‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ নিয়ে গত দুই দিনে নানা নাটকীয়তার পর শেষ পর্যন্ত সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে ‘জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে ঘোষণাপত্র দেওয়া হবে’ এমন ঘোষণার পর গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরা তাদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে।
সোমবার (৩০ ডিসেম্বর) রাতে দফায় দফায় বৈঠকের পর গভীর রাতে শিক্ষার্থীরা একই সময়ে একই স্থানে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ নামে নতুন কর্মসূচির ঘোষণা দেয়।
গত শনিবার থেকে যে ঘোষণাপত্র নিয়ে এত সাড়া তৈরি হলো, শেষ পর্যন্ত সেটি ছাড়াই কেন কর্মসূচি পালন করতে হলো সেই প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি বাংলা কথা বলেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি শীর্ষ নেতৃত্ব, প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর এবং রাজনৈতিক গবেষকদের সঙ্গে।
তাদের কেউ কেউ নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, মূলত এই ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে সংবিধান স্থগিত করার কথা বললে সরকারের অবস্থান কিছুটা দুর্বল হতো। অন্যদিকে, ঘোষণাপত্র বিষয়টি ইতিবাচকভাবে নেয়নি বিএনপি। যে কারণে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের পক্ষ থেকে ঘোষণাপত্র কর্মসূচি দেওয়ার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করতে দেখা যায় বিএনপির নেতাকর্মীদের।
সরকারের একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র বলেছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের এই ঘোষণাপত্রের বিষয়টি বাদ দেওয়ার জন্য সরকারকে এক ধরনের বার্তাও দেওয়া হয়েছিল বিএনপির পক্ষ থেকে।
ওই সূত্রটির দাবি, সোমবার রাতে এই বিষয়টি নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে লন্ডন থেকে টেলিফোনে কথা বলেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
সোমবার রাতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে জরুরি সংবাদ সম্মেলন করে জানানো হয়, জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এরপরই দফায় দফায় বৈঠক করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা এই ঘোষণাপত্রের বিষয়টি স্থগিত করলেও ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ কর্মসূচি অব্যাহত রাখে।
সরকারের ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগের বিষয়টিকে প্রাথমিক বিজয় হিসেবে দেখছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সংগঠনটির মুখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসউদ বি বলেন, ‘ঘোষণাপত্র ঘিরে আমাদের কর্মসূচি বাতিল করতে দেশি-বিদেশি নানা ষড়যন্ত্র হয়েছে। এখন সবাইকে নিয়ে ঘোষণাপত্র দেওয়া হবে, আমরাও ছাত্র জমায়েত করছি, এটিকে প্রাথমিক বিজয় হিসেবেই দেখছি আমরা।’
দার্শনিক ও সমাজ বিশ্লেষক ফরহাদ মজহার অবশ্য অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র তৈরিতে সরকারের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
ফরহাদ মজহার বলেছেন, ‘কোনো সরকারি ঘোষণায় নয়, গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে পাঁচই অগাস্ট হয়েছে। সুতরাং ঘোষণাপত্র দেওয়ার কোনো বৈধতা এই সরকারের নেই। এটা জনগণের ঘোষণাপত্র। এটা ছাত্রদেরই দেবার কথা।’
‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্রের’ রাজনৈতিক গুরুত্ব কতটা
গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রায় সাড়ে চার মাস পার হয়েছে। সরকার গঠনের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন গত কয়েক মাসে বিভিন্ন সময় এই সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমের সমালোচনা করে ‘প্রেশার গ্রুপ’ হিসেবে মাঠে ছিল। গত শনিবার ওই কর্মসূচি ঘোষণার সময় এর মাধ্যমে ‘৭২ এর সংবিধানের কবর রচনা’ করা হবে বলে সংগঠনটির নেতৃবৃন্দ দাবি করেছেন। কিন্তু গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের এই কর্মসূচিকে ‘প্রাইভেট ইনিশিয়েটিভ’ বলে উল্লেখ করেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম।
সরকারের দিক থেকে আসা ওই বক্তব্যে পরদিন ‘অসন্তোষ’ প্রকাশ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা। নিজেদের দাবির ব্যাপারে অনড় অবস্থানে থাকার কথা জানান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা।
সোমবার বিকালে সংগঠনটির পক্ষ থেকে সারা দেশ থেকে ঢাকায় দেড় থেকে আড়াই লাখ লোকের গণজমায়েতের ঘোষণা দেওয়া হয়। প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের এই কর্মসূচি নিয়ে সোমবার সন্ধ্যায় দফায় দফায় বৈঠকও করেন সরকারের উপদেষ্টারা।
পরে রাতে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর জরুরি সংবাদ সম্মেলন ডাকে। সেখানে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের একটি ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।’
রাত ১০টার দিকে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে মঙ্গলবারের কর্মসূচি স্থগিত করবে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এ নিয়ে দফায় দফায় বৈঠকের পর গভীর রাতে ঘোষণাপত্র কর্মসূচি স্থগিত করে ‘মার্চ ফর ইউনিটি’ নামে একটি কর্মসূচি ঘোষণা করেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শীর্ষ নেতারা।
ঘোষণাপত্র কর্মসূচি প্রত্যাহার হওয়া নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির অনেককেই ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করতে দেখা যায়। এমনকি শীর্ষ নেতৃবৃন্দ যখন মিটিং করছিলেন তখন কার্যালয়ের বাইরে বেশকিছু কর্মীকে ঘোষণাপত্র কর্মসূচির সমর্থনে স্লোগান দিতে দেখা গেছে।
মঙ্গলবার দুপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসউদ বলেন, ‘আমরা যখন একটা ঘোষণাপত্র দেওয়ার কথা বললাম তখন সরকার তো রাজি ছিল না। আমরা সরকারকে জানিয়েছিলাম। কিন্তু আমরা অনড় ছিলাম। শেষ পর্যন্ত সরকার নিজেরাই ঘোষণাপত্র দিতে রাজি হয়েছে, এটা আমাদের প্রাথমিক বিজয়।’
এমন বক্তব্যের সূত্র ধরে প্রশ্ন করা হলে সরকারের একটি ঘনিষ্ঠ সূত্র নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, শেষ পর্যন্ত যদি ঘোষণাপত্র অনুষ্ঠানে সংবিধান বাতিলের মতো কোনো সিদ্ধান্ত আসতো সেটি সরকারের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করতো।
তিনি জানান, এতে বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বৈধতা নিয়েও এক ধরনের প্রশ্ন উঠত। পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকারের দিক থেকে ওই অনুষ্ঠানে বল প্রয়োগের মতো ঘটনাও ঘটার আশঙ্কা ছিল। যে কারণে সরকার শেষ পর্যন্ত নিজ উদ্যোগেই ঐকমত্যের ভিত্তিতে ঘোষণাপত্র দেওয়ার ঘোষণা দেয়, বিবিসি বাংলাকে এমন ধারণা দেন সরকারের ওই সূত্রটি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সমন্বয়ক মাসউদ বলেন, ‘আমাদের বিশ্বাস সরকার যে ঘোষণাপত্র দিবে, তাতে আমাদের চাহিদার বাস্তবায়ন হবে।’
রাজনৈতিক চাপ ও কৌশল
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ‘জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র’ নিয়ে বিএনপিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের খুব একটা ইতিবাচক সাড়া ছিল না। কেননা এই ঘোষণা দেওয়ার পর ছাত্রদের পক্ষ থেকে ৭২-এর সংবিধানকে ‘মুজিববাদী’ আখ্যা দিয়ে তার ‘কবর’ রচনার কথাও বলা হয়েছিল।
সরাসরি এই কর্মসূচির বিরোধিতা না করলেও শিক্ষার্থীদের ওই ঘোষণার পর বিএনপিকে বিভিন্ন সভা সমাবেশে ৭২ এর সংবিধানের পক্ষে ইতিবাচক অবস্থান নিতেও দেখা যায়। সেই সাথে গত কয়েকদিনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নিয়ে বক্তব্যও দিতে দেখা গেছে বিএনপি নেতাদের।
ওই কর্মসূচি ঘোষণার পর বিএনপি নেতাকর্মী ও দলীয় সমর্থকদের অনেককেই ছাত্রদের ওই কর্মসূচির সমালোচনা করে ফেসবুকে পোস্ট দিতে দেখা গেছে। এরপরই প্রশ্ন ওঠে তাহলে কী বিএনপির চাপের কারণেই শেষ পর্যন্ত এই ঘোষণাপত্র কর্মসূচি থেকে সরে আসতে হয়েছে বৈষম্যবিরোধীদের?
সরকারের একটি সূত্র জানাচ্ছে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন। একই সময় দলটির স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও এই বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়।
সোমবার রাতে বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থীরা যে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করে সেখানে উপস্থিত ছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা ও সংগঠনটির সাবেক সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ।
এক পর্যায়ে গভীর রাতে প্রেস ব্রিফিংয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে জানানো হয় শহীদ মিনারে জমায়েত কর্মসূচি বহাল রাখলেও ঘোষণাপত্র আপাতত স্থগিত রাখা হচ্ছে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ বলেন, কিছু রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে বাধা ছিল। সেটা আমরা কাটিয়ে উঠেছি। বিভিন্ন শক্তি ভেবেছিল মানুষ আমাদের কর্মসূচিতে সাড়া দিবে না, কিন্তু সেটি ভুল প্রমাণ হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দেয়নি। প্রকাশ্যে কৌশল অবলম্বন করেছে বৈষম্যবিরোধীরা।’
এদিকে, এই ঘোষণাপত্র রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে দেওয়ার উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে বিএনপি। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘জুলাই বিপ্লবের গণতান্ত্রিক গণঅভ্যুত্থান- এটার আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী ঘোষণাপত্র সংশ্লিষ্ট সকল রাজনৈতিক দলসহ সবার সাথে আলোচনা করে হবে। আশা করি তাতে জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন থাকবে।’
গণঅভ্যুত্থানের সাড়ে চার মাসের মাথায় ঘোষণাপত্রের বিষয়টি ব্যাপকভাবে আলোচনায় এলেও শুরু থেকেই সরকারের বৈধতার সংকট নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলেছিলেন দার্শনিক ও সমাজ বিশ্লেষক ফরহাদ মজহার এবং ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে সংবিধান বাতিলের পরামর্শ দিয়েছিলেন।
মঙ্গলবার দেওয়া সাক্ষাৎকারে এই কিছু যুক্তি তুলে ধরেন ফরহাদ মজহার। তিনি বলেন, গণঅভ্যুত্থানের কারণে এই সরকার সাংবিধানিকভাবেও বৈধ না। কেননা বিগত সংবিধানে তো এমন সরকারের অস্তিত্বই নেই। যে কারণে এই ঘোষণা দেওয়ার আইনি বৈধতা নিয়েও তার প্রশ্ন।
ফরহাদ মজহার বলছেন, ‘সরকার রাজনৈতিক দলের সাথে কথা বলে নতুন দেশ তৈরি করার কথা বলছে। কিন্তু তারা কিসের শক্তি বলে এই কথা বলছে? তাদের তো রাজনৈতিক বৈধতাও নাই।’
তিনি বলেন, ‘ছাত্ররা ঘোষণাপত্র দেওয়ার কথা বললে সরকারের উচিত ছিল ছাত্ররা যে প্রস্তাবটা দিচ্ছে সেটা শোনা। পাঁচই আগস্টের যে ঘোষণাটা তারা না দিয়ে তারা যে সংবিধানের ভেতর এটাকে ঢুকিয়ে ফেললেন, সেটাকে শুধবার পথ হিসেবে এটাকে নিতে পারতো সরকার।’
শেষ পর্যন্ত ছাত্রদের ঘোষণাপত্র কর্মসূচি থেকে সরে আসার বিষয়টিকে কীভাবে দেখছেন তিনি? জবাবে ফরহাদ মজহার পাল্টা প্রশ্ন রাখেন, ‘তাহলে ছাত্ররা কি করবে? রক্তপাত করবে? ওরা কি গৃহযুদ্ধ লাগাবে? পরে এর দায় কে নিবে? তারা তো ঠিকই করে তাদের বুদ্ধিতে যেটুকু কুলিয়েছে তাই-ই করেছে।’
‘আমরা যদি আইনি জায়গা থেকে প্রশ্ন করি সরকার কারা? ছাত্ররা তো এই সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। যারা তাদেরকে বসিয়েছে তাদের ওপর তো খবরদারি করছেন, এটা কী হয়?’ যোগ করেন তিনি।
Bangla Outlook