ব্যয় ও লোকসান বৃদ্ধির চাপ লণ্ডভণ্ড ভর্তুকি পরিকল্পনা!

২০১২-১৩ থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত আট বছরে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) লোকসান গুনেছে ৫২ হাজার ৩৪৫ কোটি টাকা। আর ২০২২-২৩ অর্থবছর সংস্থাটির লোকসান দাঁড়িয়েছে (সাময়িক হিসাব) ৫১ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরেই আট বছরের কাছাকাছি লোকসান গুনেছে পিডিবি। এমনকি ২০২০-২১ অর্থবছরের তুলনায় গত অর্থবছর পিডিবি প্রায় সাড়ে চারগুণ (৪৫০%) লোকসান দিয়েছে। লোকসানের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিতে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে বিদ্যুৎ খাতে সরকারের ভর্তুকি পরিকল্পনা।

সূত্রমতে, গত অর্থবছর পিডিবির লোকসান বৃদ্ধি পেয়েছে প্রায় ৫৭ শতাংশ। এর মূল কারণ বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়া। ২০২২-২৩ অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন (আমদানিসহ) বেড়েছে প্রায় সাড়ে শতাংশ। তবে এ সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন ও আমদানি ব্যয় বেড়েছে ৩০ শতাংশের বেশি। এর পেছনে রয়েছে জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধি ও টাকার অবমূল্যায়ন। এছাড়া নতুন বেশকিছু বিদ্যুৎকেন্দ্র যুক্ত হওয়ায় ক্যাপাসিটি চার্জ খাতেও ব্যয় বেড়েছে। এতে ভর্তুকির প্রাক্কলন ঠিক রাখা যায়নি।

পিডিবির গত পাঁচ অর্থবছরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০১৮-১৯ অর্থবছর সংস্থাটির লোকসান ছিল মাত্র আট হাজার ১৪১ কোটি টাকা। ওই অর্থবছরের জন্য প্রাথমিক ভর্তুকি বরাদ্দ ছিল সাত হাজার ৯৬৭ কোটি টাকা। অর্থবছর শেষে ওই পরিমাণ ভর্তুকিই লাগে পিডিবির। ২০১৯-২০ অর্থবছরও প্রাথমিক বরাদ্দ ও চূড়ান্ত ভর্তুকি একই পরিমাণ ছিল। ওই অর্থবছর পিডিবি লোকসান করেছিল সাত হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা। আর ভর্তুকি দেয়া হয় সাত হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা।

২০২০-২১ অর্থবছর পিডিবির লোকসান বেড়ে প্রায় দেড়গুণ হয়। ওই সময় সংস্থাটি লোকসান গুণে ১১ হাজার ৬৪৯ কোটি টাকা। সে অর্থবছরের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় প্রাথমিকভাবে ভর্তুকি বরাদ্দ রেখেছিল আট হাজার ৯৪৫ কোটি টাকা। তবে লোকসান বেড়ে যাওয়ায় শেষ পর্যন্ত ভর্তুকি দিতে হয় ১১ হাজার ৭৭৮ কোটি টাকা। পরের অর্থবছর পিডিবির লোকসান রেকর্ড ১৮২ শতাংশ বাড়ে। ওই অর্থবছর লোকসান দাঁড়ায় ৩২ হাজার ৮৮৭ কোটি টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছর পিডিবির জন্য অর্থ মন্ত্রণালয় প্রাথমিকভাবে ভর্তুকি বরাদ্দ রেখেছিল ১১ হাজার ৯৬৩ কোটি টাকা। তবে শেষ পর্যন্ত ভর্তুকি দিতে হয়েছে ২৯ হাজার ৬৫৮ কোটি টাকা।

এদিকে গত অর্থবছর পিডিবির প্রাথমিক প্রাক্কলনে লোকসান ধরা হয় ৩৫ থেকে ৩৬ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে অর্থ মন্ত্রণালয় ভর্তুকি বরাদ্দ রেখেছিল ২৩ হাজার কোটি টাকা। তবে শেষ পর্যন্ত লোকসান অনেকখানি বেড়ে দাঁড়ায় ৫১ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা। এতে ভর্তুকি চাহিদাও অনেক বেড়ে যায়। তবে শেষ পর্যন্ত এ খাতে ৩৯ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা ভর্তুতি বরাদ্দ দেয়া হয়। যদিও গত জুন পর্যন্ত মাত্র সাত হাজার ৩৫৯ কোটি টাকা ছাড় করা হয়। বাকিটা চলতি অর্থবছর ধীরে ধীরে ছাড় করছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

পিডিবির একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আগে পিডিবি বছরে যে পরিমাণ লোকসান গুনত, এখন এক মাসেই তার কাছাকাছি লোকসান হচ্ছে। এর মূল কারণ বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়া। এ খাতে সরবরাহকৃত গ্যাসের পরিমাণ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। এতে বাধ্য হয়ে কয়লার কেন্দ্র বেশি চালাতে হচ্ছে। তবে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত কয়লার দাম ছিল ঊর্ধ্বমুখী। ওই সময় বিশ্ববাজারে কয়লার দাম ৪০০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। এরপর দাম কমতে থাকলেও এপ্রিলের পর তা সহনীয় পর্যায়ে আসে।

তারা আরও জানান, মাঝে ফার্নেস অয়েলের দাম কমলেও এ জ্বালানি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়ে প্রতি ইউনিটে ১৬ টাকার বেশি। অথচ সে বিদ্যুৎ বিক্রি করতে হয় সাড়ে ছয় টাকা দরে। এছাড়া তেলের আমদানি বিল নিয়মিত পরিশোধ না করায় বেশকিছু ফার্নেস অয়েলচালিত কেন্দ্র বন্ধ রাখতে হয়েছে। তবে এসব কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ ঠিকই দেয়া লাগছে। তার ওপর গত ফেব্রুয়ারিতে বিদ্যুৎ খাতে সরবরাহকৃত গ্যাসের দাম অস্বাভাবিক হারে বাড়ানো হয়েছে। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।

পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) তথ্যমতে, ২০২২-২৩ অর্থবছর দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় (আমদানিসহ) আট হাজার ৩৯৭ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা। এর আগের অর্থবছর এর পরিমাণ ছিল আট হাজার ৪৩ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা। অর্থাৎ গত অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন বেড়েছে ৩৫৪ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা বা চার দশমিক ৪০ শতাংশ। যদিও গত অর্থবছর বিদ্যুৎ কিনতে পিডিবির ব্যয় হয়েছে ৮২ হাজার ৯৪৪ কোটি টাকা ৫০ লাখ টাকা। আগের অর্থবছর এ ব্যয় ছিল ৬৩ হাজার ৬৮৯ কোটি ৭০ লাখ টাকা। অর্থাৎ ব্যয় বেড়েছে ৩০ দশমিক ২৭ শতাংশ।

এদিকে ডলারের বিনিময় হার বাড়ায় টাকার অবমূল্যায়নজনিত ব্যয়ও বেড়ে গেছে। ২০২১-২২ অর্থবছর পিডিবির টাকার অবমূল্যায়নজনিত ক্ষতি ছিল ৬১১ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। গত অর্থবছর এ খাতে ক্ষতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৫৫০ কোটি টাকা। অর্থাৎ মুদ্রার অবমূল্যায়নজনিত ক্ষতি বেড়েছে প্রায় ১৫৩ শতাংশ।

লোকসান বৃদ্ধির বিষয়ে পিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, গ্যাসের সরবরাহ কমায় কয়লা ও তরল জ্বালানিভিত্তিক কেন্দ্রগুলোয় বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে গত ডিসেম্বর পর্যন্ত কয়লা ও জ্বালানি তেলের দাম ছিল অনেক বেশি। জানুয়ারি থেকে কমতে শুরু করলেও এপ্রিলের আগে তার সুফল তেমন একটা পাওয়া যায়নি। এছাড়া ফার্নেস অয়েল আমদানির শুল্ক-কর অব্যাহতি তুলে দেয়ায় ব্যয় বেড়েছে। কয়লা আমদানিতেও শুল্কারোপ করা হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, গত এক বছরে নতুন বেশ কয়েকটি বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এসেছে। এসব কেন্দ্রের ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। এ কারণেও বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। এছাড়া ভারতের আদানির বিদ্যুৎ আসার পরে আমদানি ব্যয়ও বেড়েছে। এছাড়া ডলারের বিনিময় হার অনেক বেড়েছে। সব মিলিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। ফলে লোকসান রেকর্ড পরিমাণ বেড়েছে। আর লোকসান বেড়ে যাওয়ায় ভর্তুকিকে এর সঙ্গে সমন্বয় করা যাচ্ছে না।

প্রসঙ্গত, গত ফেব্রুয়ারিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরবরাহকৃত গ্যাসের দাম প্রতি ঘনমিটার ১৪ টাকা করা হয়, আগে যা ছিল পাঁচ টাকা দুই পয়সা। অর্থাৎ ১৭৯ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে গ্যাসের দাম। এতে গত অর্থবছর অবশিষ্ট পাঁচ মাসে (ফেব্রুয়ারি-জুন) বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় তিন হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা বাড়বে বলে জানুয়ারি মাসেই প্রাক্কলন করেছিল পিডিবি।

শেয়ারবিজ