সাবেক সেনাপ্রধানের ওপর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা এবং সাবেক পুলিশপ্রধানের সম্পদ জব্দে আদালতের আদেশকে বর্তমান সরকারের সময়ে ‘দুর্নীতি’ ও ‘ক্ষমতার অপব্যবহারের’ বড় প্রকাশ হিসেবে দেখছে বিএনপি। দলটির নেতারা বলছেন, এই দুজন সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় ক্ষমতার চূড়ান্ত অপব্যবহার করেছেন। ঘটনাক্রমে এগুলো এখন সামনে আসছে।
অন্যদিকে ঝিনাইদহ-৪ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম ১৩ মে ভারতের কলকাতায় খুন হন। ঘটনার তদন্ত সূত্রে বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলা হচ্ছে, সীমান্তে অবৈধ ব্যবসা, পাচার ও সোনা চোরাকারবারি চক্রের সঙ্গে দ্বন্দ্বের জেরে তাঁকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়। খুনের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে যাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে নানা পর্যায়ে অপরাধের অভিযোগ রয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, অতীতে তাঁদের অনেকে খুনের ঘটনায় জড়িত অভিযোগে দীর্ঘ সময় কারাবন্দী ছিলেন। এই সরকারের সময়ে ছাড়া পেয়ে কেউ কেউ সরকারি দলে যোগ দেন।
বিএনপির নীতিনির্ধারণী নেতারা এই তিন ঘটনাকে বর্তমান সরকারের সময়ে অরাজকতাপূর্ণ পরিস্থিতির বহিঃপ্রকাশ বলেও মনে করছেন। তাঁরা বলছেন, সাবেক সেনাপ্রধান এবং পুলিশপ্রধান যে সরকারের ছত্রচ্ছায়ায় ক্ষমতার অপব্যবহার করে কী ধরনের ভূমিকা রেখেছেন, তা সবাই জানতেন। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও তা প্রকাশিত হয়েছে।
যদিও সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদের অবৈধ সম্পদ অর্জন বা তাঁর সম্পদ জব্দ করতে এখন আদালতের যে নির্দেশ, সেটি কতটুকু এগোবে—তা নিয়ে বিএনপির নেতাদের মধ্যে সংশয় আছে। তাঁরা বলছেন, এই দুজন যা করেছেন, তা সরকারের ছত্রচ্ছায়ায়। এখন তাঁদের বিষয়ে সরকার বৈরী বা কঠোরতা দেখাতে গেলে দুটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের ওপর এর একটি প্রভাব পড়বে। সেই ঝুঁকি হয়তো সরকার নেবে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, আজিজ আহমেদ বা বেনজীর আহমেদ থেকে সরকারের প্রাপ্তি রয়েছে। সে জন্য সরকার তাঁদের ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখেছে। এখন সিনসিয়ারলি (নিষ্ঠার সঙ্গে) তাঁকে (বেনজীর) আইনের আওতায় আনবে, সরকারের তো সেই নৈতিক জায়গায় যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ, তারাই তো এঁদের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধাগুলো নিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করেছে। এখন তাঁদের বিপদে খড়্গ হয়ে দাঁড়াবে, এটা বিশ্বাস করার কারণ নেই। এখন সরকার কী আচরণ করে, সেটি দেখার বিষয়।
তবে এ বিষয়ে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও কর্মীদের ভিন্নমতও আছে। তাঁদের অনেকে মনে করেন, এ ধরনের অপরাধ ধামাচাপা দেওয়া বা এড়ানোর চেষ্টার একটা ঝুঁকি আছে। এতে আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর একটি অংশ থেকে সরকার আরও চাপে পড়বে, আরও বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে। নির্বাচনের পর যুক্তরাষ্ট্রের এই নিষেধাজ্ঞার পেছনে রাজনৈতিক বার্তা আছে।
এ বিষয়ে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি মনে করি, সাবেক সেনাপ্রধানের ওপর নিষেধাজ্ঞার ভিন্ন বার্তা আছে। তা হচ্ছে, বাংলাদেশের বিষয়ে তারা (যুক্তরাষ্ট্র) অবস্থান বদলায়নি। আবার এই নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের অবনতি ঘটানোর প্রশ্নে প্রাতিষ্ঠানিক সংকেতও দেওয়া হয়েছে।’
গত বৃহস্পতিবার ঢাকার একটি আদালত পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ এবং তাঁর স্ত্রী ও মেয়ের নামে থাকা স্থাবর সম্পদ জব্দ (ক্রোক), একই সঙ্গে তাঁদের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করার নির্দেশ দেন। আইজিপি হওয়ার আগে বেনজীর ঢাকা মহানগর পুলিশের কমিশনার ও র্যাবের মহাপরিচালক ছিলেন। তিনিসহ র্যাবের সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। সাতজনের ওপর যুক্তরাষ্ট্র যখন এ নিষেধাজ্ঞা দেয়, তখন পুলিশের আইজি ছিলেন বেনজীর।
অন্যদিকে দুর্নীতিতে সম্পৃক্ততার অভিযোগে গত সোমবার সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। আজিজ আহমেদ ২০১৮ সালের ২৫ জুন থেকে ২০২১ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবমূল্যায়ন এবং সরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রক্রিয়ার ওপর জনগণের আস্থা কমেছে।
বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো মূলত প্রতিষ্ঠান হিসেবে সেনাবাহিনী ও পুলিশের ওপর আস্থাশীল থাকার আকুতি প্রকাশ করে আসছে। সাবেক সেনাপ্রধানের ওপর নিষেধাজ্ঞার পর বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এটাকে দেশের জন্য লজ্জাজনক বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি এর জন্য সরকারকে দায়ী করে বলেছেন, তারা সেনাবাহিনীকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করার চেষ্টার কারণে এ ঘটনা ঘটেছে।
সরকারবিরোধী রাজনৈতিক কর্মীরা মনে করছেন, পুলিশপ্রধানের পর এখন সাবেক সেনাপ্রধানের ওপর নিষেধাজ্ঞার মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের দুটি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে নেতিবাচক বার্তা যাবে। একই সঙ্গে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দল ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্মকর্তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি এবং নানা ধরনের অপরাধে সম্পৃক্ততার বিষয়টি সামনের দিকে আরও বড় করে আসবে।
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সরকার দেশে ভোট ছাড়া ক্ষমতা কুক্ষিগত করার যে রাজনৈতিক বন্দোবস্তি কায়েম করেছে, তাতে সাবেক সেনাপ্রধান ও সাবেক পুলিশপ্রধান, সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, রাজনৈতিক দলের নেতাদের অবাধে দুর্নীতির সুযোগ করে দিয়েছে। তার প্রকাশ আমরা দেখতে পাচ্ছি। ভোটাধিকারের সংগ্রামে জয়ী হয়ে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়া ছাড়া এ অবস্থা বদলানোর আর কোনো সুযোগ নেই।’
prothom alo