ইসমাইল আলী: প্রতি মাসে বিদ্যুৎ বিক্রি করে গড়ে তিন হাজার ৬০০ কোটি টাকা লোকসান গুনছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এ ঘাটতি পূরণে চলতি অর্থবছর ভর্তুকি দরকার ৪৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় বরাদ্দ রেখেছে ৩৫ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া গত অর্থবছরের বকেয়া ভর্তুকি রয়েছে আরও ৩০ হাজার ৭৩৭ কোটি টাকা। ফলে ভর্তুকি দিয়ে পিডিবির ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য ১১ দফা বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি শূন্য করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে।
ভর্তুকির চাপ গত কয়েক বছর ধরে বাড়তে থাকায় এ থেকে বের হতে চাচ্ছে সরকার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের শর্তও রয়েছে ভর্তুকি শূন্যে নামিয়ে আনা। এজন্য মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগ। সম্প্রতি আইএমএফের সঙ্গে বৈঠকে এ পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়। বৈঠকে জানানো হয়, ঘাটতি মেটাতে ২০২৭ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ১১ বার বাড়ানো হবে বিদ্যুতের দাম। তবে গ্রীষ্ম নয়, বরং শীতের সময় বিশেষত নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি করা হবে। এক্ষেত্রে প্রতিবারই পাঁচ শতাংশ হারে দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিতে জনগণের খরচ বেড়ে যায়। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখে। গ্রীষ্মে স্বাভাবিকভাবেই বিদ্যুতের গড় ব্যবহার বেড়ে যায়। ওই সময় বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করা হলে তা গ্রাহকের খরচ অনেক বাড়িয়ে দেবে। মূলত গ্রাহকের খরচের চাপ বিবেচনায় নিয়েই গ্রীষ্মের পরিবর্তে শীতে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। এতে শীতে তুলনামূলক খরচ কম বাড়বে। মূল্যস্ফীতিতেও খুব একটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না।
আইএমএফের সঙ্গে বৈঠকে জানানো হয়, বাল্ক বিদ্যুতের মূল্যহার গত ফেব্রুয়ারিতে গড়ে পাঁচ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এতে বাল্ক বিদ্যুতের দাম পড়ছে ভারিত গড়ে সাত টাকা চার পয়সা। যদিও বর্তমানে প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের বাল্ক সরবরাহ মূল্য প্রায় ১১ টাকা ৯৬ পয়সা। অর্থাৎ প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ বিক্রিতে পিডিবির লোকসান হচ্ছে চার টাকা ৯২ পয়সা।
অন্যদিকে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম গত ফেব্রুয়ারিতে গড়ে আট দশমিক ৪৮ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এতে বিদ্যুতের খুচরা মূল্যহার পড়ছে ভারিত গড়ে আট টাকা ৯৫ পয়সা। এছাড়া ডিমান্ড চার্জ ও অন্যান্য সেবা ফি গড়ে ২০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে ফেব্রুয়ারিতেই। এতে বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানিগুলোর ঘাটতি প্রায় পূরণ হয়ে গেছে। তবে বাল্ক পিডিবির ঘাটতি পূরণে অর্ধপ্রান্তিক (দেড় মাস) বা প্রান্তিক (তিন মাস) অথবা ষাণ¥াসিক (ছয় মাস) অন্তর অন্তর বাল্ক ও সে অনুপাতে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো উচিত।
আইএমএফের কাছে এ-সংক্রান্ত একটি পরিকল্পনাও তুলে ধরা হয়। এতে দেখা যায়, আগামী নভেম্বরে বাল্ক বিদ্যুতের গড় দাম বাড়বে পাঁচ শতাংশ তথা ৩৫ পয়সা। এতে প্রতি ইউনিট বাল্ক বিদ্যুতের দাম পড়বে ভারিত গড়ে সাত টাকা ৩৯ পয়সা। ডিসেম্বরে বাড়বে আরও পাঁচ শতাংশ তথা ৩৭ পয়সা। এতে প্রতি ইউনিট বাল্ক বিদ্যুতের দাম পড়বে ভারিত গড়ে সাত টাকা ৭৬ পয়সা।
আগামী বছর জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতেও পাঁচ শতাংশ হারে বাড়বে দাম। এতে জানুয়ারিতে বাল্ক বিদ্যুতের দাম বাড়বে ভারিত গড়ে ৩৯ পয়সা ও ফেব্রুয়ারিতে ৪১ পয়সা। ওই দুই মাসে প্রতি ইউনিট বাল্ক বিদ্যুতের দাম বেড়ে দাঁড়াবে যথাক্রমে ভারিত গড়ে আট টাকা ১৫ পয়সা ও আট টাকা ৫৬ পয়সা। এরপর মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আর দাম বাড়বে না।
আগামী বছর নভেম্বরে আবারও বাল্ক বিদ্যুতের গড় দাম বাড়বে পাঁচ শতাংশ তথা ৪৩ পয়সা। এতে প্রতি ইউনিট বাল্ক বিদ্যুতের দাম পড়বে ভারিত গড়ে আট টাকা ৯৯ পয়সা। একই বছর ডিসেম্বরে বাড়বে আরও পাঁচ শতাংশ তথা ৪৪ পয়সা। এতে প্রতি ইউনিট বাল্ক বিদ্যুতের দাম পড়বে ভারিত গড়ে ৯ টাকা ৪৩ পয়সা।
পরের বছর অর্থাৎ ২০২৬ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতেও পাঁচ শতাংশ হারে বাড়বে বাল্ক বিদ্যুতের দাম। এতে জানুয়ারিতে বাল্ক বিদ্যুতের দাম বাড়বে ভারিত গড়ে ৪৮ পয়সা ও ফেব্রুয়ারিতে ৪৯ পয়সা। ওই দুই মাসে প্রতি ইউনিট বাল্ক বিদ্যুতের দাম বেড়ে দাঁড়াবে যথাক্রমে ভারিত গড়ে ৯ টাকা ৯১ পয়সা ও ১০ টাকা ৪০ পয়সা। এরপর মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত আর দাম বাড়বে না। ওই বছর নভেম্বর ও ডিসেম্বরে বাল্ক বিদ্যুতের গড় দাম বাড়বে পাঁচ শতাংশ হারে। এতে নভেম্বরে দাম বাড়বে ৫২ পয়সা ও ডিসেম্বরে ৫৫ পয়সা। এতে ২০২৬ সালের নভেম্বরে প্রতি ইউনিট বাল্ক বিদ্যুতের দাম পড়বে ভারিত গড়ে ১০ টাকা ৯২ পয়সা ও ডিসেম্বরে ১১ টাকা ৪৭ পয়সা। আর ২০২৭ সালের জানুয়ারিতে আরও পাঁচ শতাংশ তথা ৫৭ পয়সা বাড়বে বাল্ক বিদ্যুতের দাম। এতে জানুয়ারিতে বাল্ক বিদ্যুতের দাম বেড়ে দাঁড়াবে ভারিত গড়ে ১২ টাকা ০৪ পয়সা।
বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বিদ্যমান হারের চেয়ে কিছুটা বাড়লেও ১১ দফায় পাঁচ টাকা বৃদ্ধির ফলে এ খাতে ভর্তুকি শূন্যে নেমে আসবে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ গত ফেব্রুয়ারিতে সাংবাদিকদের এ ধরনের আভাস দিয়েছিলেন। সে সময় তিনি বলেছিলেন, উৎপাদন খরচের চেয়ে এখন অনেক কম দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করা হয়। ঘাটতি মেটাতে দাম সমন্বয় করা হচ্ছে। আগামী তিন বছর ধরে ধাপে ধাপে দাম সমন্বয় করা হবে। এর মাধ্যমে বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি কমিয়ে আনা হবে।
যদিও বিদ্যুৎ খাতে উচ্চ ভর্তুকির জন্য সরকারের ভুল পরিকল্পনাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ প্রসঙ্গে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম শেয়ার বিজকে বলেন, ভর্তুকি কমাতে দাম না বাড়িয়ে বরং দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও সঠিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ কমানো সম্ভব। তিনি বলেন, বিকল্প তো ছিলই। আইনের চোখে অন্যায় ও অযৌক্তিক ব্যয়বৃদ্ধি প্রতিরোধ করলেই হতো। সরকার সে পথে হাঁটেনি। যখন-তখন বিদ্যুতের দাম বাড়ানো ভোক্তার ওপর জুলুমের শামিল।
অধ্যাপক শামসুল আলম আরও বলেন, বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সময় তারা ভোক্তাদের জিজ্ঞেস করে না। বিইআরসি বা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি আইন তো বহাল আছে। গণশুনানির মাধ্যমে দাম বাড়ালে জনগণ জানতে পারত সরকার কোন খাতে কী খরচ করেছে, কেন সরকারকে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। গণশুনানিতে ক্যাবের পক্ষ থেকে কয়েকবারই অপ্রয়োজনীয় খরচের খাতগুলো চিহ্নিত করে দেখানো হয়েছে। সেগুলো বাদ দিলে দাম বাড়ানোর পরিবর্তে উল্টো কমানো সম্ভব বলেও প্রস্তাবনা দেয় ক্যাব। তবে তা কখনোই সরকার আমলে নেয়নি। বরং সহজ পন্থায় দাম বৃদ্ধির মাধ্যমে খরচের বোঝা জনগণের কাঁধে চাপানো হয়েছে।
share biz