বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক বৈধ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান ২৩৫টি। তবে এর বাইরে অনুমতি ছাড়াই অবৈধভাবে ব্যবসা করছে আরও হাজারের বেশি মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান। এরও বাইরে আরও কয়েকশ’ প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেসব প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা ব্যাগ কাঁধে ঘুরে ঘুরে অবৈধভাবে ফোনে ফোনেই বেচাকেনা করছে দেশি-বিদেশি মুদ্রা।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) বলছে, প্রাতিষ্ঠানিক কিংবা অপ্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোয় পরিচালিত অবৈধভাবে মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের নেপথ্যে যারাই থাকুক, তাদের খুঁজে বের করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
রাজধানীর পাঁচটি স্থানে একযোগে অভিযান পরিচালনা করা হয়। এরমধ্যে তিনটি অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ অফিস হচ্ছে, গুলশানের জেএমসিএইচ প্রাইভেট লিমিটেড, মোহাম্মদপুরের টোকিও স্কয়ারের আলম অ্যান্ড ব্রাদার্স এবং উত্তরার আশকোনা মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটের তৈমুর মানি এক্সচেঞ্জ। বাকি দুটি ফেরারি প্রতিষ্ঠান। মোট পাঁচ প্রতিষ্ঠানের ১৪ জনকে গ্রেফতার করা হয়।
গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলেন, আবু তালহা ওরফে তাহারত ইসলাম তোহা (৩২), আছাদুল শেখ (৩২), হাছান মোল্যা (১৯), আব্দুল কুদ্দুস (২৪), হাসনাত এ চৌধুরী (৪৬), শামসুল হুদা চৌধুরী ওরফে রিপন (৪০), সুমন মিয়া (৩০), তপন কুমার দাস (৪৫), আব্দুল কুদ্দুস (৩২), কামরুজ্জামান রাসেল (৩৭), মনিরুজ্জামান (৪০), নেওয়াজ বিশ্বাস, আবুল হাসনাত (৪০) ও শাহজাহান সরকার (৪৫)।
বুধবার (১৮ জানুয়ারি) দুপুরে মালিবাগ সিআইডি কার্যালয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান সিআইডি প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের বিএফআইইউ টিমের তথ্য ও সহযোগিতায় রাজধানীর গুলশান-১, রিং রোড, মোহাম্মদপুর, উত্তরার আশকোনা, এবি মার্কেট, চায়না মার্কেটে পাঁচ জন বিশেষ পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে একযোগে অভিযান পরিচালনা করা হয়। এই পাঁচটি প্রতিষ্ঠানই বাংলাদেশ ব্যাংকের তালিকায় অবৈধ। অভিযানে বিপুল পরিমাণ দেশি-বিদেশি মুদ্রাসহ মোট ১৪ জনকে গ্রেফতার করে। এ সময় আসামিদের কাছ থেকে ১ কোটি ১১ লাখ ১৯ হাজার ৮২৬ টাকা সমমূল্যের ১৯টি দেশের বৈদেশিক মুদ্রাসহ মোট ১ কোটি ৯৯ লাখ ৬১ হাজার ৩৭৬ টাকা জব্দ করা হয়। গ্রেফতার ব্যক্তিরা রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় নিজস্ব অফিস এবং ভাসমান যোগাযোগের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি (লাইসেন্স) ব্যতীত বৈদেশিক মুদ্রা ক্রয়-বিক্রয় করে আসছিল।
সিআইডি প্রধান বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আসামিরা স্বীকার করেছে, প্রতিটি প্রতিষ্ঠান প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ লাখ টাকা সমমূল্যের বিদেশি মুদ্রা অবৈধভাবে ক্রয়-বিক্রয় করে আসছিল। মাসে ২২ বা ২৪ কর্মদিবসে আরও কী পরিমাণ তারা কেনাবেচা করছেন তা ধারণা করা যায়। গ্রেফতারদের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪ অনুযায়ী মামলা রুজুর কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। সারা দেশে আরও ১ হাজারেরও বেশি অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাহলে সারা দেশে কী পরিমাণ দেশি-বিদেশি মুদ্রার ক্রয়-বিক্রয় হচ্ছে।
তিনি বলেন, তাদের কার্যক্রম সম্পূর্ণ অবৈধ। আমরা আমাদের অপারেশনাল কার্যক্রম অব্যাহত রাখবো। আমাদের অভিযানের কারণে অনেক অবৈধ প্রতিষ্ঠান অফিস গুটিয়ে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ঘুরে ঘুরে ব্যবসা করছে ফোনে ফোনে যোগাযোগ করেই। যার যেখানে যে পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা দরকার, সেখানে পৌঁছে দিচ্ছে। বিনিময়ে ডলার বা অন্য বিদেশি মুদ্রার ন্যায্যমূল্যের তুলনায় বেশি টাকা নিচ্ছে।
অতিরিক্ত আইজিপি সাধারণ মানুষের কাছে অনুরোধ জানিয়ে বলেন, ‘যখন কোনও কাজে বা চিকিৎসার জন্য কেউ বিদেশে যান, তার আগে কিছু প্রসিডিউর আছে। ভিসা পাওয়ার পর তিনি বাংলাদেশের যেকোনও ব্যাংকে ভিসা দেখালেই বিদেশি মুদ্রা পাবেন এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংক তা দিতে বাধ্য। তাহলে কেন তারা অবৈধভাবে ১০০ টাকার ডলার ১১৫ বা ১২০ টাকায় ক্রয় করবেন! এটা অন্যায় ও অবৈধ। আমরা এই অবৈধ কাজকে উৎসাহিত করতে পারি না। লাগবেই যখন তখন বৈধভাবে নেবো, ব্যাংক কিংবা বৈধ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান থেকে নেবো। তাহলে ফুলেফেঁপে ওঠা এসব অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠান অটোমেটিক্যালি বন্ধ হয়ে যাবে।’
এই মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলো অবৈধ। কিন্তু তারা টাকা বা ডলার পাচার করেছেন কিনা কিংবা তারা হুন্ডি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত কিনা জানতে সিআইডি প্রধান বলেন, ‘অল্প সময়ে অল্প পুঁজিতে বেশি আয়ের আশায় অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জগুলো তৈরি হচ্ছে। অভিযানে অবৈধ পাঁচটি মানি এক্সচেঞ্জের মধ্যে তিনটির অফিস থাকলেও বাকি দুটো প্রতারণামূলক বা ফেরারি। তারা কাঁধে ব্যাগ নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে মানি এক্সচেঞ্জ করতেন।’
ফোনে ফোনে যোগাযোগ করলেই যদি একজন টাকা বা বিদেশি মুদ্রা বা ডলার পেয়ে যায়, তাহলে সে কেন ব্যাংকে যাবে? যদিও প্রক্রিয়াটা অবৈধ। এই ক্ষেত্রে ব্যাংকের সেবার যে মান সেটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সেই সেবা বাড়ানোর কোনও তাগিদ আপনারা দিচ্ছেন কিনা— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যারা প্রবাসী তারা দেশে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে বাসায় বসেই টাকা পাঠায়। এক্ষেত্রে সময় বাঁচে ও কোনও হ্যারাসমেন্ট বা বাড়তি কোনও ভাড়া লাগে না। দেশের মানুষ ঘরে বসে টাকা পেয়ে যায়। তবে এটা অবৈধ। আমাদের দেশের স্বার্থে কাজ করতে হবে।’
অবৈধভাবে ‘গজিয়ে ওঠা’ মানি এক্সচেঞ্জের সংখ্যা বাড়ছে। যা এখন হাজারের ওপরে। এসব অবৈধ প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংকের জ্ঞাতসারেই হচ্ছে। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোর কোন গাফিলতি রয়েছে কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে মোহাম্মাদ আলী মিয়া বলেন, ‘এই বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কাজ করছে। তবে আমাদের দেশের স্বার্থে কষ্ট করতে হবে। দেশের সচেতন নাগরিক হিসেবে আমার মতে, কোনও অবৈধ পথ বেছে নেওয়া উচিত নয়। বাংলাদেশ ব্যাংক বা অন্য যেকোনও ব্যাংকের কোনও কর্মকর্তা যদি হুন্ডি কিংবা অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জের সঙ্গে জড়ানোর তথ্য মেলে, তবে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’
কেন অবৈধভাবে মানি এক্সচেঞ্জ বাড়ছে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘খুব অল্প সময়ে লাভবান হওয়া যায়, তাই অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ বাড়ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সোর্স ও সিআইডির সোর্সের মাধ্যমে আমরা অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জের বিরুদ্ধে অভিযান করছি। মানি লন্ডারিংয়ের ক্ষেত্রে শুধু সিআইডি নয়, সব এজেন্সি মিলেই কাজ করতে হবে। এ বিষয়ে আলাদা আইন আছে। সে অনুসারে কাজ করা হচ্ছে। অবৈধ মানি লন্ডারিংয়ের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে।’
উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাপী করোনা পরিস্থিতি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে অস্থিতিশীলতা দেখা দিয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ঊর্ধ্বগতি বিরাজমান। বাংলাদেশও এর অবশ্যম্ভাবী প্রভাব পড়েছে। এরূপ পরিস্থিতিতে দেশের কিছু অসাধু বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবসায়ী অবৈধভাবে লাভবান হওয়ার উদ্দেশ্যে বৈদেশিক মুদ্রার কৃত্রিম সংকট তৈরি করে এবং অধিক মুনাফার জন্য মার্কিন ডলার মজুদ করে দাম বাড়াচ্ছে। ৮৫ টাকার মার্কিন ডলার ১২৩ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। এ কাজে অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জের চেঞ্জারের যেমন ভূমিকা ছিল, তেমনি কিছু কিছু বৈধ মানি এক্সচেঞ্জের ভূমিকাও ছিল প্রশ্নবিদ্ধ।
ডলারের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের সহায়তায় সিআইডি ইতোমধ্যে বেশ কিছু অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করেছে।