- আশরাফুল ইসলাম
- ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০১:০৯, আপডেট: ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১:১১
দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টির অন্যতম প্রধান মাধ্যম বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ তলানিতে নেমে গেছে। নতুন ঋণ বাড়ছে না বললেই চলে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, অর্থবছরের প্রথম মাসেই অর্থাৎ জুলাইতে তা এক অঙ্কের ঘরে নেমে এসেছে। জুলাইতে বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ, যেখানে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ দশমিক ৯ শতাংশ। অথচ গত জুনেও এ প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ৫৭ শতাংশ।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বৈশ্বিক পরিস্থিতিতে ঋণ চাহিদা কমে যাওয়া, ডলার সঙ্কট খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ঋণ দেয়ার সক্ষমতা কমে যাওয়াই এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। তারা আশঙ্কা করছেন, বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ বাড়াতে না পারলে বর্ধিত হারে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে হবে না। এতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়াসহ অর্থনীতি নানামুখী সঙ্কটের মুখে পড়তে পারে।
ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, ডলার সঙ্কট দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসছে। গ্রাহকদের চাহিদা অনুযায়ী এলসি খোলা যাচ্ছে না। এতে কমে গেছে পণ্য আমদানি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত জুন শেষে পণ্য আমদানির জন্য এলসি খোলার হার কমেছে প্রায় সাড়ে ৩৩ শতাংশ। জুলাইতেও কমে যাওয়ার ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি ও এর কাঁচামাল আমদানি কমে যাওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে। এর সামগ্রিক প্রভাব পড়েছে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে।
অপর দিকে ডলার সঙ্কটের কারণে এলসি খুলতে না পারলেও বকেয়া এলসির দায় পরিশোধ করতে অনেক ব্যাংকই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্বারস্থ হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার রিজার্ভ থেকে নগদ টাকায় ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করেছে। বিদায়ী অর্থবছরে এমন প্রায় সাড়ে ১৪ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর বিপরীতে বাজার থেকে নগদ দেড় লাখ কোটি টাকার ওপরে তুলে নিয়েছে। পাশাপাশি ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে অনেকেই তা পরিশোধ করছেন না। এতে বেড়ে গেছে খেলাপি ঋণ। ব্যাংকগুলো যে পরিমাণ খেলাপি ঋণ দেখাচ্ছে প্রকৃত হিসেবে তার চেয়েও অনেক বেশি বলে জানিয়েছেন কয়েকজন ব্যাংকার। আবার ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর বেশির ভাগেরই মূলত ঋণকার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। এক দিকে ঋণের অর্থ ফেরত পাচ্ছেন না, অপর দিকে যারা এসব প্রতিষ্ঠানে আমানত রেখেছেন তাদের টাকা উত্তোলনের চাপ। সবমিলেই ব্যাংকগুলোর ঋণ দেয়ার সক্ষমতা কমে গেছে। আর এ কারণেই বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহে ভাটা পড়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বর্তমানে যে পরিমাণ প্রবৃদ্ধি দেখানো হচ্ছে, প্রকৃতপক্ষে নতুন ঋণ বিতরণের চিত্র আরো করুন। কারণ ব্যাংকগুলোর ঋণের অর্থ ফেরত না এলেও সুদে আসলে ওই ঋণ পরের বছরে প্রদর্শন হয়। এভাবেই নতুন ঋণের পরিমাণ হিসাব করলে তার হার অনেক কমে যায়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাই শেষে বেসরকারি খাতে ব্যাংকগুলোর ঋণস্থিতি দাঁড়িয়েছে ১৪ লাখ ৮৫ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা। কিন্তু এর আগের মাসেও ১৪ লাখ ৯৪ হাজার ৯৯ কোটি টাকা ঋণ পেয়েছিল বেসরকারি খাত। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানেই ঋণ বিতরণ ৮ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা কমেছে। তবে আগের বছরের জুলাই মাসে যে ঋণ বিতরণ হয় তার চেয়ে ৯ দশমিক ৮২ শতাংশ বেশি ঋণ পেয়েছে বেসরকারি খাত। কারণ ২০২২ সালের জুলাইয়ে ১৩ লাখ ৫২ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকার ঋণ নিয়েছিলেন বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা।
ব্যাংকাররা জানান, যেকোনো ঋণের মোট অঙ্ক বা স্থিতি আগের বছরের সুদসহ হিসাব হয়। ফলে আগের বছরের তুলনায় প্রকৃত বা নিট ঋণের পরিমাণ কোনো বিতরণ ছাড়াই পরের বছর বৃদ্ধি পায়। সুদ যুক্ত হওয়ার পরেও এবার বেসরকারি ঋণ কমে গেছে। অর্থাৎ বেসরকারি খাতে নতুনভাবে কোনো ঋণই বিতরণ হচ্ছে না।
২০২২-২৩ অর্থবছরের শেষ মাস জুনেও লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হয়নি বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধিতে। সমাপ্ত অর্থবছরের জন্য ১৪ দশমিক ১০ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু গত বছরের মাসের কোনোটিতেই সে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি ব্যাংক খাত। তথ্য বলছে, বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি ধারাবাহিকভাবে কমছে। গত জুন শেষে প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে ১০ দশমিক ৫৭ শতাংশ। আগের মাস শেষে যা ১১ দশমিক ১০ শতাংশ ছিল। আর গত বছরের জুন শেষে ছিল ১৩ দশমিক ৬৬ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, অভ্যন্তরীণ ঋণে প্রবৃদ্ধি থাকলেও কমে যাচ্ছে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণ। গত জুলাই শেষে বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণ কমে ১ হাজার ৩৩৮ কোটি ডলারে নেমেছে। গত বছরের জুন শেষে যা ছিল ১ হাজার ৭৭৫ কোটি ডলার। এর মানে ১ বছরে কমেছে ৪৩৭ কোটি ডলার বা ২৪ দশমিক শূন্য ৬১ শতাংশ। এর আগে প্রায় প্রতি বছর ঋণ একটু করে বাড়ছিল। বিশেষ করে করোনার মধ্যে ব্যাপক বেড়ে যায়। ২০২০ সাল শেষে স্বল্পমেয়াদি বিদেশী ঋণ ছিল ৯১৩ কোটি ডলার। এক বছরে ৬৩৩ কোটি ডলার বা ৬৯ দশমিক ২৮ শতাংশ বেড়ে ২০২১ সাল শেষে হয় ১ হাজার ৫৪৬ কোটি ডলার। বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি ঋণের বাইরে গত মার্চ পর্যন্ত মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি বিদেশী ঋণ রয়েছে আরো ৮১০ কোটি ডলার। মূলত সুদ অনেক বেড়ে যাওয়া এবং নতুন ঋণ পাওয়া দুরূহ হওয়ায় বিদেশী ঋণ কমছে।