ব্যাংকমালিকেরা যদি ভল্ট খুলে টাকা নিয়ে যান, কে কী করবে: ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ

অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ অর্থনৈতিক প্রতিবেদকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত এক আলাপচারিতায় কথা বলেন
অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ অর্থনৈতিক প্রতিবেদকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত এক আলাপচারিতায় কথা বলেনছবি প্রথম আলো

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে গেল। এই টাকা তো ব্যাগে করে নিয়ে যায়নি কেউ। ব্যাংকিং সিস্টেমে টাকার গতিপথ অনুসরণ করলেই বোঝা যাবে, কে বা কোথায় নিয়ে গেছে। বেনামি হলেও অর্থ প্রবাহের ‘ফুটপ্রিন্ট’ থাকে।

আজ শনিবার অর্থনৈতিক প্রতিবেদকদের সংগঠন ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত এক আলাপচারিতায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক এই শিক্ষক আরও বলেন, ‘দেখলাম, হল-মার্কের একজনকে জেলগেটে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তাহলে এত ডিজিটাল সিস্টেম হলো, কিন্তু ধরতে পারলাম না।’
ইআরএফের পল্টন কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এই আলাপচারিতায় বিভিন্ন গণমাধ্যমের কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।

ব্যাংকমালিকদের টাকা পাচার সম্পর্কে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ আরও বলেন, ‘ব্যাংকমালিকেরা যদি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমতি নিয়ে ব্যাংকের ভল্ট খুলে টাকা নিয়ে যান, তাহলে কে কী করবে?’

ব্যাংকমালিকদের টাকা পাচার সম্পর্কে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘ব্যাংকমালিকেরা যদি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অনুমতি নিয়ে ব্যাংকের ভল্ট খুলে টাকা নিয়ে যান, তাহলে কে কী করবে?’ এ ছাড়া বিদেশে ব্যাংকের এক্সচেঞ্জ হাউস খুলে টাকা পাচার ঘটনা ঘটে বলে তিনি মনে করেন।

পুঁজি পাচার নিয়ে আরও বিস্তারিত কথা বলেন তিনি। বলেন, ‘কানাডার বেগমপাড়া সত্য, মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম সত্য। সিঙ্গাপুরে দ্বৈত নাগরিকত্ব, বড় আবাসন ব্যবসা, চেইন হোটেলের মালিক হয়েছেন। দ্বৈত নাগরিক বলে কোথা থেকে অর্থ এল, তা দেখে না সিঙ্গাপুর। তবে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে এখন এমন কিছু অর্থপ্রবাহের খোঁজ করা হয়।’
তিনি বলেন, কোনো দেশে অনিশ্চয়তা বাড়লে অর্থ পাচার বেড়ে যায়। অর্থের মালিকেরা বিভিন্ন নিরাপদ দেশে অর্থ নিয়ে যান। আগে বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার হতো। এখন নতুন নতুন উপায় তৈরি হয়েছে। যেমন দ্বৈত নাগরিকত্ব, স্থায়ী বাসিন্দা। এ ছাড়া ছোটখাটো ব্যবসায়ীরা আমদানি-রপ্তানির সময় তৃতীয় কোনো পক্ষের কাছে অর্থ রেখেও দেশ থেকে অর্থ পাচার করেন।

অর্থনীতির চলমান সংকটের প্রসঙ্গটিও আলোচনায় আসে। তিনি মনে করেন, অর্থনীতিতে এখন তিন ধরনের সংকট আছে। এগুলো হলো ডলার-সংকট, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট ও উচ্চ মূল্যস্ফীতি।

মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, এখন মর্যাদা বাড়ানোর প্রকল্প (প্রেস্টিজ প্রজেক্ট) করার সময় নয়। এখন গরিব ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার সময়।

মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, এখন মর্যাদা বাড়ানোর প্রকল্প (প্রেস্টিজ প্রজেক্ট) করার সময় নয়। এখন গরিব ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার সময়। মেট্রোরেল, কক্সবাজার রেলপথ—এসব অন্য সময় করলেও হবে। এই মুহূর্তে বড় প্রকল্প সরকারের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত নয়। গরিব ও নিম্ন মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া দরকার। এত বড় বড় প্রকল্প নিয়ে উচ্ছ্বসিত হওয়া ঠিক নয়।
এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, মূল্যস্ফীতি বাড়লে বৈষম্য বেড়ে যায়। শ্রমিক-মজুরের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। তাঁর মতে, একবার মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেলে যত মুদ্রানীতি করা হোক না কেন, সবাই যদি মনে করে মূল্যস্ফীতি বাড়বে, তাহলে অবশ্যই মূল্যস্ফীতি বাড়বে। এটা প্রত্যাশাজনিত মূল্যস্ফীতি।

বড় বড় প্রকল্প সম্পর্কে তিনি বলেন, পদ্মা সেতু হওয়ার ফলে যান চলাচল মসৃণ হয়েছে। সবাই আরামে বাসে করে চলে যাচ্ছে। এতে সবাই খুশি। এটি প্রেস্টিজ প্রকল্প। শুধু এই সুবিধার হিসাব করলে প্রকল্পের খরচ অর্থনৈতিক বিবেচনায় যুক্তিযুক্ত হয় না। দেখতে হবে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কী পরিমাণ দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ হলো, কর্মসংস্থান হলো, রপ্তানিমুখী বিনিয়োগ কতটা হলো। যেমন ভিয়েতনামে প্রতিবছর ১০ বিলিয়ন ডলার বিদেশি বিনিয়োগ আসছে। তাদের সিংহভাগ রপ্তানিমুখী শিল্পে। এতে আর্থিক লেনদেনে ভারসাম্য ঠিক থাকে, দায়দেনা পরিশোধে সমস্যা হয় না।

মেগা প্রকল্প করার সমালোচনা করে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, আমরা বড় বড় প্রকল্প করছি। এসব প্রকল্প ঋণের টাকায় করা হচ্ছে। এভাবে একের এক ঋণের টাকায় বড় প্রকল্প নিই, তাহলে একসময় আমেরিকার মতো হয়ে যাব। কিন্তু ঋণ পরিশোধ তো করতে হবে। তিনি মনে করেন, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাতে ঋণের হার এখনো তেমন উদ্বেগের কিছু নয়, কারণ তা জিডিপির ৩০ শতাংশের মধ্যেই আছে।

‘কিন্তু গত তিন বছরে বিদেশি ঋণ ৫০ বিলিয়ন ডলার থেকে ১০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গেছে। আর যদি ঋণ না-ও নিই, তাহলে ৩-৪ বছর পর বছরে ৫ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করতে হবে। নতুন ঋণ নিলে আরও বাড়বে। যেসব ঋণ পরিশোধ করা হবে, এর পরিষ্কার পরিকল্পনা থাকতে হবে। কোন ধরনের প্রকল্প নেওয়া হবে, তা-ও বিবেচনায় রাখতে হবে,’ বলেন এই অর্থনীতিবিদ।

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ব্রিকস এত সহজে সফল হবে না। কারণ, প্রতিটি দেশের আলাদা স্বার্থ আছে। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিবেচনায় বাংলাদেশের উচিত হবে না চীনের দিকে ঝুঁকে যাওয়া। বাংলাদেশকে ভারসাম্যপূর্ণ নীতি নেওয়া উচিত। কারণ, ভারত ও চীন থেকে কাঁচামাল এনে পণ্য বানাই। সেই পণ্য চীন ও ভারতে রপ্তানি না করে ইউরোপ-আমেরিকায় রপ্তানি করা হয়। আমাদের নির্ভরতা দুই দিকেই।

অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন ইআরএফ সভাপতি রেফায়েত উল্যাহ মৃধা ও সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম প্রমুখ।