ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) আওতায় নেয়া ঋণে দেশের ১২ জেলায় হাই-টেক পার্ক নির্মাণ করছে সরকার। এলওসি ঋণের শর্তে প্রকল্পে ঠিকাদার-পরামর্শক হিসেবে কোনো ভারতীয় প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেয়ার কথা বলা রয়েছে। একই সঙ্গে বলা হয়েছে এতে ব্যবহৃত মালামালের ৭৫ শতাংশ আনতে হবে ভারত থেকে। তবে ভারতীয় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানসহ সংশ্লিষ্ট নানা পক্ষের আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে হাই-টেক পার্ক নির্মাণ প্রকল্পের জন্য এ শর্ত কিছুটা শিথিল করে ৬৫ শতাংশে নামাতে সম্মত হয়েছে ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান। প্রকল্পটিতে ঠিকাদার হিসেবে নিয়োগ পেয়েছে ভারতীয় প্রতিষ্ঠান লারসেন অ্যান্ড টুব্রো (এলঅ্যান্ডটি)। প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা বলছেন, স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ না করে এসব মালামাল ভারত থেকে আনতে গেলে খরচ ও সময়—দুটোই ব্যাপক মাত্রায় বেড়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় ঋণের শর্ত পরিবর্তন বা আরো শিথিল করে বাংলাদেশ থেকেই অধিকাংশ মালামাল সংগ্রহ করতে দেয়া প্রয়োজন।
প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) অনুমোদন পায় ২০১৭ সালে। এটি শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০২১ সালে। সময় বাড়তে বাড়তে এরই মধ্যে তিন বছরের প্রকল্প গড়িয়েছে সাত বছরে। অগ্রগতি হয়েছে ১৫ শতাংশ। যদিও এরই মধ্যে প্রকল্পের জন্য নেয়া ঋণের অর্থ পরিশোধ শুরু হয়ে গেছে। বর্তমানে দ্বিতীয় দফায় সংশোধন করে প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৭ সাল পর্যন্ত বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে। এতে ব্যয় বাড়ছে ১২৭ শতাংশ। মোট প্রকল্প ব্যয় অনুমোদিত ১ হাজার ৭৯৬ কোটি টাকা থেকে দ্বিগুণের বেশি বেড়ে দাঁড়াতে যাচ্ছে ৪ হাজার ১৯৭ কোটি টাকায়। এটি বারবার পিছিয়ে পড়ার কারণ হিসেবে প্রধানত প্রকল্পে ব্যবহার্য মালামালের উৎস নিয়ে বিতর্ককে দায়ী করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হচ্ছে ভারতের দ্বিতীয় এলওসিতে পাওয়া ঋণ সহায়তায়। শুরুতে এটিতে ৭৫ শতাংশ মালামাল ভারত থেকে আনার শর্ত ছিল। কিন্তু অনুমোদনের পর বারবার দরপত্র আহ্বান করেও দীর্ঘদিন এতে কোনো ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের সাড়া পাওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠানগুলোর দাবি ছিল, শর্ত শিথিল করে অন্তত ৫০ শতাংশ মালামাল স্থানীয়ভাবে এবং বাকিটা ভারত থেকে সংগ্রহের সুযোগ দিতে হবে। যদিও বিষয়টি নিয়ে নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকে ভারতের ঋণদাতা প্রতিষ্ঠান এক্সিম ব্যাংক। পরে দুই দেশের মধ্যে আলোচনার ভিত্তিতে শর্ত কিছুটা শিথিল করে ভারত থেকে মালামাল আমদানির হার ৬৫ শতাংশে নামিয়ে আনার উদ্যোগ নেয়া হয়। এ বিতর্কে প্রকল্পের দরপত্র জমা দেয়ার সময় পেছানো হয়েছে ১০ বার।
লারসেন অ্যান্ড টুব্রোর কর্মকর্তারা বলছেন, প্রকল্পের শতভাগ মালামাল বাংলাদেশ থেকে সংগ্রহ করতে পারলে তাদের ভালো হতো। কিন্তু এলওসির আওতায় গৃহীত প্রকল্পগুলোয় ৭৫ শতাংশ মালামাল ভারত থেকে আমদানির শর্তটি নিয়ে এলঅ্যান্ডটিসহ অন্য ঠিকাদারদের আপত্তি রয়েছে। ৬৫ শতাংশেও তাদের জন্য প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া ব্যয়বহুল ও দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে।
এলঅ্যান্ডটির প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশে ১২ জেলায় হাই-টেক পার্ক নির্মাণ প্রকল্পের ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন রানা ধর। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকেই সব পণ্য ব্যবহার করতে পারলে আমাদের সবচেয়ে বেশি ভালো হতো। কিন্তু চুক্তির শর্ত থাকায় ভারত থেকে আমাদের পণ্য আনতে হয়। এতে আমাদের ব্যয়ও বাড়ে। কিন্তু নির্মাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে এ বিষয়ে মতামত দেয়া ছাড়া আমাদের কিছু করার নেই। ভবিষ্যতে ভারত থেকে আমদানির পরিমাণ কমিয়ে আনা হলে আমাদের জন্যও ভালো হবে। বর্তমানে আটটি জেলায় পুরোদমে কাজ শুরু হলেও চারটি জেলায় এখন কাজ প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।’ প্রকল্পের ঋণের কিস্তি এরই মধ্যে পরিশোধ করতে শুরু করেছে বাংলাদেশ। যদিও প্রকল্পের নথিপত্রের তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত এর আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ১৫ শতাংশ। প্রকল্পটির আর্থিক ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০১৮ সালের রেট শিডিউলে। কিন্তু সময়মতো শুরু করতে না পারায় এখন অনুসরণ করতে হচ্ছে ২০২২ সালের রেট শিডিউল। এর সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে পরামর্শক, কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা, ভ্যাট-ট্যাক্স ও আনুষঙ্গিকসহ প্রকল্পের সামগ্রিক ব্যয়ও। ফলে সরকারের অর্থায়ন ২৫২ কোটি টাকা থেকে বেড়ে দাঁড়াচ্ছে ১ হাজার ৭৪৬ কোটি টাকায়। এ অনুযায়ী প্রকল্পটিতে শুধু বাংলাদেশ সরকারেরই ব্যয় বেড়েছে ৫৭৮ শতাংশ।
তবে বর্তমানে প্রকল্পের কাজ পুরোদমে এগোচ্ছে বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রকল্প পরিচালক একেএএম ফজলুল হক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমার আগে আরো তিনজন প্রকল্প পরিচালক ছিল। আমি ২০২০ সালের নভেম্বরে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করি। তখন পুনরায় দরপত্র আহ্বানের কার্যক্রম চলমান ছিল। ২০২১ সালে আমরা আবার দরপত্র আহ্বান করি। পরে ২০২২ সালের শেষ দিকে কাজ শুরু হয়। সে হিসেবে এখন পর্যন্ত সোয়া এক বছরের মতো কাজ হয়েছে প্রকল্পে। এখন পর্যন্ত আটটি জেলায় প্রকল্পের ২৫ শতাংশ কাজ হয়েছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘চুক্তিতে ৭৫ শতাংশ মালামাল ভারত থেকে আনার কথা বলা রয়েছে। আবার ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোই বলছে, ভারত থেকে মালামাল এনে কাজ করলে তাদেরও ব্যয় বেশি হয়। তাই আমরা সবাই চেয়েছিলাম যাতে এ শর্ত শিথিল করে ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনা যায়। এটি করা যায়নি। পরে ১০ শতাংশ কমিয়ে ভারতীয় মালামাল ৬৫ শতাংশ করার সিদ্ধান্ত হয়। এতেও অনেক সময় চলে গেছে।’
প্রকল্পটি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এর সিংহভাগ কাজই অবকাঠামো নির্মাণ সংক্রান্ত। অর্থাৎ প্রকল্পের আওতায় আটটি জেলায় সাততলা ও পাঁচতলা ভবন নির্মাণ করা হবে। তিন জেলায় নির্মিত হবে তিনতলা ডরমিটরি। ছয় জেলায় থাকবে সিনেপ্লেক্স ভবন। পাশাপাশি প্রকল্প এলাকার ভূমি উন্নয়ন, রাস্তা নির্মাণ ও বাউন্ডারি নির্মাণের মতো কাজও এর অন্তর্ভুক্ত।
এর সিংহভাগই এখনো বাস্তবায়নের অপেক্ষায়। যদিও প্রকল্পের ঋণ পরিশোধের জন্য পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ডও অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। ২০২১ সালে প্রকল্পটির প্রথম সংশোধনী প্রস্তাবের মূল্যায়ন সভায় অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, প্রকল্পটির জন্য ২০১৮ সালের অক্টোবরে ভারত প্রথম অর্থছাড় করেছিল। সে হিসেবে ২০২৩ সালের অক্টোবরে গ্রেস পিরিয়ড শেষ হয়। এর পর থেকেই প্রকল্পের কাজ সেভাবে না এগোলেও এর জন্য ঋণ পরিশোধ শুরু হয়ে গেছে।
এ বিষয়ে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে ইআরডির এক কর্মকর্তা বলেন, ‘গ্রেস পিরিয়ড শেষ হলে ঋণ পরিশোধ শুরু করতেই হয়। আর ৭৫ শতাংশ মালামাল ভারত থেকে আমদানির বিষয়টি নীতিগত। এটি নিয়ে আলাপ হচ্ছে। সামনে হয়তো তা আরো কমিয়ে আনা হবে।’
প্রকল্পের বিষয়ে কথা বলতে যোগাযোগের চেষ্টা করেও ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক এমপির কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
প্রসঙ্গত, ভারত বাংলাদেশকে এলওসির আওতায় ঋণ সহায়তা দিচ্ছে ২০১০ সাল থেকে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিতীয় এলওসি চুক্তি সই হয় ২০১৬ সালে। এর পরের বছর ২০১৭ সালে হয় তৃতীয় এলওসি চুক্তি। এসব চুক্তির আওতায় বাংলাদেশকে ৭৩৬ কোটি ২০ লাখ ডলার ঋণ দেয়ার কথা রয়েছে দেশটির। এর মধ্যে গত জুন পর্যন্ত ছাড় হয়েছে ১৪৮ কোটি ৯০ লাখ ডলার। নানাবিধ জটিল ও কঠোর শর্তের কারণে এ ঋণের অর্থ ছাড়ও বেশ ধীরগতিতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন মনে করছেন, ঋণ চুক্তি সংশোধন করে ভারত থেকে মালামাল আনার বাধ্যবাধকতা ৭৫ শতাংশের পরিবর্তে ৩০-৪০ শতাংশ করা উচিত। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘এসব শর্ত হলো দ্বিপক্ষীয় ঋণের বিপদ। এর ফলে ক্রয়ের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকে না। আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠানও কাজ পায় না। এমনিতেই এলওসি ঋণের প্রকল্প বাস্তবায়নের হার খুবই কম। এর গতি বাড়াতে হলেও চুক্তি সংশোধন প্রয়োজন।’
এলওসির কঠিন শর্তের কারণে ভারতীয় ঋণের প্রতি এখন সরকারেরও আগ্রহ কমছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, দেশের স্বার্থে ভারত থেকে কঠিন শর্তের টাইট লোন না নেয়াই ভালো হবে। দ্বিপক্ষীয় ঋণের এ ধরনের শর্তের কারণে অনেক ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মানের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া সম্ভব হয় না। আবার ক্রয়ের স্বাধীনতাও থাকে না বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। আর এলওসি ঋণের প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের হার এমনিতেই কম। এ অবস্থায় ঋণের শর্ত সংশোধনের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ভারত অত্যন্ত কড়া শর্তে ঋণ দিয়ে থাকে। সিংহভাগ মালামাল সেখান থেকে আনার শর্তটি বেশ কঠিন একটি শর্ত। আবার এমন শর্ত ছাড়া তারা ঋণও দেয় না। এত কঠিন শর্তে টাইট লোন না নেয়াটাই দেশের জন্য ভালো হবে।’
ভবিষ্যতে এলওসি ঋণের শর্ত শিথিল হবে কিনা জানতে ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
Bonik Barta