ভয়াবহ দুর্যোগের দিকে অগ্রসর হচ্ছে আমাদের অর্থনীতি

বণিক বার্তা

ছবি : বণিক বার্তা

আবু আহমেদ


বাংলাদেশের অর্থনীতির অধিকাংশ সূচক দীর্ঘকাল ধরেই নিম্নমুখী। গত দুই বছরের চিত্র এমন কথাই বলে। জিডিপি প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগ, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার, মূল্যস্ফীতি, লেনদেন ভারসাম্য (বিওপি), আর্থিক হিসাব ও চলতি হিসাব প্রভৃতি দুই বছর ধরেই নিম্নগামী হওয়ায় আমাদের অর্থনীতির গতি বেশ শ্লথ।

গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে বিদেশী কনট্রাক্টরদের অর্থ এখনো পরিশোধ করা সম্ভব হয়নি। এদিকে বিদেশী এয়ারলাইনসগুলো আমাদের থেকে অর্থ পাবে। বিদেশ থেকে আমরা যে বিদ্যুৎ আমদানি করছি, সেক্ষেত্রেও কিছু অংশ বকেয়া পড়ছে। এগুলো তো বাংলাদেশকে শোধ করতে হবে। আর শোধ করতে গেলে বাংলাদেশের রিজার্ভের ওপর যে চাপ পড়বে, তাতে রিজার্ভের বর্তমান অবস্থা ধরে রাখা সম্ভব হবে না।

আরেকটি ভাববার বিষয় হচ্ছে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলারের যে বৈদেশিক ঋণ বাংলাদেশের আছে, সামনের দিনগুলোয় সেগুলোর কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়ে যাবে। তখন যদি সময়মতো পরিশোধ করতে না পারা যায় তাহলে একটা সময় সুদসহ পরিশোধ করতে হবে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার জোগানের যা অবস্থা তাতে সে রকম পরিস্থিতি দেখা দিলে সরকার কুলিয়ে উঠতে পারবে না। অর্থনীতির তত্ত্ব অনুযায়ী, এই অবস্থায় বাংলাদেশের টাকার মান বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে আরো কমতে থাকবে।

গত দুই সপ্তাহজুড়ে বাংলাদেশে যেসব ঘটনা ঘটেছে তাতে দেশ অর্থনৈতিকভাবে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর প্রভাব সামনের দিনগুলোয়ও দেখা যাবে। যদিও প্রতিদিন ঠিক আমরা কত মিলিয়ন ডলার হারাচ্ছি তা ব্যবসায়ী ও বাংলাদেশ ব্যাংক ভালো বলতে পারবে। তবে এটুকু বলা যায় এরই মধ্যে আমরা অনেক মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার হারিয়েছি এবং হারাচ্ছি।

পাশাপাশি বাংলাদেশে বিদেশী দেশগুলোর অর্ডার কমেছে। দেশে ইন্টারনেট না থাকায় গ্লোবাল সিস্টেম থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। বিদেশীরা নিশ্চয়ই এখন বাংলাদেশের পরিবর্তে অর্ডারের জন্য অন্য দেশগুলোয় ঝুঁকছে। অন্যদিকে ইন্টারনেট না থাকায় বাংলাদেশ থেকে যারা ফ্রিল্যান্সিং কাজের সঙ্গে জড়িত এবং যেসব আইটি বিশেষজ্ঞ বিদেশীদের সেবা দিয়ে থাকেন তারা তাদের কাজ চালিয়ে যেতে পারছেন না। এতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যে বড় ধরনের ক্ষতি হবে তা দুই সপ্তাহের হিসাব করলেই জানা যাবে।

নির্বাচনের আগে আমাদের দেশে রাজনৈতিক সংঘাত-সংঘর্ষেও মানুষের প্রাণহানী হয়েছে। তার কয়েক মাস পর কোটা সংস্কারের এই আন্দোলনকে ঘিরে যে শতাধিক নিহতের ঘটনা ঘটল, তা নিশ্চয়ই বিদেশীরা বেশ ভালোভাবেই লক্ষ্য করছেন। এতে তাদের কাছে অস্থিতিশীলতা বা হাঙ্গামার দেশ হিসেবে বাংলাদেশ প্রতীয়মান হতেই পারে। এসব রাজনৈতিক সমস্যা থেকেই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উদ্ভূত হচ্ছে অর্থনৈতিক সমস্যা। রাজনৈতিক সংকট তো আগে থেকেই ছিল। বর্তমানের এই সংকটও যুক্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি যে কবে ঠিক হবে তা এখন ভাবার বিষয়। সংঘর্ষ, ধরপাকড়, জেল-জরিমানা বিষয়গুলো অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের বোঝা যা বরাবরই অর্থনীতির ঘাড়ে চেপে বসে। দেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা বাড়তে থাকলে পুঁজি পাচারও বাড়ে। ফলে ২-৩ শতাংশ শীর্ষ ধনীরা চাইবেন তাদের অর্থ দেশের বাইরে নিয়ে যেতে। এদের মধ্যে ঋণখেলাপি থাকতে পারে, ঘুসখোর থাকতে পারে, সহজে যারা অর্থ উপার্জন করেছেন তারাও থাকতে পারে।

কোনো দেশের অর্থনীতির ক্রিয়াশীলতার দুটো দিক; একটি হচ্ছে ইনভেস্টমেন্ট (বিনিয়োগ), অন্যটি কনজাম্পশন (ভোগ)। বাংলাদেশ ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অনুসরণ করছে। এ অবস্থায় আমাদের বিনিয়োগও কমছে, ভোগও কমছে। এতে আমাদের রাজস্ব আহরণও কমবে। বাজেটে সরকার যে রাজস্ব আহরণ লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করেছে তা এনবিআরের পক্ষে করা কঠিন হবে। ফলে রেভিনিউ বাজেট বাস্তবায়ন অসম্ভব। ফলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ সরকার আরো বড় ঋণ নেবে। বেসরকারি ব্যাংক থেকে নেয়ার চেষ্টা করবে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিভিন্ন বন্ড ইস্যু করে নেয়ার চেষ্টা করবে। তার পরিণতি হিসেবে দেখা দেবে আরো মূল্যস্ফীতি।

বর্তমানে বিনিয়োগের যে খরা যাচ্ছে, তাতে সরবরাহ ঘাটতি দেখা দেবে। কারণ, দেশে বিনিয়োগ হচ্ছে না বললেই চলে। বাংলাদেশ ব্যাংক বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি (ক্রেডিট গ্রোথ) সাড়ে ৯ শতাংশে নামিয়ে এনেছে। গত ১৫ বছরে এ রকম সর্বনিম্ন ক্রেডিট গ্রোথ দেখা যায়নি। এ রকম ক্রেডিট গ্রোথ দিয়ে সাড়ে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কীভাবে হবে তা স্পষ্ট নয়। সাড়ে ৬ শতাংশ দূরে থাক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে কিনা সেটা নিয়েও সন্দেহ আছে।

রাজস্ব আদায় অনেকটাই বিনিয়োগ ও ভোগের সঙ্গে জড়িত। এতে বাংলাদেশ সরকারের ঘাটতি বাজেটের আকার বাড়তে থাকবে। শেষ পর্যন্ত আমাদের অবস্থা এমন হবে যে একটা ঋণ নিয়ে আরেকটা ঋণ শোধ করতে হবে। কেনিয়া, মিসর, পাকিস্তানের মতো যেসব অর্থনীতি ঋণের ফাঁদে পড়েছে সেসব অর্থনীতি ফাঁদ কাটিয়ে ওপরে উঠতে পেরেছে তার উদাহরণ খুব কম। বাংলাদেশের অর্থনীতি তিন-চার বছর আগ পর্যন্ত মোটামুটি ভালো অবস্থায় ছিল। আর এখন আমরা দ্রুতই ঋণের ফাঁদে আটকে যাচ্ছি। এ অবস্থায় বাংলাদেশ আইএমএফ থেকে কিছু লোন পেতে পারে। তবে অন্য উৎস থেকে পাবে না। যখন একটা অর্থনীতি ঋণের ফাঁদে আটকা পড়ে যায় তখন অন্যরা ঋণ দিতে চায় না। কারণ, তারা মনে করবে, বাংলাদেশ তো পরিশোধ করতে পারবে না। এই অবস্থায় বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক বা এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ব্যাংকের মতো যারা আমাদের ছয় মাসে বা বার্ষিক হিসাবে ঋণ সহায়তা দিয়ে থাকে, সেক্ষেত্রেও খরা দেখা দিতে পারে। দ্বিপক্ষীয় ঋণ পাওয়াও কঠিন। চীন থেকে হয়তো ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল কিন্তু রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে তাও সম্ভব হবে না। ভারতের সঙ্গে অতিবন্ধুত্বের দাম দিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে। মূলত এ কারণেই চীন আগের মতো এখন আর হাত খুলে আমাদের সহায়তা করবে না। ভারতের সঙ্গে অতিবন্ধুত্বের কারণে আরো বড় আকারের মূল্য দিতে হবে বাংলাদেশকে।

সব মিলিয়ে ফরেন এক্সচেঞ্জ, রিজার্ভ বাড়ার কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। বিনিয়োগ যে বাড়বে তারও সম্ভাবনা নেই। শেয়ারবাজার যে ঘুরে দাঁড়াবে তাও অসম্ভব। সাপ্লাই চেইন আগের চেয়ে বাড়বে সে সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। এই অবস্থায় রফতানি যদি বাড়ে সেক্ষেত্রে কিছুটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলা যাবে। তবে এ খাতেও দুঃসংবাদ আসছে।

চলমান অস্থিরতায় রফতানি আটকে আছে শুল্কায়ন না হওয়ায়। এর ফলে আমরা রফতানি গন্তব্য হারাচ্ছি। তাদেরকে অনেককেই পরবর্তী সময়ে ফিরিয়ে আনা কঠিন হতে পারে। রফতানি না বাড়লে তো বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়বে না। সরবরাহ কমার সঙ্গে সঙ্গে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়বে। এখন যে ৩০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে আছে, আগামীতে এ সংখ্যা বাড়বে। হয়তো আরো ৫-১০ শতাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে নেমে আসবে। কারণ মূল্যস্ফীতির অনুপাতে মানুষের আয় বাড়েনি। আয়বৈষম্য প্রকট হচ্ছে। এতে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোও নিম্নবিত্তের পর্যায়ে চলে যাবে।

মোটাদাগে বলা যায়, বাংলাদেশের অর্থনীতি খাদের কিনারায় এসে পৌঁছেছে। দুই বছর আগে যখন রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছিল, সে সময় আমরা অনেকে চিন্তা করেছিলাম যে যুক্তিযুক্ত সংলাপের মাধ্যমে আমরা একটি স্থিতিশীল পর্যায়ে পৌঁছাতে সক্ষম হব। কিন্তু সেটা হয়নি। বর্তমানে অর্থনীতির অবনমনের পেছনে রাজনৈতিক অবিশ্বাস দায়ী। একে অন্যকে দোষারোপের মাধ্যমে কখনো অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরানো যায় না, বিনিয়োগ আকর্ষণও করা যায় না। সামাজিক সংহতির দেশ হিসেবে আমাদের পরিচিত হতে হবে। সহিংসতার দেশ হিসেবে যদি মানুষ আমাদের দেশকে চিহ্নিত করে তাহলে ভবিষ্যতে এলসি খুলতেও আমাদের সমস্যা হবে। হয় বৈদেশিক মু্দ্রা দিয়েই এলসি খুলতে হবে, নয়তো কোনো তৃতীয় পক্ষ লাগবে গ্যারান্টি হিসেবে—বীমা কিংবা ব্যাংক উভয় ক্ষেত্রেই।

সামগ্রিকভাবে ভয়াবহ দুর্যোগের দিকে অগ্রসর হচ্ছে আমাদের অর্থনীতি। সরকার ও নীতিনির্ধারকদের এটি বুঝতে হবে যে বর্তমানে যে অনিশ্চিত ও বেদনাদায়ক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি, অর্থনৈতিক বিপর্যয় এর চেয়েও শোচনীয় পরিস্থিতি বয়ে আনতে পারে।

আবু আহমেদ: অর্থনীতিবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান

শ্রুতলিখন: মারিফুল হাসান