মিজানুর রহমান
২৫ আগস্ট ২০২৩, শুক্রবার
চীন! ভারতও তা মেনে নিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশকে ওই জোটে নিতে মরিয়া বেইজিং কিংবা চীনের পরামর্শে ব্রিকসে যেতে উদগ্রীব ঢাকা হেরে গেছে! বিশ্লেষক, পেশাদার কূটনীতিক তথা ওয়াকিবহাল মহল অবশ্য ঢাকার হেরে যাওয়াকে মানতে নারাজ। তাদের মতে, চীন এবং ভারতের রশি টানাটানিতে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে পড়ে গেছে। এখানে সেগুনবাগিচার দায় যৎসামান্যই!
ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা এই গ্রুপটির সম্প্রসারণে জোহানেসবার্গ ঘোষণা এসেছে। ব্রিকসে যোগ দিচ্ছে আরও ৬টি দেশ। আগামী ১লা জানুয়ারি থেকে তাদের সদস্যপদ কার্যকর হবে। এ ঘোষণা দিয়েছেন ব্রিকস সামিটের চেয়ার দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা।
নতুন সদস্য দেশগুলো হলো- মিশর, ইথিওপিয়া, ইরান, আর্জেন্টিনা, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব। জোহানেসবার্গের সম্মেলনে রামাফোসা বলেন, ব্রিকস সম্প্রসারণের প্রাথমিক প্রক্রিয়ায় আমরা একমত হয়েছি। আর্জেন্টিনা, মিশর, ইথিওপিয়া, ইরান, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতকে পূর্ণাঙ্গ সদস্য করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা। এবারের ব্রিকস সম্মেলনের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ এজেন্ডাই ছিল এর আকার বৃদ্ধি।
এর আগে ২০১০ সালে সর্বশেষ সদস্য যুক্ত হয়েছিল ব্রিকসে। চার দেশ থেকে যাত্রা শুরুর পর ওই বছর জোটটিতে যুক্ত হয় দক্ষিণ আফ্রিকা। দারুণভাবে ব্রিকস সম্মেলন আয়োজন করায় দক্ষিণ আফ্রিকাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট রামাফোসা ব্রিকসের সম্প্রসারণসহ অন্যান্য সকল বিষয়ে বিস্ময়কর কূটনৈতিক দক্ষতা দেখিয়েছেন। আগামী বছর ব্রিকস সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে রাশিয়ায়।
নতুন সদস্য দেশগুলোকে স্বাগত জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তিনি অন্য দেশগুলোর সঙ্গে কাজ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। বলেন, এসব দেশের প্রতিটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, ঐতিহাসিক সম্পর্ক আছে ভারতের। আশা করি সহযোগিতা ও সমৃদ্ধির এক নতুন যুগের জন্য একসঙ্গে কাজ করবো আমরা। নরেন্দ্র মোদি আরও বলেন, ব্রিকসের সদস্য বৃদ্ধিতে পূর্ণ সমর্থন আছে ভারতের। ঐকমত্যের ভিত্তিতে এগিয়ে যাওয়াকে স্বাগত জানায় ভারত। এ সময় তিনি বহুজাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাকে সংস্কারের কথাও বলেন।
চলমান বিশ্ব ব্যবস্থার ইতি ঘটিয়ে নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার যাত্রা শুরু করতে চায় ব্রিকস। এ জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর যে আধিপত্য বিরাজ করছে তার বিপরীতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক ব্লক তৈরি করছে ব্রিকস নেতারা। ব্রিকসের সদস্য রাষ্ট্রগুলো মনে করে, সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর যুক্তরাষ্ট্রের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় দেশটি এর অপব্যবহার করেছে। এখন সেই অবস্থার পরিবর্তন আনতে চায় ব্রিকস। জোটটি এরইমধ্যে ডলারের ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করতে বড় বড় বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে।
চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং বলেন, এই সদস্যপদ সম্প্রসারণ ঐতিহাসিক ঘটনা। সম্প্রসারণ ব্রিকস সহযোগিতার জন্য একটি নতুন সূচনা বিন্দু। এটি ব্রিকসকে আরও শক্তিশালী করবে এবং বিশ্বের শান্তি ও উন্নয়নে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। ইথিওপিয়ার প্রধানমন্ত্রী আবি আহমেদ তার দেশের জন্য ‘একটি দুর্দান্ত মুহূর্ত’ বলে অভিহিত করেছেন। ইথিওপিয়া একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং সমৃদ্ধ বৈশ্বিক ব্যবস্থার জন্য সকলের সঙ্গে কাজ করতে প্রস্তুত।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মূলত রাশিয়া ও চীনই ব্রিকসকে বড় করতে উঠেপড়ে লেগেছে। রাশিয়া এরইমধ্যে পশ্চিমাদের সর্বাত্মক অর্থনৈতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়ছে। অপরদিকে চীনের সঙ্গেও পশ্চিমাদের দূরত্ব ক্রমশ বাড়ছে। তাইওয়ানসহ বেশ কিছু ইস্যুতে নিকট ভবিষ্যতেই চীনকেও হয়তো রাশিয়ার মতো পশ্চিমাদের মুখোমুখি হতে হবে। তবে সদস্য যুক্ত করা নিয়ে অন্যান্য ব্রিকস দেশগুলো বেশ দ্বিধাবিভক্ত ছিল। রাশিয়া ও চীনের চাপেই তারা ব্রিকসকে বড় করতে রাজি হয়েছে।
৪০টিরও বেশি দেশ ব্রিকসে যোগদানের আগ্রহ প্রকাশ করেছিল এবং ২৩টি দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে যোগদানের আবেদন করেছিল। তবে শেষ পর্যন্ত ছয়টি দেশকে ব্রিকসে নেয়া হলো। আগে থেকেই ব্রিকস বিশ্বের ৪০ শতাংশ জনসংখ্যার প্রতিনিধিত্ব করছে। বিশ্ব অর্থনীতির এক চতুর্থাংশই ব্রিকস দেশগুলোর। জিডিপি’র আকারে এরইমধ্যে পশ্চিমা জোট জি-৭ এর সাত দেশকে ছাড়িয়ে গেছে ব্রিকসের পাঁচ দেশ। নতুন সদস্য যুক্ত হওয়ার পর এর অর্থনীতির আকার আরও বড় হলো।
স্মরণ করা যায়, ব্রিকস সম্প্রসারণের জোরালো তদবির ছিল চীনের। তাদের গুডবুকে ছিল বাংলাদেশ। উদীয়মান মার্কেটগুলোর পরিধি দ্রুত সম্প্রসারণ করে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে কাউন্টার দিতে দ্রুত ব্রিকস সম্প্রসারণে টার্গেট ছিল চীনের। এই সুযোগে জোটে যোগ দিতে অপেক্ষায় ছিল অনেকে। ঢাকার আগ্রহেরও কমতি ছিল না। যদিও ওয়াশিংটন ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নকে অতিক্রম করার আশঙ্কায় ব্রিকস নিয়ে পশ্চিমা উদ্বেগ রয়েছে। এসব উদ্বেগের কারণেই সম্প্রসারণবিরোধী অবস্থানে ছিল ব্রাজিল।
গ্রুপটি একটি অভিন্ন মুদ্রা চালু করা নিয়ে আলোচনা করেছে। তবে এ লক্ষ্যে উল্লেখযোগ্য কোনো সফলতা আসেনি। এবার এই সামিট এমন এক সময়ে হচ্ছে যখন ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যে উত্তেজনা তীব্র, সামিটে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের উপস্থিতি নিয়ে উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে। নীতিগতভাবে সামিটে তিনি যোগ দিলে দক্ষিণ আফ্রিকা তাকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য।