ভাই–বোন, শ্যালক–শ্যালিকাকে পাঠানো প্রবাসী আয়েও কর

ভাই–বোন, শ্যালক–শ্যালিকাকে পাঠানো প্রবাসী আয়েও কর

এখন ঈদের মৌসুম। কোরবানির পশুর পাশাপাশি অন্য কেনাকাটাও চলছে। ধরুন, কারও ভাই কানাডা থেকে পরিবারের সদস্যদের জন্য জামাকাপড়সহ অন্যান্য উপহার কিনতে ৫০০ ডলার পাঠালেন। ব্যাংক হিসাবে এই অর্থ এল। কিন্তু এই ‘উপহার’ নিতে প্রাপককে মূল্য দিতে হবে। কারণ, এই অর্থ তাঁর আয় হিসেবে বিবেচিত হবে, এর ওপর কর দিতে হবে। এই করহার সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ।

নতুন বাজেটের প্রস্তাব অনুযায়ী, স্বামী-স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে ও মা-বাবা ছাড়া আর কেউ কোনো উপহার দিলে তার ওপর কর বসবে। এমনকি নগদ অর্থ দিলেও কর আরোপ হবে। উপহার পেলে বছর শেষে আয়কর রিটার্নে করদাতাকে তা দেখাতে হবে। এমনকি উপহারদাতাকেও তাঁর রিটার্নে উপহার দেওয়ার বিষয়টি জানাতে হবে। প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স উপহার হিসেবে এলে তা-ও করের আওতায় পড়বে।

সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, কুয়েতসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ রেমিট্যান্স হিসেবে দেশে আসে। মালয়েশিয়া থেকেও অনেক রেমিট্যান্স আসে। দেখা গেছে, ছেলে-মেয়ে, স্বামী-স্ত্রী বা মা-বাবার ব্যাংক হিসাব ছাড়াও অনেক প্রবাসী ভাই-বোন, শ্যালক-শ্যালিকাসহ আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের ব্যাংক হিসাবেও বিপুল অর্থ রেমিট্যান্স হিসেবে পাঠিয়ে থাকেন।

গ্রামগঞ্জে অনেক বয়স্ক মা-বাবার ব্যাংক হিসাব থাকে না, ছেলে-মেয়ে নাবালক হয় কিংবা স্ত্রীও ব্যাংক হিসাব খোলেন না। ফলে প্রবাসী আয় পাঠানোর ক্ষেত্রে অনেক সময় ভরসা হয়ে দাঁড়ায় ভাইবোন-বন্ধুবান্ধবসহ আত্মীয়স্বজনের ব্যাংক হিসাব। এ অর্থ বৈধ চ্যানেলেই আসে।

কিন্তু ছেলে-মেয়ে, স্বামী-স্ত্রী বা মা-বাবার বাইরে ভাইবোন-বন্ধুবান্ধব বা আত্মীয়স্বজনের ব্যাংক হিসাবে প্রবাসী আয় এলে তা ওই ব্যক্তির (প্রাপক) মূলধনি আয় হিসেবে বিবেচিত হবে এবং নতুন বাজেটে অনুযায়ী তা করযোগ্য হবে। তবে ওই ব্যক্তিকে করের আওতায় থাকতে হবে। এই আয়কে উপহার হিসেবে ধরা হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) প্রস্তাবে এ কথা বলা আছে।

এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রবাসী শ্রমিকেরা তাঁদের ভাই-বোন, বন্ধুবান্ধবের কাছে রেমিট্যান্স পাঠান। এটি আমাদের বাস্তবতা। রেমিট্যান্সের অর্থে কর নেই। কিন্তু এনবিআরের নতুন প্রস্তাবে উপহারের যে মারপ্যাঁচ, তা রেমিট্যান্স নিয়ে সরকারের সার্বিক নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এনবিআরের এই উদ্যোগ পরিস্থিতি জটিল করবে।’

এনবিআরের ব্যাখ্যা নেই

এনবিআরের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তার কাছে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, নতুন প্রস্তাব অনুসারে, নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের বাইরের মানুষের কাছে পাঠানো এ ধরনের রেমিট্যান্স মূলধনি আয় হিসেবে বিবেচিত হবে। এটি উপহার হিসেবে পেলেও তা করযোগ্য। কর আরোপ না করার উপায় হলো, যিনি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন, তাঁকে তা নিজের অর্থ হিসেবে দেখাতে হবে। যিনি পেয়েছেন, তাঁকে রিটার্নে তা দায় হিসেবে দেখাতে হবে। তাহলেই কেবল কর থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।

আয়করের দৃষ্টিকোণ থেকে এর মানে হলো, কোনো ব্যক্তি যদি বিদেশে থাকা ভাইবোন, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধবের কাছ থেকে নগদ অর্থ পান, তাহলে এর ওপর কর বসবে। কর এড়াতে যিনি পাঠিয়েছেন, তাঁকে ঘোষণা দিতে হবে এই অর্থ তাঁর। তিনি এই অর্থ ঋণ হিসেবে দিয়েছেন কিংবা ওই ব্যক্তির কাছে গচ্ছিত রেখেছেন।

বাংলাদেশে রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ের ওপর কোনো কর আরোপ নেই। তাই নতুন বাজেটে রেমিট্যান্সের অর্থের ওপর করারোপের বিষয়টি পরিষ্কার নয়। এ বিষয়ে এনবিআর থেকে এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি। এনবিআর কর্মকর্তারা জানান, করের পরিপত্র জারির সময় বিষয়টি পরিষ্কার করা হতে পারে।

এনবিআরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এখন ব্যাংক হিসাব খোলা খুব সহজ বিষয়। ব্যাংক হিসাব থাকলে মা-বাবা, স্বামী-স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে—যার কাছেই অর্থ পাঠানো হবে, তিনিই যেন সরাসরি সেই অর্থ পান, সেটা নিশ্চিত হবে।

আহসান এইচ মনসুর এ ব্যাপারে পরামর্শ দিয়ে বলেন, যিনি বিদেশ থেকে ভাইবোন, বন্ধুবান্ধব, শ্যালক-শ্যালিকাসহ দেশে থাকা আত্মীয়স্বজনের কাছে নিয়মিত অর্থ পাঠাবেন, তাঁরা একসঙ্গে একটি যৌথ ব্যাংক হিসাব খুললেই হবে। আরেকটি উপায় হতে পারে, স্ত্রীর ব্যাংক হিসাব না থাকলে হয়তো একজন প্রবাসী শ্রমিক তাঁর ভাই কিংবা শ্যালকের কাছে অর্থ পাঠাতে পারেন। তারপর সেই অর্থ তাঁর স্ত্রীর কাছে পৌঁছে দিলেই হবে। এ জন্য অবশ্য লিখিত দলিল থাকা প্রয়োজন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে, প্রতিবছর বৈধ চ্যানেলে দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার কোটি ডলার প্রবাসী আয় দেশে আসে। এ ছাড়া হুন্ডির মাধ্যমে বা অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশ থেকে দেশে আসে।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১১ লাখ ২৫ হাজার ৮৩৩ জন কর্মী চাকরি নিয়ে বিভিন্ন দেশে গেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রায় সাড়ে ৪ লাখ কর্মী গেছেন সৌদি আরবে। সব মিলিয়ে এখন প্রবাসে বাংলাদেশির সংখ্যা প্রায় ১ কোটি।

prothom alo

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here