- ড. মাহবুবা রহমান
- ০৭ জানুয়ারি ২০২৩, ২০:২৩
বেগম রোকেয়া একজন ইসলামী চিন্তাবিদ ও ধার্মিক মহিলা ছিলেন। তার প্রবন্ধগুলো পড়লে দেখতে পাওয়া যাবে, তিনি কিভাবে চরম বিপদের সময় মহান আল্লাহকে অন্তর দিয়ে ডেকেছেন। তিনি বলতেন, যদি আমাকে আল্লাহ রক্ষা করেন তখন পৃথিবীর কেউ আমাকে কিছু করতে পারবে না। শিক্ষার অভাবে মুসলমান সমাজ নানাবিধ কুসংস্কার- জালে জড়িয়ে পড়ে। ইসলামের মূল আদর্শ সাম্যবাদ ও ভ্রাতৃত্বের নীতি থেকে ভারতীয় মুসলিম তথা বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায় তখন অনেক দূরে সরে যায়। ধর্মীয় অনুশাসনের বিকৃত ব্যাখ্যার প্রসার ছিল ব্যাপক। আর সত্যিকার সাহসী সংস্কারের অভাব ছিল প্রকট।
সেই সময় বেগম রোকেয়া সত্যিকার অর্থে একজন ইসলামী চিন্তাবিদ, সমাজ সংস্কারক ও মহৎ শিক্ষাবিদের দায়িত্ব পালন করেন। তার সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে, মুসলিম মহিলাদের কুসংস্কারের অন্ধকার থেকে আলোতে টেনে আনা, যাকে ইসলামের মূল শিক্ষা বলে মনে করা হয়।
বিশ্বাসী নারী : বেগম রোকেয়া তার লেখনীতে নারী-পুরুষকে ইসলামের মৌল ধারার দিকে নিয়ে আসতে আহ্বান জানিয়েছেন; দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, কিভাবে ধর্মকে হৃদয়ে ধারণ করে এগিয়ে যেতে হবে। তার লেখনী দেখে সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়, তিনি প্রচণ্ড আল্লাহভক্ত ও ইসলামের প্রতি পূর্ণ আস্থাশীল নারী ছিলেন। অবরোধবাসিনীতে আমরা দেখতে পাই, তিনি বিভিন্ন স্থানে মহান রাব্বুল আলামিনকে অত্যন্ত সম্মানজনক ভাষায় স্মরণ করেছেন; দুর্দশাগ্রস্ত নারীসমাজের মুক্তির জন্য মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেছেন; ইনশাআল্লাহ বলা, কারো মৃত্যুতে ইন্নালিল্লাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন পড়া, সোবহান আল্লাহ বলা। ‘পঁয়ত্রিশ মন খানা’ ছোট গল্পে তিনি বলেন শুকুর আলহামদুলিল্লাহ, ইত্যাদি। অন্যত্র ‘পদ্মরাগ’ উপন্যাসে তিনি বলেন-
‘তামাম জাহান যদি হয় এক দিকে,
কি করিতে পারে তার আল্লাহ যদি থাকে।’
বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ বেগম রোকেয়ার অত্যন্ত প্রিয় একজন ছাত্রী ছিলেন। তিনি তার ‘রোকেয়া জীবনী’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, তৎকালীন সমাজে স্কুলের কাজ করতে গিয়ে বেগম রোকেয়াকে নানা প্রকার সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এ প্রসঙ্গে তিনি বলতেন, ‘স্কুলের বিরুদ্ধে কত দিকে কত প্রকার ষড়যন্ত্র চলিতেছে তাহা একমাত্র আল্লাহ জানেন। একমাত্র ধর্মই আমাদিগকে বরাবর রক্ষা করিয়া আসিতেছে।’ অন্যত্র স্কুলের ১৮ বছর পূর্তিতে তিনি বলেন, “…. আমরা তোমারই উপাসনা করি এবং তোমারই সাহায্য প্রার্থনা করি- কুরআন শরিফের এই বচনটিই আমি জীবনের পরতে পরতে সত্য বলিয়া উপলব্ধি করিলাম।’
এই পুণ্যশীলা মহীয়সী মহিলার সাখাওয়াৎ মেমোরিয়াল স্কুলের অন্য এক পুরাতন ছাত্রী তার বহু যত্ন ও সাধনায় গঠিত এক আদর্শ বালিকা রওশন আরা বলেন, ‘মনে পড়ে, তার আদেশ মতো দৈনিক ক্লাস আরম্ভের আগে বিস্তীর্ণ হলে আমরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়াইতাম। তিনি একটি দোয়া পড়িতেন, আমরা সকলে তার সঙ্গে যোগ দিতাম। ওই দোয়াটি তিনি যখন পড়িতেন, তখন মনে হইত যেন তিনি হৃদয় দিয়া আমাদের সেদিনের সাফল্যের জন্য খোদাকে ডাকিতেন। সে যে কি গভীর আন্তরিকতাভরা আবেদন, তাহা বুকের মধ্যে অনুভব করা যায়- মুখে বলা যায় না!’
বেগম রোকেয়া তার ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে বলেন, “এখন মুসলমান সমাজে প্রবেশ করা যাউক। মুসলমানের মতে আমরা পুরুষের ‘অর্ধেক’ অর্থাৎ দুইজন নারী একজন নরের সমতুল্য। অথবা দুইটি ভ্রাতা ও একটি ভগিনী একত্র হইলে আমরা ‘আড়াইজন’ হই! আপনারা ‘মহম্মদীয় আইনে’ দেখিতে পাইবেন যে, বিধান আছে, পৈতৃক সম্পত্তিতে কন্যা-পুত্রের অর্ধেক ভাগ পাইবে। এ নিয়মটি কিন্তু পুস্তকেই সীমাবদ্ধ। যদি আপনারা একটু পরিশ্রম স্বীকার করিয়া কোনো ধনবান মুসলমানের সম্পত্তি বিভাগ করা দেখেন, কিংবা জমিদারি পরিদর্শন করিতে যান, তবে দেখিবেন, কার্যত কন্যার ভাগে শূন্য (০) কিংবা যৎসামান্য পড়িতেছে।”…. যদি ধর্মগুরু মোহাম্মদ সা: আপনাদের হিসাব-নিকাশ লয়েন যে, ‘তোমরা কন্যার প্রতি কিরূপ ন্যায় ব্যবহার করিয়াছ?’ তবে আপনারা কি বলিবেন?… তাই তিনি দুঃখ করে বলেন, আহা! তিনি নাই বলিয়া আমাদের এ দুর্দশা।”
মুসলিম সমাজে নারীরা উত্তরাধিকার সম্পদের মালিক। কিন্তু নারীর উত্তরাধিকারের প্রতি শতভাগ অবহেলা দেখে তিনি মতিচূরের (প্রথম খণ্ড) ‘গৃহ’ প্রবন্ধে মহানবী সা:- কে এভাবে ডেকেছেন, ‘হায় মোহাম্মদ সা:! তুমি আমাদের উপকারের নিমিত্ত পিতৃ সম্পত্তিতে অধিকারিণী করিয়াছ, কিন্তু তোমার সুচতুর শিষ্যরা নানা উপায়ে কুলবালাদের সর্বনাশ করিতেছে! আহা! ‘মহম্মদীয় আইন’ পুস্তকের মসি-রেখারূপে পুস্তকেই আবদ্ধ থাকে। টাকা যার, ক্ষমতা যার, আইন তাহারই। আইন আমাদের ন্যায় নিরক্ষর অবলাদের নহে।’
রোজা মুসলমানদের পাঁচটি স্তম্ভের অন্যতম। এই মর্মে মহান আল্লাহ সবাইকে সংযমী হয়ে চলতে বলেছেন; বেশি বেশি করে সাহায্য করতে বলেছেন এবং ফেতরা দিতে বলেছেন। বেগম রোকেয় তার ‘রসনাপূজা’ প্রবন্ধে বলেন, ‘মহাত্মা মোহাম্মদ সা: হয়তো বলিয়াছিলেন যে, রোজার সময় আহার পরিমিত করায় যে খরচ বাঁচিয়া যায়, তাহা দ্বারা আপন দরিদ্র প্রতিবেশীর সাহায্য করো (ফেতরা দাও); কিন্তু বঙ্গীয় মোসলেমরা তাহার ভক্তশিষ্য, তাই উল্টা চাল চালেন; তাহার উপদেশের বিপরীত কার্য করেন। সুতরাং অন্যান্য মাসের ব্যয় অপেক্ষা রমজান মাসে তাহাদের ব্যয় বৃদ্ধি হয়। আমার এই কথা প্রমাণিত করিবার জন্য অন্য কোনো দলিলের প্রয়োজন নাই- পাঠিকারা আপন আপন জমা-খরচ মিলাইয়া দেখিবেন, অন্যান্য মাসের তুলনায় রমজান শরিফের খরচ বেশি কিনা।’ এভাবে মহানবী সা:-কে তিনি স্মরণ করেছেন বারবার।
কুরআনের মাহাত্ম্য ও অধ্যয়নের তাগিদ : আগেই উল্লেখ করেছি, তিনি ইসলাম ধর্মে একজন বিশ্বাসী মহিলা ছিলেন এবং কুরআন-সুন্নাহর সত্যিকার প্রয়োগ ও বিধানের প্রতি তার অগাধ শ্রদ্ধা ছিল। নিম্নে তার লেখনী থেকে কয়েকটি উদাহরণ দিলেই তা পরিষ্কার হয়ে যাবে-
মতিচূরের (প্রথম খণ্ড) ‘অর্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘আমাদের জন্য এ দেশে শিক্ষার বন্দোবস্ত সচরাচর এরূপ-প্রথমে আরবীয় বর্ণমালা, অতঃপর কুরআন শরিফ পাঠ। কিন্তু শব্দগুলোর অর্থ বুঝাইয়া দেয়া হয় না, কেবল স্মরণশক্তির সাহায্যে টিয়াপাখির মতো আবৃত্তি করো।’
মতিচূরের (দ্বিতীয় খণ্ড) ‘সৌরজগৎ’ প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘গও। আমিও সহঙ্কারে বলি, তোমার স্ত্রীর বিশ্বাস (ঈমান) টলিতে পারে কিন্তু আমার স্ত্রীর বিশ্বাস অটল!
জাফ। আমার স্ত্রীর বিশ্বাস অস্থায়ী হইল কিসে?
গও। যেহেতু তিনি আপন ধর্মের কোনো তত্ত্বই অবগত নহেন। কেবল টিয়াপাখির মতো নামাজ পড়েন, কোনো শব্দের অর্থ বুঝেন না। তাহাকে যদি তুমি স্বর্ণপিঞ্জিরে আবদ্ধ না রাখো, তবে একবার কোনো মিশনারি মেমের সহিত দেখা হইলেই তিনি মনে করিবেন ‘বা:! যিশুর কি মহিমা!’ সুতরাং সাবধান! যদি পার তো লৌহসিন্দুকে বন্ধ রাখিও।
মতিচূরের (দ্বিতীয় খণ্ড) ‘নার্স নেলী’ প্রবন্ধে সত্যিকার গল্পেও তিনি উপরে সৌরজগৎ প্রবন্ধের আশঙ্কার বাস্তবতা দেখিয়েছেন। ‘নার্স নেলী ছিল কুলীন মুসলিম। অসুস্থতার সময় এ গেরস্থ ঘরের বউকে ‘পাদ্রীমাগীরা ফুসলিয়ে খ্রিষ্টান করে ওকে ঘরের বার করেছে।’ তার আগের নাম বদলে নেলী রাখা হয়েছে। পরবর্তীতে জানা যায় ‘নেলী নাকি দিব্বি কুরআন পড়তে পারে।’ তখন লেখিকার নিজের অনুভূতি নিম্নরূপ ছিল, ‘নেলী কোরান শরীফ পাঠ করিতে পারে শুনিয়া আমার মনে আরো কেমন খট্কা লাগিল। না জানি, সে কোন মুসলমান কুলে কালী দিয়া পতিত হইয়াছে! হায়! কোরান শরীফের এই অবমাননা। খ্রিষ্টান নেলী, মেথরানী নেলী যে হস্তে ঘৃণিত রক্ত পুঁজ পরিপূর্ণ বালতি পরিষ্কার করে, সেই হস্তে কোরান শরীফ স্পর্শ করে।’ কার্যত নেলী এখানে মেথরের কাজ করে, কিন্তু হাসপাতালের কর্ত্রীগণ তাহাকে নার্স বলিয়া ডাকেন।
শামসুন নাহার মাহমুদ তার রোকেয়া জীবনী গ্রন্থে বলেন, কতবার তাঁহাকে বলিতে শুনিয়াছি, ‘শৈশব হইতে আমাদিগকে কোরান মুখস্থ করানো হয়, কিন্তু শতকরা নিরান্নব্বই জন তাহার একবর্ণেরও অর্থ বলিতে পারে না। যাঁহারা অর্থ শিখিয়াছেন, তাঁহারাও শোচনীয়রূপে ভ্রান্ত। ইসলামের মর্ম তাঁহাদের কাছে এক বর্ণও ধরা পড়ে নাই, ইহার চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কি হইতে পারে :’ এই প্রসঙ্গে তিনি একটি সুন্দর উপমা দিতেন। তিনি বলিতেন ‘নারিকেলের চমৎকার স্বাদ তাহার দুর্ভেদ্য আরোপের ভিতরে আবদ্ধ। অন্ধ মানুষ সেই কঠিন আবরণ ভেদ করিবার চেষ্টা না করিয়া সারাজীবন শুধু ত্বকের উপরিভাগটাই লেহন করিয়া মরিল।
বঙ্গীয় নারী-শিক্ষা সমিতি-এর সভানেত্রীর অভিভাষণে বলেন, ‘মুসলমান বালিকাদের প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে কোরান শিক্ষাদান করা সর্বাপেক্ষা অধিক প্রয়োজন। কোরান শিক্ষা অর্থে শুধু টিয়া পাখীর মত আরবী শব্দ আবৃত্তি করা আমার উদ্দেশ্য নহে। বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষায় কোরানের অনুবাদ শিক্ষা দিতে হইবে। সম্ভবত এজন্য গভর্নমেন্ট বাধ্যতামূলক আইন পাশ না করিলে আমাদের সমাজ মেয়েদের কোরান শিক্ষাও দিবে না! যদি কেহ ডাক্তার ডাকিয়া ব্যবস্থাপত্র লয়, কিন্তু তাহাতে লিখিত ঔষধ-পথ্য ব্যবহার না করিয়া সে ব্যবস্থাপত্রখানাকে মাদুলীরূপে গলায় পরিয়া থাকে, আর দৈনিক তিনবার করিয়া পাঠ করে, তাহাতে কি সে উপকার পাইবে? আমরা পবিত্র কোরান শরীফের লিখিত ব্যবস্থা অনুযায়ী কোন কার্য করি না, শুধু তাহা পাখির মত পাঠ করি আর কাপড়ের থলিতে (জুযদানে) পুরিয়া অতি যত্নে উচ্চ স্থানে রাখি।’
এ থেকে বুঝা যায় যে, তিনি শুধু কুরআন তিলাওয়াত সমর্থন করতেন না, বরং তার অর্থ হৃদয়ঙ্গম করা জরুরি মনে করতেন যাতে লোকেরা কোরানকে জীবনে ও সমাজে প্রয়োগ করতে পারে। এমনকি তিনি কুরআন শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার জন্য একটি আইনের পক্ষে ছিলেন। তিনি শুধু নারীদের কুরআন বুঝে পড়ার কথা বলেই ক্ষান্ত হননি, এক্ষেত্রে পুরুষদের দৈন্যদশাও ব্যক্ত করেছেন, ‘কিছু দিন হইল, মিসর হইতে আগত বিদুষী মহিলা মিস যাকিয়া সুলেমান এলাহাবাদে এক বিরাট মুসলিম সভায় বক্তৃতাদানকালে বলিয়াছিলেন, ‘উপস্থিত যে যে ভদ্রলোক কোরানের অর্থ বুঝেন, তাঁহারা হাত তুলুন। তাহাতে মাত্র তিনজন ভদ্রলোক হাত তুলিয়াছিলেন। কোরান-জ্ঞানে যখন পুরুষদের এইরূপ দৈন্য। তখন আমাদের দৈন্য যে কত ভীষণ, তাহা না বলাই ভালো।’
পরিশেষে তিনি বলেন, ‘আমার অমুসলমান ভগিনীগণ! আপনার কেহ মনে করিবেন না যে, প্রাথমিক শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে কোরান শিক্ষা দিতে বলিয়া আমি গোঁড়ামীর পরিচয় দিলাম। তাহা নহে, আমি গোঁড়ামী হইতে বহুদূরে। প্রকৃত কথা এই যে, প্রাথমিক শিক্ষা বলিতে যাহা কিছু শিক্ষা দেওয়া হয়, সে সমস্ত ব্যবস্থাই কোরানে পাওয়া যায়। আমাদের ধর্ম ও সমাজ অক্ষুণ্ণ রাখিবার জন্য কোরান শিক্ষা একান্ত প্রয়োজন।’
বেগম রোকেয়ার ছোট গল্প ‘তিন কুঁড়ে’ তে আমরা দেখতে পাই একজন বোম্বায়ে মহিলা স্কুল পরিদর্শন কালে লেখিকাকে বলেন, ‘আপনারা কোরান শরীফ পড়েন কি? না, শুধু তাবিজ (হেমায়েল শরীফ) করে গলায় ঝুলিয়ে রাখেন?’
মোট কথা পবিত্র কুরআনকে বুঝে পড়ার জন্য তিনি আরবি ভাষা শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। লেখিকার বড় বোন ৬৭ বছর বয়সে রীতিমতো আরবি ভাষা শিখিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। বড়বোন করিমুন্নেসার এক চিঠি রোকেয়া তার ‘লুকানো রতন’ (রো-র পৃ: ২৮৭)- এ উদ্ধৃত করেছেন এভাবে, ‘মন্ত্রপাঠের মতো কোরানের বুলি আবৃত্তি করিয়া তৃপ্তি হয় না, তাই আমি যথাবিধি আরবি পড়িতেছি।’
নৈতিক শিক্ষা হচ্ছে, একটা জাতির মেরুদণ্ড। যে জাতির মধ্যে নৈতিক শিক্ষা নাই সে জাতি বেশি দিন পৃথিবীর বুকে টিকে থাকতে পারে না।
বেগম রোকেয়ার সবচেয়ে বড় স্বপ্ন ছিল বাঙালি মুসলিম সমাজকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা। মহানবী সা: মুসলিম উম্মাহকে কুরআনের নির্দেশানুযায়ী চলার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু বাঙালি মুসলিম সমাজ পবিত্র কুরআনের নির্দেশ থেকে সরে গিয়ে নিজেদের মতানুযায়ী মুসলিম নারী সমাজকে তাদের প্রকৃত অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। তাই তিনি ধ্বংসের পথে বঙ্গীয় মুসলিম প্রবন্ধে চমৎকার করে তুলে ধরেছেন মুসলিম সমাজের অধঃপতনের কথা। তিনি অত্যন্ত গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, আমাদের নৈতিক ও সামাজিক অধঃপতনের একমাত্র কারণ হচ্ছে, আমরা পবিত্র কুরআনের নির্দেশ সঠিকভাবে পালন করছি না। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ঘোষণা দিয়েছেন, একজন মানুষকে জন্ম থেকে শুরু করে মৃত্যু পর্যন্ত কিভাবে চলতে হবে। বেগম রোকেয়া তাঁর ‘ধ্বংসের পথে বঙ্গীয় মুসলিম’ প্রবন্ধে বলেন, ছেলে বেলায় আমি মার মুখে শুনতুম, ‘কোরান শরীফ ঢাল হয়ে আমাদের রক্ষা করবে।’ সে কথা অতি সত্য; অবশ্য তার মানে এ নয় যে, খুব বড় আকারের সুন্দর জেলদ বাঁধা কোরআন খানা আমার পিঠে ঢালের মত করে বেঁধে নিতে হবে। বরং আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে আমি এই বুঝি যে, কোরআন শরীফের সার্বজনীন শিক্ষা আমাদের নানা প্রকার কুসংস্কারের বিপদ থেকে রক্ষা করবে। কোরআন শরীফের বিধান অনুযায়ী ধর্ম-কর্ম আমাদের নৈতিক ও সামাজিক অধঃপতন থেকে রক্ষা করবে।’ আলহামদুলিল্লাহ। যদি মুসলিম সমাজ বেগম রোকেয়ার মতো পবিত্র কুরআনের মর্ম উপলব্ধি করতে পারত, তাহলে মুসলিম উম্মাহ পৃথিবীকে শান্তিময় করে তুলতে পারত।
কিন্তু এখন আমরা বর্তমান সমাজের দিকে তাকালেই দেখতে পাব, আমাদের মাঝে নৈতিকতার বড় অভাব যার পরিণাম স্বরূপ আমাদের সমাজের মধ্যে বিরাজ করছে নানা রকম অশান্তি, বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, হত্যা, ইত্যাদি। তা আমাদের সমাজকে দ্রুত অধঃপতনের দিকে ধাবিত করছে। তাই ইসলামী চিন্তাবিদ বেগম রোকেয়ার কণ্ঠের সাথে সুর মিলিয়ে বলছি, বেগম রোকেয়ার কর্ম ও আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে আমরাও যদি পবিত্র কুরআন অর্থ ও তাফসিরসহ শিক্ষা গ্রহণ করে আমাদের জীবনে তা যথাযথভাবে বাস্তবায়িত করতে পারি, তাহলে আমরাও আমাদের দেশ ও জাতিকে নৈতিক ও সামাজিক অধঃপতন থেকে রক্ষা করতে পারব, ইন্শাআল্লাহ।
লেখক : সাবেক বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, লালমাটিয়া মহিলা কলেজ, ঢাকা