- ড. আবদুল লতিফ মাসুম ০২ এপ্রিল ২০২০
একরকম আকস্মিকভাবেই বেগম খালেদা জিয়া মুক্তি পেয়েছেন। সরকারের এ উদ্যোগ সম্পর্কে আগে থেকে অনুমান করা যায়নি। সবাই যখন হতাশ, তখন খুবই গোপনীয়তা বজায় রেখে সরকারপ্রধান তার সিদ্ধান্ত কার্যকর করেন। টানা দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে কারাভোগের পর অবশেষে সরকারের নির্বাহী আদেশে মুক্তি পেয়েছেন তিনি। গত সপ্তাহে, ২৫ মার্চ বিকেলে তিনি রাজধানীর বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসারত অবস্থায় মুক্তি পান। এই দীর্ঘ সময়ে তার মুক্তির জন্য আইনি লড়াইয়ে কোনো কসুর করেনি বিএনপি নেতৃত্ব ও বিগম খালেদা জিয়ার পরিবার। সাধারণত এ ধরনের অবস্থায় অর্থাৎ রাজনৈতিক কারণে যারা বন্দী হন তারা রাজনৈতিকভাবেই মুক্তি পান। সবাই জানেন ও বোঝেন যে, অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি ছিল গৌণ। আর রাজনৈতিক কারণটিই ছিল মুখ্য।
তার কারণ বেগম খালেদা জিয়া এবং তার পরিবার হচ্ছে শাসকগোষ্ঠীর একমাত্র চ্যালেঞ্জ। শক্তি মদমত্ততার শাসন সত্ত্বেও অনেকেরই আশা ছিল, প্রধান বিরোধী দল যেভাবেই হোক একটি গণ-আন্দোলন গড়ে তুলতে পারবে এবং দেশের মানুষের সবচেয়ে প্রিয় ব্যক্তিত্ব সম্মানজনকভাবে মুক্তি পাবেন। পত্রপত্রিকায় বেগম খালেদা জিয়ার মামলা-মোকদ্দমা নিয়ে যেসব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বের হয়েছে তাতে পর্যবেক্ষণ ছিল যে, প্রাথমিক অবস্থায় তার মুক্তির জন্য ‘আপস রফা’র সুযোগ ছিল। কিন্তু বেগম জিয়ার ‘আপসহীন’ বৈশিষ্ট্যের কারণে তা সম্ভব হয়নি। জানা যায়, তাকে ওই সময়ে বিদেশে চলে যাওয়ারও প্রস্তাব দেয়া হয়। কিন্তু তিনি দৃঢ়তার সাথে না বলেন। স্মরণ করা যেতে পারে, ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময়ে তাকে অনুরূপ প্রস্তাব দেয়া হলে তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের বাইরে আমার কোনো ঠিকানা নেই’। আর সে কারণে যিনি বিদেশে চলে গিয়েছিলেন তারও দেশে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ হয়। এখন যেভাবে তিনি মুক্তি পেলেন, তা তার পরিবারের কাছে ‘স্বস্তি’র মনে হলেও তা রাজনৈতিকভাবে ভাবনা ও দুর্ভাবনার বিষয় বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন। অবশ্য ভবিষ্যৎই শেষ কথা বলতে পারে।
বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তির পর বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। একদল বিশ্লেষক মনে করেন, তার মুক্তিতে দেশের রাজনীতিতে স্বস্তি ফিরে এসেছে। পরিবারের স্বস্তির সাথে তারা হাত মেলাতে চান। সংবাদপত্র প্রতিবেদন দিচ্ছে যে, স্বস্তি ফিরেছে দলেও। অপারগতা এবং অসহায়ত্ব ভুলে তারা এটাকে মন্দের ভালো হিসেবে গ্রহণ করছেন। রাজনৈতিক সম্ভাবনা নিয়ে এখন তারা কিছু ভাবছেন না। এখন নীতিনির্ধারকদের সব মনোযোগ খালেদা জিয়ার শরীর স্বাস্থ্যের দিকে। ফিরোজায় ফিরে যাওয়ার পর ক্রমেই তার সুস্থতার খবর আসছে। সেখানে তিনি কোয়ারেন্টিনে আছেন।
মির্জা ফখরুল ইসলামের ভাষায়- ‘উনি বাসায় এসেছেন। উনার মনে মানসিক প্রশান্তি এসেছে। সেটি দৃশ্যমানও হয়েছে। বাসায় আসার পর তিনি ভালো বোধ করছেন’। সবাই জানে যে, দু’টি শর্তে তাকে মুক্তি দেয়া হয়েছে। প্রথমত, তিনি ঘরেই থাকবেন। দ্বিতীয়ত, তিনি বিদেশ যেতে পারবেন না। তবে খালেদা জিয়ার মূল চিকিৎসক থাকেন লন্ডনে। এর আগে তার চিকিৎসা লন্ডনেই হয়েছে। সেখানে রয়েছে তার একমাত্র সন্তান তারেক জিয়া ও তার পরিবার। বলা হয়েছে, তারেক রহমানের স্ত্রী জোবায়দা রহমান লন্ডন ও ঢাকার চিকিৎসকদের সাথে সমন্বয় করবেন। তাকে লন্ডনে চিকিৎসা নেয়ার সুযোগ দেয়া উচিত। সরকার যখন এতটা মানবিক হয়েছে তখন আরেকটু মানবিক হতে দোষ কোথায়? খালেদা জিয়ার এই মুক্তি দেশের সামগ্রীক রাজনীতিতে বিশেষত বিএনপির রাজনীতিতে কোনো অবদান রাখবে কি না- এ রকম প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন কেউ কেউ। সোজাসাপটা উত্তর- না। মনে রাখতে হবে, তিনি বন্দী অবস্থায়ই আছেন। ছয় মাসের জন্য তার সাজা স্থগিত হয়েছে মাত্র। এ সময়ে আইনগতভাবে তার জন্য যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক আলোচনা, কথাবার্তা, বিবৃতি ও অংশগ্রহণ আইনসিদ্ধ নয়। ছয় মাস পরে কী হবে- ভক্ত, অনুরক্ত ও নেতাকর্মীদের জিজ্ঞাসার বিষয় এটা। স্বাভাবিকভাবে ছয় মাস পরে তার আবার কারাগারে যাওয়ার কথা। অস্বাভাবিক হলে তিনি মুক্তি পেতে পারেন। এটা হতে পারে এ ধরনের সরকারি সিদ্ধান্তে। অথবা আইনগত কোনো রক্ষাকবচের মাধ্যমেও তা হতে পারে। তবে তার সম্ভাবনা খুবই কম। এ জন্যই লাখো সাধারণ মানুষ ভাবনার চেয়ে দুর্ভাবনা করছে বেশি। আর আছে ‘আল্লাহর জন্য অপেক্ষা’। আল্লাহ ইচ্ছে করলে অনেক কিছুই করতে পারেন।
এক মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বাংলাদেশকে বলেছেন, ‘এ ল্যান্ড অব আল্লাহ জানে’। সুতরাং অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই। বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের সূত্রে জানা গেছে, এই মুহূর্তে চিকিৎসার বাইরে খালেদা জিয়াকে নিয়ে অন্য কিছু ভাবছেন না দলীয় নেতারা। শীর্ষ নেতারা নিশ্চিত করেছেন, আরোপিত শর্তের ব্যাপারে বিএনপি সতর্ক থাকবে। সরকার রুষ্ট হয়ে ভিন্ন কোনো পদক্ষেপ নিতে পারে এমন কিছু তারা করবেন না। সংবাদপত্রের ভাষ্যে বলা হয়, লিখিত চুক্তির বাইরে অলিখিত চুক্তিও থাকতে পারে। বেগম জিয়ার মুক্তির আরো অন্তর্নিহিত তাৎপর্য থাকতে পারে। আলোচনার আড়ালেও আলোচনা থাকে। সেই আলোচনায় তৃতীয় পক্ষও থাকে। কাছাকাছি থাকায় অনির্ধারিত ও অনানুষ্ঠানিক আলাপ-আলোচনায় বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব হয়তো উপকৃত হবে। এর বেশি কিছু নয়। বেগম জিয়া কারাবন্দী হওয়ার পর দলের নেতৃত্বে রয়েছেন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হিসেবে তারেক রহমান। এভাবে মুক্ত হয়ে দল পরিচালনার অধিকার রাখেন না বেগম জিয়া। তাই আইনগতভাবে পরিপূর্ণ মুক্তি অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত নেতৃত্ব তারেক জিয়ার ওপরই বর্তাবে।
এসব সম্ভাবনা ও আশাবাদের বাইরে কিছু অস্বস্তির কারণও আছে। সম্ভবত ‘নির্বাহী আদেশ’টি অস্বস্তি ও আপত্তির কারণ। ঘটনা পরম্পরা এমনভাবে অগ্রসর হয়েছে যে, তার মুক্তির বিষয়টি দেয়ালে ঠেকে গিয়েছিল। সব ধরনের আইনি প্রক্রিয়া অবলম্বন করার পরও যখন তার মুক্তি সম্ভব ছিল না, তখন সবাই গভীর হতাশায় নিমজ্জিত হন। আর এ সময় উদ্ধারকারী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে ‘করোনাভাইরাস’। এই সংবেদনশীল বিষয়টি মুক্তির পরিবেশ তৈরি করেছে এবং সরকারের সিদ্ধান্ত নিতে সহায়ক হয়েছে। মানবিক বিবেচনায় খালেদা জিয়ার মুক্তি হওয়ায় সরকারপ্রধানের মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রশংসিত হয়েছে। সাথে সাথে এটাও প্রমাণিত হয়েছে যে, দেশে আইন ও আন্দোলন অসহায় ও অসম্ভব। সামাজিক মাধ্যমে একজন প্রশ্ন তুলেছেন যে, তাহলে কি সরকারের বিরোধীরা যা বলে তাই সত্য! ব্যক্তিগত অনুরাগ অথবা বিরাগ কি সিদ্ধান্তের মাপকাঠি? এই মানবিক সিদ্ধান্তে কি যারা ইতঃপূর্বে তার জামিন নাকচ করেছে তারা কি লজ্জিত হবে না! সেখানেও মানবিক আবেদন জানানো হয়েছিল। সেই রাবিন্দ্রিক উচ্চারণটি কি পরম সত্য, ‘রাজা যত বলে পারিষদ দলে বলে তার শতগুণ’। বেগম জিয়া এই পারিবারিক ব্যবস্থা সম্পর্কে কতটা অবহিত তা-ও প্রশ্নসাপেক্ষ। আপনজনরা আবেগ থেকে অনেক কিছু করতে পারে। রাজনীতির সাথে এর সংযোগ নাও থাকতে পারে। তবে বহুল আলোচিত প্যারোলে মুক্তি নেয়ার সুযোগ থাকলেও বেগম জিয়া তা নেননি। কথিত আপসেও রাজি হননি।
এটা তার অনমনীয়তা ও আপসহীনতার প্রমাণ দেয়। অপর দিকে তার মুক্তিতে সরকারের নমনীয়তা ও মানবিকতা প্রকাশ পাওয়ায় প্রকারান্তরে তারা লাভবান হয়েছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন। আওয়ামী লীগ নেতারা ইতোমধ্যে এ মনোভাব ব্যক্ত করেছেন যে, খালেদা জিয়ার মুক্তিতে বিএনপি ও তাদের নেতাকর্মীদের কোনো কৃতিত্ব নেই। শেখ হাসিনার উদারতায় খালেদা জিয়া মুক্তি পেয়েছেন। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিতের উদ্যোগ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী দূরদর্শী নেতৃত্বের পরিচয় দিয়ে মানবিক বিবেচনায় তার অনন্য দৃষ্টান্ত উপস্থাপন করেছেন। বয়স ও অসুস্থতার কারণে খালেদা জিয়ার দণ্ড স্থগিত করে সরকারপ্রধান তাকে মুক্তি দিয়েছেন। আশা করি, বিএনপি বিষয়টি ইতিবাচক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে আমাদের সবার অভিন্ন শত্রু করোনা মোকাবেলায় সরকারের সর্বাত্মক ও সম্মিলিত উদ্যোগে সহযোগিতা করবে।’ তার মুক্তি জনারণ্যে কোনো প্রভাব সৃষ্টি করতে পারেনি। তাকে এমন একসময় মুক্তি দেয়া হলো, যখন করোনাভাইরাসের কারণে মানুষ ঘরে বন্দী হয়ে আছে। তবে তার মুক্তিক্ষণে দলীয় নির্দেশনা অমান্য করে হাজার হাজার উজ্জীবিত নেতাকর্মী খালেদা জিয়াকে একবার দেখার জন্য হাসপাতাল গেটে, তার বাসভবনে এমনকি পথে পথে ব্যাপক ভিড় জমায়। তাদের সামলাতে একপর্যায়ে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। যা হোক, অন্য সময় হলে হয়তো অন্যরকম দৃশ্য দেখা যেত।
খালেদা জিয়ার মুক্তি যে কারণে বা যে পরিস্থিতিতেই হোক না কেন, এটি একটি ইতিবাচক বিষয়। এই একটি ঘটনা রাজনৈতিক সমঝোতার সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে। প্রবাদ আছে- ভালো কাজ আরেকটি ভালো কাজের উৎসাহ জোগায়। আমাদের রাজনীতি যখন আস্থা ও বিশ্বাসের সঙ্কটে নিমজ্জিত, তখন এ ধরনের মানবিক আচরণ শত্রুতার অবসান ঘটিয়ে মিত্রতা সৃষ্টি করতে পারে। এই উদাহরণ অনাগত রাজনৈতিক সম্প্রীতির নমুনা হিসেবে গৃহীত হতে পারে। অপর দিকে, দুর্ভাবনা এই জন্য, যদি এটি কেবল রাজনৈতিক ফায়দা নেয়ার উপলক্ষ হয় অথবা বেগম জিয়ার জনপ্রিয়তা ও মর্যাদাকে খাটো করে দেখা হয়, তা আরো বড় সঙ্কটের সৃষ্টি করবে। একই সাথে বিএনপির জন্য এটি আত্মসমালোচনা ও আত্মবিশ্বাসের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। ব্যর্থতার উপলব্ধির মধ্য দিয়ে গড়ে উঠতে পারে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]