বিচারকের অজান্তে রায় দিয়েছেন কর্মচারীরা!

kalbela.com

উত্তম ঘোষ, যশোর
১৭ আগস্ট ২০২৩
বিচারকের অজান্তে রায় দিয়েছেন কর্মচারীরা!

বিচারক কিছুই জানেন না। অথচ আদালত থেকে খালাস পেয়েছেন তিন আসামি। কেবল খালাসই পাননি, নকলখানা থেকে এ আদেশের কপিও দেওয়া হয়েছে আসামিদের। সেখানে রয়েছে বিচারক, প্রশাসনিক কর্মকর্তাসহ পাঁচজনের স্বাক্ষর! ঘটনাটি ঘটেছে যশোর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তৃতীয় আদালতে। এ ধরনের জালিয়াতির ঘটনায় হতবাক হয়েছেন বিচারক, আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্টরা। সমালোচনার ঝড় উঠেছে বিভিন্ন মহলে। অভিযোগ করা হচ্ছে, এ ঘটনার নেপথ্যে রয়েছেন সংশ্লিষ্ট আদালতের কর্মচারীরাই। এ বিষয়ে তদন্ত করে জড়িতদের আইনের আওতায় আনার দাবি উঠেছে।

আদালত সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের ২ মে চৌগাছা উপজেলার বর্ণি গ্রামের স্নেহার খাতুন চৌগাছা থানায় একই এলাকার তাজউদ্দিন, রজনী খাতুন ও রাব্বি হোসেনকে আসামি করে মামলা করেন। মামলায় উল্লেখ করা হয়, জমি-সংক্রান্ত বিরোধের জেরে আসামিদের সঙ্গে বাদীর বিরোধ চলছিল। এর মধ্যে ৩০ এপ্রিল আসামিরা স্নেহার খাতুনের ওপর হামলা চালায়। ওই সময় তাকে মারধর, জখম ও শ্লীলতাহানি করা হয়। মামলা তদন্তের পর এসআই নজরুল ইসলাম ওই তিন আসামিকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট জমা দেন। এ মামলার চার্জগঠনের জন্য ২০২৩ সালের ৩ আগস্ট দিন ধার্য ছিল। এর আগে আসামিরা আদালত-সংশ্লিষ্ট একটি চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এ মামলা থেকে খালাস পাওয়ার জন্য। চক্রটি মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে জাল কাগজপত্রের মাধ্যমে ওই তিন আসামিকে খালাস দেয়।

ঘটনা এখানেই শেষ নয়, আসামিরা ওই খালাসের নকল তুলতে গত ২১ মে নকলখানায় আবেদন করেন। ২৩ মে আসামিদের খালাসের পক্ষে আদালতের আদেশের একটি কপি দেওয়া হয়। আদেশের ওই কপিতে সংশ্লিষ্ট আদালতের বিচারকের স্বাক্ষর রয়েছে। এ ছাড়া নকলখানা থেকে উঠানো ওই আদেশের নকলে রয়েছে প্রশাসনিক কর্মকর্তা, প্রধান তুলনাকারক, তুলনা-সহকারী ও নকলকারকের স্বাক্ষরও। এ কারণে আসামিরা সবাই ওই মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন বলে নিশ্চিত হন। এভাবে কেটে যায় দুই মাস।

এদিকে সংশ্লিষ্ট আদালতের বিচারক গত ৩ আগস্ট আসামিদের অনুপস্থিতিতে এ মামলার চার্জ গঠন করেন। একই সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি ও আগামী ২৭ নভেম্বর সাক্ষী শুনানির জন্য দিন ধার্য করেছেন। এর পরই জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ে।

আসামিপক্ষের আইনজীবী আবুল হোসেন বলেন, গত ২ আগস্ট আসামিদের তিনি ফোন করে চার্জ গঠনের বিষয়টি জানান। ওই সময় তাকে আসামিরা জানান, ওই মামলা থেকে তারা তিনজনই খালাস পেয়েছেন, তাদের আর এ মামলায় হাজিরা দিতে হবে না। এ কথা শুনে তিনি বিস্মিত হন। কেমন করে খালাস পেয়েছেন জানতে চাইলে আসামিরা এসব বিষয় গোপন করেন। পরবর্তী সময়ে তারা বুঝতে পারেন, জালিয়াত চক্রের খপ্পরে পড়েছেন। এরপর গত ৯ আগস্ট তাদের আদালতে আত্মসমর্পণ করিয়ে জামিন নেওয়া হয়েছে বলে জানান অ্যাডভোকেট আবুল হোসেন। তিনি আরও জানান, এর নেপথ্যে আদালত-সংশ্লিষ্ট একটি চক্র জড়িত। এ বিষয়ে তিনি সঠিক তদন্তের দাবি জানান।

এ ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা বিপ্লব আহমেদ বলেন, নকলখানার কাজ মামলার মূল নথি দেখে হুবহু সরবরাহ করা। সেটিই করা হয়েছে। তাদের সংশ্লিষ্ট আদালতের পেশকার যে কাগজপত্র সরবরাহ করেছেন, সে অনুযায়ীই ওই নকল দেওয়া হয়েছে। ফলে যদি কিছু হয়ে থাকে সেটি পেশকারের।

এদিকে, সংশ্লিষ্ট আদালতের কজলিস্ট ও ডায়েরিতে দেখা যায়, রায়ের দিন অর্থাৎ ১৫ মে কজলিস্টের লেখায় কাটাকাটি রয়েছে। সেখানে যে ওভার রাইটিং করা হয়েছে, তা স্পষ্ট বোঝা যায়।

আদালত, আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, পেশকারই মূলত এ জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত।

পেশকার শিরিন জেসমিন হীরামুন নাহার নাজনীন জানান, যা হয়েছে নকলখানা থেকে হয়েছে। এখানে তার কোনো হাত নেই। এর চেয়ে আর বেশি কিছু বলতে পারবেন না বলে তিনি জানান।

জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি কাজী ফরিদুল ইসলাম, বর্তমান সহসভাপতি খোন্দকার মোয়াজ্জেম হোসেন মুকুল, সাবেক সাধারণ সম্পাদক এমএ গফুরসহ সাত-আটজন আইনজীবীর সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, এটি ন্যক্কারজনক কাজ। এ কাজের মাধ্যমে আইন অঙ্গনের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ শেখ নাজমুল আলম এবং চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ফাহমিদা জাহাঙ্গীরের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তারা।