বুয়েটে ছাত্র রাজনীতির কি কোনো প্রয়োজন আছে?

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)।

২০১৯ সালে আবরার ফাহাদ নামের বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক শিক্ষার্থীকে একটি হলে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে।

এরপর শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়।

আবরার ফাহাদকে হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত সবাই ছিলেন বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র

সংগঠনের বুয়েট শাখার নেতাকর্মী।

এ ঘটনায় করা মামলার রায় হয় ২০২১ সালে।

ওই রায়ে ২০ জনকে মৃত্যুদন্ড এবং পাঁচজনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়েছেন আদালত।

আবরার হত্যাকান্ডের পর থেকে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল।

এ ঘটনার প্রায় সাড়ে চার বছর পর আবারও আলোচনায় বুয়েটে ছাত্র রাজনীতির প্রসঙ্গ।

গত ২৭ মার্চ মধ্যরাতের পর ছাত্রলীগের কিছু নেতাকর্মী বুয়েট ক্যাম্পাসে প্রবেশ করেন এবং রাজনৈতিক কার্যক্রম চালান, এমন অভিযোগ তুলেছেন শিক্ষার্থীরা।

এ ঘটনার বিরুদ্ধে আন্দোলনের অংশ হিসেবে ছাত্ররা টার্ম ফাইনাল পরীক্ষাসহ সব ধরনের একাডেমিক কার্যক্রম বর্জন করে।

আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে বুয়েটের হল থেকে ইমতিয়াজ হোসেন নামের এক শিক্ষার্থীর সিট (আসন) বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।

ইমতিয়াজ বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের ছাত্র।

তিনি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য।

আবরার ফাহাদকে হত্যার পর ২০১৯ সালের ১১ অক্টোবর ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করে যে জরুরি বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিল বুয়েট কর্তৃপক্ষ, তার বৈধতা নিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ হোসেন রিট করেছিলেন।

রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি মো. খসরুজ্জামান ও বিচারপতি কে এম জাহিদ সারওয়ারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুলসহ যে আদেশ দেন, সেখানে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দেওয়া প্রজ্ঞাপনটি স্থগিত করা হয়।

ফলে বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি করার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই।

যদিও প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষার্থীদের বড় একটা অংশ ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকার পক্ষে।

তবে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ বুয়েটে ‘নিয়মতান্ত্রিক’ ছাত্র রাজনীতির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।

আর বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে ছাত্রলীগ ও শিক্ষার্থীদের দ্বিমুখী অবস্থানের মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল ক্যাম্পাসে ‘ছাত্র সংসদ নির্বাচন ও রাজনৈতিক ছাত্র সংগঠনগুলোর সহাবস্থানের’ দাবি জানিয়েছে।

এমন পেক্ষাপটে বুয়েটের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা কতটা এবং কেন তা নিয়ে সর্বত্র চলছে জোর আলোচনা।

এটা আপনি প্রকাশ্যে করতে না দিলে গোপনে করবে- হাসানুল হক ইনু

ছাত্ররা পড়ালেখা বাদ দিয়ে হৈ হৈ করে বেড়াচ্ছে, তাদের তো প্রতিনিধি নাই। মানুষ মারা গেছে তার জন্য ফাঁসি হয়ে গেছে। কর্তৃপক্ষও বিষয়গুলো সমাধান করার চেষ্টা করেছে। এপরপও ছাত্র রাজনীতি থাকবে কি থাকবে না এই কথা কেন আসলো? এই কথাটাই একটা অরাজনৈতিক কথা।

বুয়েট প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, পৃথিবীর সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রদের প্রতিনিধি থাকে, সংসদ থাকে। সেটা তারা স্বাধীনভাবে তাদের মতের ভিত্তিতে করে, “বাংলাদেশে সাংবিধানিকভাবেও ১৮ বছরের পরে ছাত্ররা যেখানে পড়বে সেখানে সংগঠন করতে পারবে। এটা তাদের অধিকার। ফলে ছাত্র রাজনীতি থাকা না থাকার বিতর্ক যারা করছেন, এটা যথার্থ বিতর্ক নয়। সমস্যা নিয়ে আমরা কথা বলবো কিন্তু সমস্যা সমাধান করা বাদ দিয়ে অন্য বিষয়ে আলোচনা সরিয়ে নেওয়া ভালো হচ্ছে না। মাথা ব্যাথা হলে মাথা কেটে ফেলার প্রেসক্রিপশন দেওয়া উচিত নয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি।”

হাসানুল হক ইনু বলেন, “আজকে যে আন্দোলন হচ্ছে, এখানে যদি ছাত্র সংসদ থাকতো, তারা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করতে পারতো। ছাত্ররা পড়ালেখা বাদ দিয়ে হৈ হৈ করে বেড়াচ্ছে, তাদের তো প্রতিনিধি নাই। মানুষ মারা গেছে তার জন্য ফাঁসি হয়ে গেছে। কর্তৃপক্ষও বিষয়গুলো সমাধান করার চেষ্টা করেছে। এপরপও ছাত্র রাজনীতি থাকবে কি থাকবে না এই কথা কেন আসলো? এই কথাটাই একটা অরাজনৈতিক কথা। এগুলো সমাজের জন্য ভালো লক্ষণ নয়। তিনি আরও বলেন, ১৮ বছরের ছেলে মেয়েরা তো বিভিন্ন মতের চর্চা করবেই। এখন এটা আপনি প্রকাশ্যে করতে না দিলে গোপনে করবে।”

ছাত্র রাজনীতির নামে ছাত্রলীগ আসলে বুয়েটে সন্ত্রাস-নির্যাতন করার অধিকার চাচ্ছে- আসিফ নজরুল

শুধু ছাত্রলীগ নয়, প্রকৃত ছাত্র রাজনীতি থাকলে শুধু বুয়েট কেন সব জায়গায় সকল ছাত্র সংগঠন থাকতে হবে। কিন্তু  ছাত্র রাজনীতির নামে ছাত্রলীগ আসলে বুয়েটে ‘সন্ত্রাস-নির্যাতন’ করার অধিকার চাচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল মনে করেন, “শুধু ছাত্রলীগ নয়, প্রকৃত ছাত্র রাজনীতি থাকলে শুধু বুয়েট কেন সব জায়গায় সকল ছাত্র সংগঠন থাকতে হবে। কিন্তু ছাত্র রাজনীতির নামে ছাত্রলীগ আসলে বুয়েটে ‘সন্ত্রাস-নির্যাতন’ করার অধিকার চাচ্ছে।”

এ বিষয়ে ভয়েস অফ আমেরিকাকে ড. আসিফ নজরুল আরও বলেন, “ছাত্রলীগ শুধু বুয়েট কেন বাংলাদেশের কোনও ক্যাম্পাসেই ছাত্র রাজনীতি করে না। ছাত্র রাজনীতি মানে গণতন্ত্রের পক্ষে সংগ্রাম করা। মানবাধিকারের পক্ষে সংগ্রাম করা। শিক্ষা অধিকারের পক্ষে সংগ্রাম করা। তারা (ছাত্রলীগ) তো এগুলো করেই না, বরং যারা গণতন্ত্র হত্যা করেছে, ভূয়া নির্বাচন করেছে, দেশের সম্পদ পাচার করেছে, দুর্নীতি করেছে, মানুষের উপর অত্যাচার করেছে, গুম করেছে, ছাত্রলীগ তাদের পাহারাদার হিসাবে কাজ করে। এটা তো ছাত্র রাজনীতি নয়।”

ছাত্রলীগ বুয়েটেও ছাত্র রাজনীতি করতে চাচ্ছে না বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “তারা চাচ্ছে বুয়েটে থেকে কেউ যেন কখনো সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলতে না পারে। তারা যেন ‘দাস’ হয়ে থাকে, এই ধরনের একটা ‘নির্যাতনতন্ত্র’ তারা করতে চায়। যা তারা অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও করেছে। ছাত্র রাজনীতির নামে তারা সন্ত্রাস-নির্যাতন করার অধিকার চাচ্ছে।”

ছাত্রলীগের নামে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যা হচ্ছে, এটা বুয়েটে হওয়া উচিত না- শফি আহমেদ

তবে ছাত্রলীগ গেলেই যে বুয়েট অনিরাপদ হয়ে যাবে এমনটা মনে করেন না সাবেক ছাত্রনেতা শফী আহমেদ।

এখন ছাত্রলীগ গেলেই যে বুয়েট অনিরাপদ হয়ে যাবে আমি সেটা মনে করি না। কিন্তু, ছাত্রলীগের নামে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যা হচ্ছে, এটা বুয়েটে হওয়া উচিত না।

ভয়েস অফ আমেরিকাকে তিনি বলেন, অনেক দেশে প্রাসঙ্গিক না হলেও বাংলাদেশের অভ্যূদয়ের সঙ্গে ছাত্র রাজনীতির সম্পর্ক যুগান্তকারী। তবে এখন ছাত্র রাজনীতিতে আদর্শের জায়গা হারিয়ে ফেলে ছাত্র সংগঠনগুলো ‘লেজুরবৃত্তির’ সংগঠনে পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

শফী আহমেদ বলেন, “মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং ৯০ এর আন্দোলনেও কিন্তু বুয়েটের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। সেই বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি কেন বন্ধ হলো? এটার ক্ষেত্রে যে জিনিসটা ঘটেছে সেটা মর্মান্তিক ঘটনা। আবরার ফাহাদ হত্যাকান্ড। তখন কিন্তু সমাজে একটা নাড়া পড়ে গিয়েছিল। সেই প্রেক্ষিতে তারা ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করে। এখন হাইকোর্ট সিদ্ধান্ত দিয়েছে ছাত্র রাজনীতি চলবে। ছাত্রলীগও সেখানে রাজনীতি করতে চাচ্ছে। আবার দেখছি বুয়েটের ছাত্ররা তা চাচ্ছে না। তারা চাচ্ছে বুয়েটকে নিরাপদ রাখতে। এখন ছাত্রলীগ গেলেই যে বুয়েট অনিরাপদ হয়ে যাবে আমি সেটা মনে করি না। কিন্তু, ছাত্রলীগের নামে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যা হচ্ছে, এটা বুয়েটে হওয়া উচিত না।”

বাংলাদেশের কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই দলীয় ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা নাই- নূর

বর্তমান পেক্ষাপটে দলীয় ছাত্র রাজনীতির প্রয়োজনীয়তা না থাকলেও সকল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন ভালো প্রক্রিয়া হতে পারে বলে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সাবেক ভিপি এবং গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নূর।

আমি মনে করি শুধু বুয়েট না, বাংলাদেশের কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই আসলে দলীয় ছাত্র রাজনীতির এখন প্রয়োজনীয়তা নাই।…আমি মনে করি সকল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন ভালো পক্রিয়া হতে পারে। ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে সেটা আগামীর বাংলাদেশ বির্নিমানেও অসাধারণ ভূমিকা রাখতে পারবে।

ভয়েস অফ আমেরিকাকে তিনি বলেন, “আমি মনে করি শুধু বুয়েট না, বাংলাদেশের কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই আসলে দলীয় ছাত্র রাজনীতির এখন প্রয়োজনীয়তা নাই। দলীয় ছাত্র রাজনীতি বলতে যা বুঝায় বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের (যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে) মাধ্যমে মূলত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য দলীয় পেশি-শক্তি ও কালো টাকার অসুস্থ রাজনীতি ছাত্র ও তরুণদের মাঝে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। ”

নূর মনে করেন, নির্বাচন কমিশনের আরপিওতে যেটা বলা আছে, ছাত্র সংগঠন রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠন হতে পারবে না। এটার জন্য একটা জাতীয় ঐক্যমতের প্রয়োজন।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “তবে সেক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন থেকে যায়, ছাত্র সংগঠনের রাজনীতি না থাকলে তো আমাদের ছাত্ররা দেশ ও সমাজ নিয়ে তাদের ভাবনা, এগুলো থেকে পিছিয়ে পড়বে। তারা শুধু পাঠ্যপুস্তকেই মুখ গুজে থাকবে। সেজন্য আমি মনে করি সকল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন ভালো পক্রিয়া হতে পারে। ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে সেটা আগামীর বাংলাদেশ বির্নিমানেও অসাধারণ ভূমিকা রাখতে পারবে। কারণ ছাত্র সংসদ নির্বাচন হলে মেধাবী, সৎ, সাহসী এবং যারা পরোপকারী ও বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাজের মধ্য দিয়ে ছাত্রদের মাঝে পরিচিত তারা প্রতিনিধি নির্বাচিত হবে।”

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ রাব্বী
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ছাত্র আবরার ফাহাদ রাব্বী

আদালত তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবে, আমরা এমনটা আশা করছি- আবরার ফাইয়াজ

যে কোনও পরিস্থিতিতেই ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক ছাত্র রাজনীতির বিপক্ষে নিহত বুয়েট ছাত্র আবরার ফাহাদের ছোট ভাই আবরার ফাইয়াজ।

এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে আদালত তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবে, আমরা এমনটা আশা করছি।

ভয়েস অফ আমেরিকাকে তিনি বলেন, “আমি নিজেও বুয়েটের ছাত্র। সর্বোচ্চ ১৫ জনও কিন্তু বলেনি তারা বুয়েটে রাজনীতি ফিরে চায়। অ্যালামনাইসহ বাকী সবাই কিন্তু বলছে তারা রাজনীতি চায় না। হ্যাঁ, এখন আদালত থেকে একটা রায় দেওয়া হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে সাধারণ শিক্ষার্থীরা চায়, কিন্তু আসলেই সাধারণ শিক্ষার্থীরা চায় কি-না সেটা সঠিকভাবে আদালতে উপস্থাপন হয়েছে কিনা সেটাও আমরা জানি না। আমার মতামত হচ্ছে, যেহেতু সাধারণ শিক্ষার্থীরা কেউই চায় না ফলে সেটা এভাবেই বিবেচনা করা উচিত। ফলে এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে আদালত তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করবে, আমরা এমনটা আশা করছি।”

অ্যাডভোকেসি করার জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম হিসাবে আমরা ছাত্র রাজনীতি চেয়েছি- সাদ্দাম হোসেন

বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “আমরা চাই বুয়েট বিশ্বের শীর্ষ প্রযুক্তি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হোক। একই সঙ্গে শিক্ষার্থীরা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে উন্নত হবে, সাংস্কৃতিকভাবে ঋদ্ধ থাকবে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে বার্গেনিং ক্যাপাসিটি থাকবে, যাতে করে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দরকষাকষি করে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা রাখতে পারে। লিডারশীপ মানে তো শুধু পলিটিক্যাল লিডারশীপ নয়, লিডারশীপ মানে হচ্ছে, তারা ভবিষ্যতে উদ্যোক্তা হবে, উদ্ভাবনে সম্পৃক্ত হবে। সৃজনশীলভাবে বিভিন্ন কর্মকান্ডে নেতৃত্ব দেবে।”

তিনি বলেন, “আমরা এমন ধরনের ছাত্র রাজনীতি চাই না, যা ক্ষমতা, দাপট, আধিপত্য বা সংকীর্ণতা শেখায়। আমরা চাই বুয়েটে এমন ছাত্র রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত হোক যা হবে, বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপযোগী বিশেষায়িত ছাত্র রাজনীতি। যা শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা পূরণের প্লাটফর্মে পরিণত হবে। বুয়েটের ছাত্ররা আধুনিক ধ্যান ধারনা, সেটা ক্লাইমেট চেঞ্জ হোক, ডিজিটাল ডিভিশন হোক, প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে দারিদ্র দূর করা, কর্মসংস্থান বাড়ানো, আটিফিসিয়াল ইন্টালিজেন্সের ক্ষেত্রে কী ধরণের পলিসি হবে, পলিটিক্সে কিভাবে ভূমিকা পালন করবে, এই বিষয়গুলো নিয়ে উচ্চতর রাজনীতি চর্চা বুয়েটে করবে।”

অ্যাডভোকেসি করার জন্য একটি স্টুডেন্ট কমিউনিটি তৈরীর প্ল্যাটফর্ম হিসাবে আমরা ছাত্র রাজনীতি চেয়েছি। এখানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ দেশের ছাত্র সমাজকে পথ দেখিয়েছে। আমরা কিন্তু ছাত্রলীগের রাজনীতির জন্য ফাইট করিনি।

ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে অভিযোগ তারা ক্যাম্পাসগুলোতে সহ-অবস্থানের ছাত্র রাজনীতি করতে দেয় না।

বুয়েটেও ছাত্রলীগ শুধু তাদের নিজেদের সংগঠনের সাংগঠনিক কর্মকান্ড করতে চাচ্ছে- এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে সাদ্দাম হোসেন বলেন, “দেখেন আইনী ও রাজনৈতিকভাবে আমরা যে লড়াইটা করলাম, হাইকোর্টে রিট এবং আমাদের কর্মসূচির মাধ্যমে। এটা কিন্তু শান্তিপূর্ণ পথ দেখালো। আমরা কিন্তু দলীয় সাংগঠনিক প্রয়োজনে সেটা করিনি। এটা বুয়েটের শিক্ষার্থীদের বিকাশের স্বার্থে, বুয়েটের ভবিষ্যত প্রজন্মের সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ার সারথী হওয়ার জন্যই কিন্তু আমরা সেটি করেছি। প্রগতিশীল ছাত্র রাজনীতির রাজনৈতিক পরিসর তৈরী করার জন্য আমরা ফাইট করেছি। ফাইট করেছি বুয়েট শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধ নিশ্চিত করার জন্য এবং সার্বিকভাবে বুয়েট নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের যে প্রত্যাশা আছে, সেই প্রত্যাশা পূরণের জন্য। অ্যাডভোকেসি করার জন্য একটি স্টুডেন্ট কমিউনিটি তৈরীর প্ল্যাটফর্ম হিসাবে আমরা ছাত্র রাজনীতি চেয়েছি। এখানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ দেশের ছাত্র সমাজকে পথ দেখিয়েছে। আমরা কিন্তু ছাত্রলীগের রাজনীতির জন্য ফাইট করিনি। দলীয় সাংগঠনিক রাজনীতির বিকাশ, বৃদ্ধি বা সংযোজন-বিয়োজনের জন্য এটি করিনি।

বুয়েটে রাজনীতি থাকবে কি থাকবে না এটা ঠিক করবে সেখানকার শিক্ষার্থীরা- নাছির উদ্দীন

আদালতের রায়টা কিন্তু প্রশাসনিক সেই আদেশের বিপক্ষে হয়েছে। রায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মনোভাবের বিষয় মনে হয় নেই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যদি মনে করে তারা ছাত্রলীগের চলমান সন্ত্রাসের রাজনীতি দেখতে চায় না, তাহলে রাজনীতি থাকবে না। এটাই হচ্ছে বিষয়।

বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিয়ে ছাত্রদলের অবস্থানের বিষয়ে জানতে চাইলে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “আমাদের দুটি বিষয় রয়েছে। বুয়েটে রাজনীতি থাকবে কি থাকবে না বা কিভাবে পরিচালিত হবে এটা ঠিক করবে সেখানকার শিক্ষার্থীরা। এটা আমাদের স্পষ্ট বক্তব্য। আর আদালতের যে রায় এসেছে, সেখানে একটা প্রেক্ষাপট আছে। আমাদের বক্তব্য হল, এটা (বুয়েটে রাজনীতি নিষিদ্ধ) বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত ছিল। আদালতের রায়টা কিন্তু প্রশাসনিক সেই আদেশের বিপক্ষে হয়েছে। রায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মনোভাবের বিষয় মনে হয় নেই। রায় পজেটিভ। আদালতের রায়ের বিষয়ে আমরা খুবই শ্রদ্ধাশীল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যদি মনে করে তারা ছাত্রলীগের চলমান সন্ত্রাসের রাজনীতি দেখতে চায় না, তাহলে রাজনীতি থাকবে না। এটাই হচ্ছে বিষয়।”

ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ ছাত্র রাজনীতির সহাবস্থান থাকতে দিচ্ছে না, এজন্যই কি আপনারা বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি চাচ্ছেন না, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমরা ছাত্র রাজনীতির একদম বিপক্ষে না। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধেও তো বুয়েটের অবদান ছিল। যুদ্ধে এখানকার শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরাও শহীদ হয়েছেন। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এই প্রতিষ্ঠানটি শিক্ষা ক্ষেত্রে যেমন অগ্রসর ছিল, তেমনি রাজনীতির ক্ষেত্রে ছিল। কিন্তু, গত ১৫-১৬ বছরে রাজনীতির নামে ছাত্রলীগ যে সন্ত্রাস করছে, আমার মনে হয়, বুয়েটের শিক্ষার্থীরা ছাত্রলীগের সন্ত্রাসের এই রাজনীতি পছন্দ করছে না। ছাত্রলীগের রাজনীতির প্রভাবের কারণেই হয়তো তারা ছাত্র রাজনীতি নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করছে বলে আমাদের ধারণা।”

বুয়েট প্রশাসন কী বলছে

ঐতিহ্যবাহী এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আবার ছাত্র রাজনীতি চালু হবে কিনা কিংবা যদি চালু হয় তাহলে সেটা কোন প্রক্রিয়ায় হবে, সেই প্রশ্ন এখন ঘুরে ফিরেই সামনে আসছে। এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে, তারা আদালতের সিদ্ধান্ত মেনে পরবর্তী প্রক্রিয়া কী হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।

এ বিষয়ে বুয়েট উপাচার্য সত্য প্রসাদ মজুমদার এপ্রিলের ১ তারিখ সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, “কোর্টকে আমরা তো ভায়োলেট করতে পারব না। আমাদের কোর্টের নিয়মে চলতে হবে। এ বিষয়ে আমরা আমাদের লিগ্যাল অ্যাডভাইজারের সাথে কথা বলব। ইউনিভার্সিটি কার্যক্রম যেন ব্যাহত না হয় এবং রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম ক্ষুন্ন না হয়, দুদিকেই দেখতে হবে।”

এ বিষয়ে বুয়েটের প্রো-ভিসি অধ্যাপক ড. আব্দুল জব্বার খান ভয়েস অফ আমেরিকাকে বলেন, “এই ঘটনা নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। আগামী ৮ তারিখে তদন্ত কমিটি তাদের রিপোর্ট দেবে। তার আগে এ বিষয়ে আমি কোনও মন্তব্য করতে চাচ্ছি না। এছাড়া রিটের বিষয়ে যে রায় আদালত দিয়েছেন, তার বিস্তারিত নির্দেশনাগুলোও আমাদের ভালোভাবে দেখতে হবে। এরপরেই এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানো সম্ভব হবে।”

voa