আসছে বাজেট—১ (২০২২–২৩)
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ডলারের দাম স্থিতিশীল রাখতে হবে, ঠেকাতে হবে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি। পাশাপাশি গরিব মানুষকে সুরক্ষা দিতে হবে।
ঢাকা
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখাই আগামী বাজেটের বড় চ্যালেঞ্জ। অর্থনীতিতে নতুন চাপ হিসেবে দেখা দিয়েছে এই সূচক। তিন মাস ধরে মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশের বেশি। চাল, ডাল, আটা, ময়দা, তেল—সব নিত্যপণ্যই বেশি দামে কিনে খেতে হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির হার বাড়লে দারিদ্র্যসীমার একটু ওপরে থাকা মানুষের একটি অংশ আবার গরিব হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় থাকে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আমদানি খরচ কমাতে ডলারের দাম স্থিতিশীল রাখতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে নিত্যপণ্যের বাড়তি দাম ঠেকানোর সুযোগ নেই। ফলে আমদানি নিরুৎসাহিত করতে কম প্রয়োজনীয় ও বিলাসপণ্যে শুল্ক-কর বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অভ্যন্তরীণ বাজারে কঠোর তদারকি করে দেশে উৎপাদিত পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঠেকানো সম্ভব। প্রয়োজন চালের দাম সহনীয় রাখতে বাজার কৌশল নির্ধারণ করা; পাশাপাশি মূল্যস্ফীতির চাপে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত গরিব মানুষদের বাজেটের মাধ্যমে নগদ ও খাদ্যসহায়তা দিয়ে সুরক্ষা দিতে হবে। কেননা, মূল্যস্ফীতি একধরনের করের মতো। জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মজুরি বা আয় না বাড়লে সীমিত আয়ের মানুষের ওপর চাপ বাড়ে। তাঁদের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়।
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলমের কাছে প্রশ্ন করা হয়েছিল, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আগামী বাজেটে কী থাকছে। প্রশ্নের জবাবে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আগামী বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকেই সরকার সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে।
গরিব মানুষকে সুরক্ষা দিতে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। খাদ্যসহায়তা ব্যাপকভাবে বাড়বে। প্রথমবারের মতো সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। এ ছাড়া সুনির্দিষ্ট কিছু এলাকায় কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বিশেষ বরাদ্দ থাকছে। কম প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি নিরুৎসাহিত করতে শুল্ক-কর বৃদ্ধি করা হচ্ছে।
ডলারের দাম অযৌক্তিক পর্যায়ে রেখে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। এতে বাজার চাহিদা অনুযায়ী দাম ঠিক হবে।
আহসান এইচ মনসুর, বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক
ডলার–সংকট মোকাবিলা
৯ জুন আগামী অর্থবছরের বাজেট দিতে যাচ্ছেন অর্থমন্ত্রী। মূল্যস্ফীতির চাপ সামলানোর জন্য আমদানি খরচ কমাতে ডলারের দাম স্থিতিশীল রাখাটাই এখন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, ডলারের দাম বেঁধে দিলে হুন্ডি বা অন্য কোনো চ্যানেলে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বেড়ে যেতে পারে।
ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলার আসা কমলে তা সংকটকে উসকে দিতে পারে। আবার পুরোপুরি বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে ডলার কোন দরে গিয়ে ঠেকবে, বলা মুশকিল। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েক ধরনের পরীক্ষা–নিরীক্ষার পর এখন ডলারের দর বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার কথা বলছে। পাশাপাশি বাজার তদারক করবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ডলারের দাম অযৌক্তিক পর্যায়ে রেখে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া উচিত। এতে বাজার চাহিদা অনুযায়ী দাম ঠিক হবে।
গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষের সুরক্ষা
সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারাটাই এখন অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে আড়াই বছর আগে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিশ্বব্যাংক। সেখানে বলা হয়, বাংলাদেশের মোট জনগোষ্ঠীর ৫৪ শতাংশই সব সময় আবার গরিব হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে। সেই হিসাবে, এই জনসংখ্যা আট কোটির বেশি। মূলত অর্থনীতিতে কোনো তাৎক্ষণিক ধাক্কা এলে বিপুলসংখ্যক মানুষের আয় কমে গরিব হয়ে যায়।
মূল্যস্ফীতি গণনা সঠিকভাবেই করা হয়। জাতিসংঘের সংজ্ঞা মেনেই বিবিএস মূল্যস্ফীতি গণনা করে।
শামসুল আলম, পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী
মূল্যস্ফীতি নিয়ে প্রশ্ন
আশপাশের দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি তুলনামূলক কম। গত এপ্রিল মাসে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে গত এপ্রিলে ভারতে ৭ দশমিক ৭৮ শতাংশ, পাকিস্তানে ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ ও নেপালে ৭ দশমিক ২৮ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। আর গত এপ্রিল মাসে যুক্তরাজ্যে ৪০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ সাড়ে ৮ শতাংশ মূল্যস্ফীতি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে মূল্যস্ফীতি উঠেছে সাড়ে ৮ শতাংশে।
এবার বাজারদর সামলাতেও রোল মডেল হোন
বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি গণনা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আশপাশের দেশগুলোতে বাংলাদেশের চেয়ে মূল্যস্ফীতি বেশি। এ দেশেও আশপাশের দেশের মতো মূল্যস্ফীতি হওয়ার কথা। তাঁর মতে, বাংলাদেশেও প্রকৃত মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ নয়; আরও অনেক বেশি। এটি জাতীয় গড় হিসাব। গরিব মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ ১০ থেকে ১৫ শতাংশের কম নয়। ফলে দারিদ্র্যসীমার কিছুটা ওপরে থাকা মানুষেরা আবার গরিব হতে পারেন। করোনায় গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষের আয় এমনিতেই কমে গেছে। এখন তাঁরা আরও ভোগান্তিতে পড়েছেন।
মূল্যস্ফীতি গণনা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে—এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, মূল্যস্ফীতি গণনা সঠিকভাবেই করা হয়। জাতিসংঘের সংজ্ঞা মেনেই বিবিএস মূল্যস্ফীতি গণনা করে।
দেড় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি
কয়েক মাস ধরেই মূল্যস্ফীতি বেশ বেড়েছে। গত ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত টানা তিন মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের ওপরে আছে। গত পাঁচ-ছয় বছরে এমন দেখা যায়নি। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ গত এপ্রিল মাসে মূল্যস্ফীতির হার ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ। এটি গত দেড় বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৪৪ শতাংশ হয়েছিল।
পদে পদে মূল্যস্ফীতির চাপ
সম্প্রতি মূল্যস্ফীতির চিত্রে কিছুটা বৈচিত্র্যও এসেছে। আগে দু-চারটি প্রধান ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়লেই মূল্যস্ফীতি বাড়ত। কিন্তু এবার প্রায় সব ধরনের পণ্যের দাম বাড়ছে। গত এপ্রিল মাসে সরকারি সংস্থা বিবিএস দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহৃত ৪৭টি পণ্যের কোনটির দাম বাড়ল, কোনটির দাম কমল—সেই তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করেছে। সেখানে দেখা গেছে, ওই সব বহুল ব্যবহৃত ৪৭টি পণ্যের মধ্যে এপ্রিল মাসে ৩২টির দাম বেড়েছে।
এ তালিকায় রয়েছে চাল, ডাল, চিনি, মাছ, মাংস, ভোজ্যতেল, দুধ, জ্বালানি সামগ্রী, পোশাক-আশাক ইত্যাদি। মাত্র ১৩টি পণ্যের দাম কমেছে। এপ্রিল মাসে দাম কমার তালিকায় ডিম থাকলেও এখন ডিমের দাম বেশ চড়া। অন্যদিকে মাত্র চারটি পণ্যের দাম অপরিবর্তিত আছে। ফলে পদে পদে মূল্যস্ফীতির চাপ অনুভব করছেন সাধারণ মানুষেরা।
নতুন শঙ্কা চালের দাম
মূল্যস্ফীতি গণনায় একক পণ্য হিসেবে চালের অবদান সবচেয়ে বেশি। মোটাদাগে বলা হয়, গরিব মানুষের আয়ের ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ খরচ হয় চাল কেনায়। কিন্তু এই ভরা মৌসুমেও চালের দাম বাড়ছে। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে সব ধরনের চাল কেজিতে ৩ থেকে ৬ টাকা বেড়েছে। চালের দাম বাড়তির কারণে মে ও জুন মাসের হিসাব এলে দেখা যেতে পারে মূল্যস্ফীতি আরও বেড়েছে।
যে কারণে মূল্যস্ফীতি
২০২১ সালের মাঝামাঝি সময়ে করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা সামলে অর্থনীতিতে গতি আসতে শুরু করে। ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা হতে থাকে। ফলে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথে হাঁটে। ওই সময় আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম ও পরিবহন খরচ বৃদ্ধি পেতে থাকে। ফলে আমদানি খরচ মেটাতে আগের চেয়ে বেশি ডলার লেগেছে। গত এক বছরে ভোজ্যতেলের দাম ৫০ শতাংশের মতো বেড়েছে।
গমের দাম দ্বিগুণ হয়েছে। জ্বালানি তেলের দাম ব্যারেলে ১০০ মার্কিন ডলার পেরিয়েছে। শিল্পের কাঁচামাল তুলা, ক্লিংকার, লোহা—এসব পণ্যের দাম ৫০ থেকে ১০০ শতাংশ বেড়েছে। মূল্যস্ফীতি গত বছরের শেষ দিক থেকেই বাড়ছিল। গত ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ পরিস্থিতি মূল্যস্ফীতিকে আরও উসকে দেয়। সর্বশেষ দুই মাস ধরে চলমান ডলার–সংকট আমদানি ব্যবস্থাকে টালমাটাল করে তোলে।
এমন প্রেক্ষাপটে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে চারটি পরামর্শ দিয়েছেন সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান। প্রথমত, বাজারে পণ্য, বিশেষ করে চালের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে হবে। কিন্তু পণ্যের উৎপাদন ও মজুতের সরকারি তথ্য বেশ হতাশাজনক। তাই নীতি নেওয়া কঠিন। প্রয়োজনে চাল আমদানির সুযোগ রাখা উচিত।
দ্বিতীয়ত, আমদানিনির্ভর নিত্যপণ্যের দাম স্বাভাবিক রাখতে শুল্ক-কর কমানো। তৃতীয়ত, প্রতিযোগিতা কমিশন ও ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরকে শক্তিশালী করে অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। তবে ব্যবস্থা নিতে গেলে যেন ব্যবসায়ীরা উধাও না হয়ে যান। এ জন্য ব্যবসায়ী নেতাদের সহযোগিতা নিতে হবে। চতুর্থত, মূল্যস্ফীতি বাড়লে সবচেয়ে বেশি চাপে পড়েন গরিব মানুষ। তাঁদের সুরক্ষা দিতে বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বিস্তৃত করতে হবে।