জো বাইডেনকেও বলতে হচ্ছে, ইউক্রেনকে কিছু জায়গা ছাড় দিয়ে হলেও রাশিয়া ফেডারেশানের সঙ্গে নিষ্পত্তি করতে হবে। এই হোল অবস্থা! পানি অনেকদূর ইতোমধ্যেই গড়িয়েছে।
রাশিয়া যে বহুকেন্দ্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার কথা বলে, সেখানে ইসলামি বিশ্ব তার ধর্ম, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির স্বীকৃতিসহ  হাজির। সেটা স্রেফ কূটনৈতিক বা কৌশলগত নয়। রুশ দার্শনিক আলেকজান্ডার দুগিনের তত্ত্বে ইসলাম ও ইসলামি সভ্যতা গুরুত্বপূর্ণ। ইউরেশিয়ার পুনর্গঠন মানে ইসলাম ও মুসলিম সভ্যতাকে তার যোগ্য স্বীকৃতি দেওয়া। তার মানে রুশ ও চিনের জোট মোকাবিলার অর্থ একই সঙ্গে ইসলাম প্রধান দেশ বা রাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন সমঝোতা বা মোকাবিলা। দিল্লির ইসলাম ঘৃণা এবং ইসলাম নির্মূল রাজনীতি এই খোপের মধ্যে পড়েছে। দিল্লী এখন নতুন আন্তর্জাতিক বাস্তবতা মোকাবিলা করতে কি করে তার দ্বারা আমরা বুঝব আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক বিন্যাসে দিল্লি কোথায় নিজেকে দাঁড় করাচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মীয় স্বাধীনতা সংক্রান্ত সরকারি প্রতিবেদন প্রকাশ করার পর দেখা যাচ্ছে ভারত তার দেশে মুসলমান ও  খ্রিস্টান নাগরিকদের যেভাবে নিপীড়িন ও অত্যচার করেছে তা আর গণতন্ত্রের জোব্বা দিয়ে লুকানো যাচ্ছে না।
রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের পরিচালক মোহন ভাগবতের কথা আমার আগের একটি পোস্টে বলেছি। তিনি সম্প্রতি নাগপুরে একটি বক্তৃতায় বলেছেন, “হিন্দুরা মুসলমানদের বিরুদ্ধে না”। বেশ, কিন্তু কোন্‌ যুক্তিতে? । কারন তাঁর দাবি মুসলমানদের পূর্বপুরুষ নাকি হিন্দুই ছিল’। কথা ঠিক নয়, কারণ ‘হিন্দু’ আধুনিক কালের নির্মাণ ও পরিচয়। বিষয়টা তর্ক সাপেক্ষ। কিন্তু ইসলাম নির্মূল রাজনীতির ওপর রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের এই প্রলেপ বুলানো ইন্টারেস্টিং। মোহন ভাগবত ২১ মার্চ ২০০৯ সালে সঙ্ঘ পরিচালকের দায়িত্ব পেয়েছেন। তিনি কে.বি. হেডগেওয়ার এবং এম.এস. গোলওয়ালকরের পরে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রধান কিন্তু সর্বকনিষ্ঠ একজন নেতা। ২০১৭ সালে মোহন ভাগবত যখন প্রথম আরএসএস প্রধান হয়েছিলেন তখন সেই সময়ের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রপতি ভবনে তাঁকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। প্রণব বাবুর হিন্দুত্ববাদ তোষণের মধ্যে স্টাইল আছে। সে যাই হোক, সম্প্রতি মোহন ভাগবত  যখন বললেন সব মসজিদের তলায় শিবলিঙ্গ খোঁজা ঠিক না। আমি তাঁর কথাকে উপমহাদেশে নতুন ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার লক্ষণ হিশাবে গণ্য করেছি।
এখন দেখছি পরিস্থিতি আমি যা ভেবেছি, তার চেয়েও দ্রুত বদলাচ্ছে।
নবী মুহাম্মদ (সা) সম্পর্কে দেশটির ক্ষমতাসীন দলের দুই সদস্যের সাম্প্রতিক বিতর্কিত মন্তব্য ভারতকে কঠিন কূটনৈতিক সমস্যায় ফেলেছে।  নুপুর শর্মা,  ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) আনুষ্ঠানিক মুখপাত্র ছিলেন, তিনি একটি টেলিভিশন বিতর্কে রাসুল সম্পর্কে মন্দ মন্তব্য করেছিলেন। নবীন জিন্দাল, বিজেপির দিল্লি ইউনিটের মিডিয়া প্রধান — তিনিও একটি টুইট পোস্ট করেছেন। দুই নেতা জনসমক্ষে ক্ষমা চেয়েছেন এবং বিজেপি  মিসেস শর্মাকে বরখাস্ত এবং মিঃ জিন্দালকে বহিষ্কার করেছে। এইসব নতুন জিনিস!
 কিন্তু এর পরও কূটনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দেওয়া  দিল্লীর জন্য মুশকিল হয়ে পড়েছ।  কুয়েত, কাতার এবং ইরান রবিবার তাদের প্রতিবাদ নথিভুক্ত করার জন্য ভারতীয় রাষ্ট্রদূতদের ডেকেছে । সোমবার সৌদি আরবও বিজেপি নেতাদের মন্তব্যের নিন্দা করেছে। কাতার বলেছে যে তারা ভারতের কাছ থেকে জনসমক্ষে ক্ষমা চায়। কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, “এই ধরনের ইসলামফোবিক মন্তব্যকে শাস্তি ছাড়া চলতে দেওয়া মানবাধিকার সুরক্ষার জন্য গুরুতর বিপদ তৈরি করে। এই ধরণের মন্তব্য ও সহিংসতা ঘৃণার চক্র তৈরি করবে,” । কঠোর অবস্থান!
কাতারে ভারতের রাষ্ট্রদূত দীপক মিত্তাল বলেছেন, নূপুর শর্মা আর নবীন জিন্দাল নাকি  “ফ্রিঞ্জ উপাদান”। তারা  ভারত সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিনিধিত্ব করে না। কিন্তু এতে কাজ হবে মনে হচ্ছে না। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিষয়টি নিয়ে দল ও সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বকে প্রকাশ্যে বিবৃতি দিতে হতে পারে। তারা বলছেন, তা না করলে আরব বিশ্ব ও ইরানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। ঝুঁকির মধ্যে উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের (GCC) সাথে ভারতের বাণিজ্য, যার মধ্যে কুয়েত, কাতার, সৌদি আরব, বাহরাইন, ওমান এবং সংযুক্ত আরব আমিরাত রয়েছে — সেটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই বাণিজ্য ২০২০-২০২১ সালে যা ৮৭  বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। ভারতকে এই বিশাল অংকের বাণিজ্য ঝুঁকির মধ্যে পড়তে হতে পারে। লক্ষ লক্ষ ভারতীয় মুসলিম দেশে ও মধ্য প্রাচ্যে , কাজ করে এবং লক্ষ লক্ষ ডলার রেমিট্যান্স দেশে ফেরত পাঠায়। ভারতের শক্তি আমদানির জন্যও মধ্য প্রাচ্য শীর্ষস্থানীয় উৎস। ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই অঞ্চলের নিয়মিত পরিদর্শক। সেখানে মোচড় ঘটছে। কিন্তু এই প্রতিক্রিয়া দারুন পরিবর্তন ঘটিয়ে দিতে পারে।
ভারতের অভ্যন্তরে মুসলমান বিদ্বেষ ও ইসলাম নির্মূল রাজনীতির  বড় কোন পরিবর্তন ঘটবে কি? সম্ভবত নয়। কিন্তু বৈশ্বিক পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। তার পরিণতি কি দাঁড়ায় তা বোঝার জন্য আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে।