১ এপ্রিল ২০২৩
ড. ফারুক আমিন
গত কয়েকদিন যাবত বাংলাদেশের পত্রপত্রিকাগুলো দলবদ্ধভাবে একটি খবর প্রকাশ করে চলেছে। অর্থনীতি বিষয়ক আমেরিকান সংবাদ সংস্থা ব্লুমবার্গ বলেছে, “আগামী নির্বাচনেও শেখ হাসিনা বিজয়ী হবে”, এমন একটি ঘটনা নিয়ে দেশের প্রায় প্রতিটি পত্রিকাই খবর ছাপানো হয়েছে।
ভারতীয় সাংবাদিক অরুণ দেবনাথের লেখা একটি প্রতিবেদনকে নিয়ে তাদের এই মহা আয়োজন ও খবর-উৎসব শুরু হয়েছে। তারপর সেই খবর নিয়ে টিভিগুলোতে কথাবার্তা হচ্ছে। ঐ খবরকে সরকারের নিয়োজিত বট বাহিনী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্রমাগত পুশ করছে। তারা দেশের মানুষকে বার্তা দিতে চায়, দেখো বিদেশের পত্রিকা বলছে শেখ হাসিনা নির্বাচনে বিজয়ী হবে। সুতরাং বুঝো শেখ হাসিনার প্রতি বিদেশের সমর্থন আছে।
সম্ভবত একটি বাংলাদেশী পত্রিকাও বাকী নেই যারা এ খবর প্রকাশ করেনি। পত্রিকাগুলোর শিরোনামও খেয়াল করার মতো। “চতুর্থ মেয়াদেও জয়ী হবেন শেখ হাসিনা: ব্লুমবার্গ”। “অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য শেখ হাসিনার সময়োচিত সংস্কারের প্রশংসায় ব্লুমবার্গ”। “অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য শেখ হাসিনার সময়োচিত সংস্কারের প্রশংসায় ব্লুমবার্গ”। “টানা ৪র্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসতে পারেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা: ব্লুমবার্গ”। এ কয়টি শিরোনাম হলো স্রেফ উদাহরণ। প্রতিটি খবরের শিরোনামই এ ধরণের।
বাংলাদেশে যখন সবগুলো পত্রিকা দলবদ্ধ শেয়ালের মতো এক সুরে হুক্কাহুয়া রব শুরু করে, তখন যে কোন ন্যুনতম বুদ্ধির মানুষ বুঝতে পারেন এরা সরকারের নির্দেশ পালনে সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছে। ক্রসফায়ারের গল্প থেকে শুরু করে কোন দুর্ঘটনার পর অলৌকিক উদ্ধারের গল্প, গত বারো বছর যাবত এ ধরণের প্রতিটা গল্পে বাংলাদেশের গণমাধ্যম অত্যন্ত নিবেদিত হয়ে এক সূরে, প্রায়শ একই শব্দ ব্যবহার করেই গান গেয়ে যাচ্ছে। এ ধরণের দলবদ্ধ ঐকান্তিক প্রচেষ্টাকে ইংলিশে বলে অর্কেস্ট্রা। এই অর্কেস্ট্রা শিল্পে বাংলাদেশের মিডিয়া প্রশংসনীয় দক্ষতা অর্জন করেছে। দীর্ঘ প্রচেষ্টা এবং অধ্যবসায়ের কারণে তারা এখন এতোটাই দক্ষ যে তাদেরকে এখন আর পুরো স্ক্রিপ্ট দিতে হয় না। মালিক যদি আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করেন, তাই যথেষ্ট হয়। বাকী তাল, লয়, সুর, শব্দ সব কিছু মিলিয়ে নেয়ার কাজটা তারা নিজেরাই করে নেন।
এ অবস্থায় বাংলাদেশের সচেতন মানুষরা কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করতে বাধ্য। প্রণিধানযোগ্য প্রশ্ন হলো, কেন আওয়ামী সরকার ও মিডিয়ার কাছে এ খবর এতো গুরুত্বপূর্ণ? তারপর প্রশ্ন আসে, ব্লুমবার্গ কি? অরুন দেবনাথ কে? ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে আসলে কী আছে? ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে যা আছে, তার সত্যতা কী? বাংলাদেশের পত্রিকাগুলো কি সত্য বলছে?
মানবসমাজের অমোঘনীয় বাস্তবতা হলো, সত্য কখনো চাপা থাকে না। ফ্যাসিবাদী দল হিসেবে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের জন্মের আগে থেকেই বিদেশীদের কাছে তদবির এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পাবলিক রিলেশন্স সম্পর্কিত কাজে সময়, অর্থ এবং পরিশ্রম নিয়োগ করে এসেছে। যে কোন ফ্যাসিস্ট গোষ্ঠীর কাছে তাদের ভাবমূর্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। প্রচারণা ও জনগণের চিন্তা নিয়ন্ত্রণ তাদের মৌলিক একটি কাজ। ঠিক যে কারণে হিটলারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো গোয়েবলস।
বছরের পর বছর যাবত টাকা দিয়ে সম্ভবপর সমস্ত প্রচারণা চালানোর পরও বর্তমান বাস্তবতা হলো সামিট ফর ডেমোক্রেসিতে বাংলাদেশ ঢোকারও সুযোগ পায়না। এই আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র সম্মেলনে বাংলাদেশকে সৌজন্যবোধক দাওয়াতটুকু পর্যন্ত দেয়া হয়না। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ‘এনফোর্সড ডিজএপিয়ারেন্স ক্যাপিটাল অফ দ্য ওয়ার্ল্ড’ হিসেবে বাংলাদেশের পরিচিতি এখন প্রতিষ্ঠা পেয়ে গেছে। বাংলাদেশের নির্বাচনকে নর্থ কোরিয়ার নির্বাচনের সাথে তুলনা করা হয়। জাপানের মতো নির্বিরোধী দেশের রাষ্ট্রদূতও বাংলাদেশের মধ্যরাতের নির্বাচন নিয়ে কৌতুক করেন।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশের এই পরিচিতি সম্পর্কে বাংলাদেশের মানুষদের জানাকে আওয়ামী সরকার নিজেদের জন্য চরম বিপদজনক বিষয় হিসেবে মনে করে। সুতরাং তারা মাঝেই মাঝেই নানা উপায়ে বাংলাদেশের বাইরে এবং ইংলিশ ভাষায় কিছু ছাপিয়ে তারপর জোরেশোরে প্রচারণায় নেমে পড়ে। একই কাজ বিভিন্ন সময়ে তারা করেছে শেখ হাসিনার বিভিন্ন পদক প্রাপ্তি নিয়ে, বিশ্বের দ্বিতীয় সৎ প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়া নিয়ে, বাংলাদেশের জিডিপি বৃদ্ধি তথা অর্থনৈতিক উন্নয়ন নিয়ে সারা বিশ্বের বিস্ময় ইত্যাদি প্রসঙ্গে।
বাংলাদেশে একটি বহুল প্রচলিত কৌতুক আছে। বৃটিশ উপনিবেশিক শাসনামলে যখন প্রত্যন্ত জনগোষ্ঠীর শিক্ষার কোন সুযোগই ছিলো না তখন কোন গ্রামে একজন শিক্ষিত মানুষ থাকলে তাকে নিয়ে পুরো গ্রাম গর্ব করতো। পাশাপাশি এরকম দু’টি গ্রামের মাঝে দীর্ঘদিন রেষারেষি ছিলো কোন গ্রামের শিক্ষিত মানুষটি বেশি শিক্ষিত তা নিয়ে। কারণ অধিকতর বেশি শিক্ষিত হলে পুরো গ্রামবাসীর মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। সুতরাং মহাসমারোহে তারা একটি বিতর্কসভার আয়োজন করলো। কার ইংরেজি বেশি শক্তিশালী তা যাচাই করা হবে। অধিকতর চালাক শিক্ষিতটি তার প্রতিপক্ষকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘আই ডোন্ট নো’ এর অর্থ কি? তখন প্রতিপক্ষ উত্তর দিলো ‘আমি জানি না’। এ উত্তর শুনেই উপস্থিত গ্রামবাসী বিপুল হর্ষচিৎকারে উন্মত্ত হয়ে বিজয়ের আনন্দে মিছিল শুরু করে দিলো। কারণ প্রতিপক্ষ স্বীকার করে নিয়েছে, সে জানে না।
আওয়ামী লীগ ও শুডো আওয়ামী (বাম/প্রগতি/শাহবাগি) লোকজন বাংলাদেশের জনগণকে এখনো সেই বৃটিশ আমলের গ্রামবাসী মনে করে। গণ-মনোবৃত্তি’র আঙ্গিক থেকে এই ধারণার কিছুটা বাস্তব ভিত্তিও আছে, তা অস্বীকার করা হবে অসততা। এ কারণেই তারা ‘ব্লুমবার্গ বলেছে শেখ হাসিনা নির্বাচনে জিতবে’ এই শিরোনামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা মনে করে, বাংলাদেশের মানুষ ‘ব্লুমবার্গ’ নামের বিদেশী কিছু একটার নাম শুনলেই মনে করবে এটা খুব সত্যি কথা। ইংরেজিতে যেহেতু বলেছে সুতরাং কথা তো ঠিক হবেই। বাংলাদেশে ‘নির্বাচন’ নামের কোন কিছুর যে অস্তিত্বই নেই তা ভুলে গিয়ে সবাই শেখ হাসিনার ‘গণতান্ত্রিক বিজয়’-এর জন্য ধন্য ধন্য শুরু করবে।
আওয়ামীদের এই নতুন বিজয়ধ্বনি’র কেন্দ্র ব্লুমবার্গ হলো একটি অর্থনীতিবিষয়ক আমেরিকান সংবাদসংস্থা এবং ব্যবসায়ী গ্রুপ। অর্থনৈতিক বাজারকে ঘিরেই তাদের সমস্ত কাজ। বাংলাদেশ নিয়ে এ প্রতিবেদনটি আসলে কোন রাজনৈতিক প্রতিবেদন নয়, বরং এটি একটি অর্থনৈতিক প্রতিবেদন।
প্রতিবেদনটি লিখেছেন অরুণ দেবনাথ নামের এক ভারতীয় সাংবাদিক। ব্লুমবার্গে তার লেখা প্রতিবেদনগুলো দেখলে দেখা যায় বাংলাদেশ নিয়ে তার আগ্রহ বিস্তর। তিনি নিয়মিত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা এবং শনৈ শনৈ উন্নয়ন নিয়ে লিখেছেন।
সুতরাং এবারও তিনি আইএমএফ এর কাছ থেকে ৪.৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেতে বাংলাদেশ কিভাবে সফল হয়েছে তার ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। অরুণবাবুর মতে, যেহেতু শেখ হাসিনা এই ঋণ পাওয়ার কাজটি সফলভাবে করেছেন সুতরাং ধরে নেয়া যায় আগামী নির্বাচনেও তিনি বিজয়ী হতে যাচ্ছেন। “শি ইজ এক্সপেক্টেড টু উইন এ ফোর্থ স্ট্রেইট টার্ম ইন দ্য ইলেকশনস”।
ব্রিটিশ আমলের গ্রামবাসী হিসেবে থেকে না গিয়ে বরং সরাসরি অরুণবাবুর লেখাটি পড়লে যে কয়টা চিন্তা একজন পাঠক ধারণা করতে পারবে তা হলো, বাংলাদেশে সম্ভবত প্রচণ্ড গণতান্ত্রিক নির্বাচন হয়। সেই নির্বাচনে শেখ হাসিনা আবারও প্রকাণ্ড বিজয় অর্জন করতে যাচ্ছেন। কারণ তিনি দেশটিকে উন্নয়নের মহাসড়কে তুলে দিয়ে প্রবল বেগে ধাবমান করে দিয়েছেন। এই উন্নয়নের প্রলয়কাণ্ডে আইএমএফ এর ঋণ একটি মহা অর্জন।
সমস্ত প্রচেষ্টার পরও অরুণবাবু অবশ্য বাধ্য হয়েছেন তার লেখাটি শুরু করতে দুইটি ব্যতিক্রমী বাক্য দিয়ে। “পৃথিবীর দেশে দেশে সরকারী নেতারা ব্যালট বাক্সের মাধ্যমে শাস্তি পাওয়ার আশংকায় আইএমএফ এর সংস্কারের শর্তগুলো পূরণ সংকোচ করে। তবে শেখ হাসিনা তাদের মাঝে একজন নন।“
অরুণবাবু পরিষ্কার করে বলেই দিয়েছেন, ব্যালট বাক্সে শাস্তি পাওয়ার ভয় শেখ হাসিনার নেই। তিনি ব্যালট বাক্সের তোয়াক্কাও করেন না। অন্যরা যেখানে নানা হিসাব নিকাশ করে, অনেক বিষয়কে বিবেচনা করতে বাধ্য হয়, শেখ হাসিনা সেখানে কোন কিছুর পরোয়া করেন না। নির্বাচনকে সামনে রেখে পাকিস্তান ও শ্রীলংকা যেখানে আইএমএফ এর ঋণ নিতে এখনো নানা বিচার বিবেচনা করে যাচ্ছে, সেখানে সবাইকে পেছনে ফেলে শেখ হাসিনা ইতিমধ্যেই ঋণের প্রথম কিস্তির ৪৭৬ মিলিয়ন ডলার হাতে পেয়ে গেছে।
ঋণ করতে বাধ্য হওয়া স্বাভাবিকভাবে যেখানে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় ব্যর্থতার সবচেয়ে বড় সূচক, আইএমএফ এর ঋণ পেতে শেখ হাসিনার এই মহাসাফল্যের ভিত্তিতে এবং ব্যালট বাক্সের ফলাফলকে পরোয়া না করার কারণে অরুণবাবু ধারণা করছেন যে আগামী নির্বাচনে হাসিনা বিজয়ী হতে যাচ্ছেন। এই হলো বাবুর উদ্ভট চিন্তাকাঠামো এবং যুক্তির গঠন। তারপর এর ভিত্তিতেই এখন বাংলাদেশের মিডিয়া গ্রামবাসী ঢোল-ঢাক নিয়ে গগনবিদারী চিৎকার করতে করতে মহাসমারোহে বিজয়মিছিলে নেমে পড়েছে।
লেখকঃ সম্পাদক, সুপ্রভাত সিডনি