বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্তির জন্য আর কোনো আবেদন গ্রহণ করবে না জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল। গত ৩০ জানুয়ারি কাউন্সিলের সভায় এই সিদ্ধান্ত হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যাচাই-বাছাই ও তালিকা প্রণয়নের কাজটি হয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রতিষ্ঠান জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) মাধ্যমে।
জামুকার সভার (৮৮তম) কার্যবিবরণী প্রকাশিত হয় গত ২০ ফেব্রুয়ারি। কার্যবিবরণী অনুযায়ী, জামুকার কাছে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতির জন্য ইতিপূর্বে সুপারিশ করা আবেদন (ক—তালিকার) এবং আপিল আবেদন (‘খ’ ও ‘গ’ তালিকা) আর যাচাই করা হবে না। একই সঙ্গে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্তির জন্য আর কোনো ধরনের আবেদন গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
উল্লেখ্য, ক তালিকা বলতে বোঝায় ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জেলা–উপজেলা পর্যায়ে যাচাইয়ের পর যাঁদের নাম বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে আপত্তি ওঠেনি। এ তালিকা বিবেচনার জন্য জামুকায় পাঠানো হয়। খ তালিকা বলতে বোঝায়, জেলা-উপজেলা পর্যায়ে যাচাইয়ে যাঁদের বিষয়ে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয়নি। গ তালিকা বলতে বোঝায়, যাচাইয়ে যাঁদের আবেদন অগ্রহণযোগ্য বলে মত দেওয়া হয়েছিল। ‘খ’ ও ‘গ’ তালিকায় যাঁদের নাম ছিল, পরে তাঁরা জামুকায় আপিল করেন।
জামুকার ৮৮তম সভার কার্যবিবরণী তথ্য অনুযায়ী, ক তালিকায় এখনো ৬ হাজার ৩৩৩টি আবেদন এবং ‘খ’ ও ‘গ’ তালিকার ২১ হাজার ৪৮৩টি আবেদন রয়েছে। এসব আবেদন ও আপিল নামঞ্জুর করা হয়েছে। ফলে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতির জন্য এসব আবেদন আর বিবেচনা করা হবে না।
জামুকা সূত্র জানায়, স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত সাতবার মুক্তিযোদ্ধা তালিকা সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে। আর বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকায় অন্তুর্ভুক্তির ক্ষেত্রে বয়স, সংজ্ঞা ও মানদণ্ড পাল্টেছে ১১ বার। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চূড়ান্ত ও পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশের বিষয়ে সরকার বিভিন্ন সময় প্রতিশ্রুতি দিলেও তালিকা প্রকাশ করতে পারেনি।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির কাজ প্রায় শেষ। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির জন্য আমরা আর কোনো নতুন আবেদন বা আপিল গ্রহণ করব না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। নতুন করে কাউকে তালিকায় যুক্ত করা হবে না।’
তবে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আর কোনো আবেদন গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত ঠিক হয়নি বলে মনে করেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এই প্রক্রিয়া চলমান থাকা দরকার। প্রবাসে অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা আছেন, যাঁরা আমলাতান্ত্রিক জটিলতার মধ্য দিয়ে আবেদন করতে পারেননি। আর আবেদন করার প্রক্রিয়াটি অনেক জটিল।
যে তালিকা জামুকা করছে, তা সম্পূর্ণ আমলানির্ভর একটি তালিকা। প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এখনো জামায়াত-স্বাধীনতাবিরোধীরা আছে। বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে এমন অনেকের নাম তালিকায় ঢুকেছে, যাঁরা বীর মুক্তিযোদ্ধা নন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে তাঁদের অনেকের নাম বাদ দিয়েছে। আবার আওয়ামী লীগের তিন মেয়াদেও অনেক অমুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকায় ঢুকেছে, এ নিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে।
শাহরিয়ার কবির বলেন, ‘আমলানির্ভর তালিকা করলে তা কখনোই বিশ্বাসযোগ্য হবে না। রাজাকারের তালিকায় বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম ঢুকে যাওয়ার ঘটনাও আমরা দেখেছি। মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা করার কাজটি গবেষকদের সঙ্গে নিয়ে করতে হবে এবং কাজটি চলমান রাখতে হবে।’
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গেজেট শাখা বলছে, বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এ পর্যন্ত ২ লাখ ৪২ হাজার জনের নাম বিভিন্ন সময় গেজেটভুক্ত হয়েছিল। অন্যদিকে মন্ত্রণালয়ের বাজেট শাখা বলছে, গত ফেব্রুয়ারি মাসে ২ লাখ ৪১ হাজার ৩৯০ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার নামে ভাতা (মাসিক সম্মানী) বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ২০২১ সালের মার্চ মাসে ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৩৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার একটি তালিকা (অপূর্ণাঙ্গ) সরকার প্রকাশ করেছিল।
অমুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা থেকে বাদ দিতে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকার দেশের সব জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) দিয়ে স্থানীয়ভাবে কমিটি করে যাচাই-বাছাই শুরু করে। জামুকা সূত্র বলছে, তালিকা থেকে নানা কারণে বাদ পড়েছে প্রায় ২০ হাজার নাম।
২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ বছরে জামুকার বিভিন্ন বৈঠকের কার্যবিবরণী পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, এই সময়ে নতুন করে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্তির জন্য ১০ হাজার ৮৯১ জনের নাম সুপারিশ করেছে জামুকা। একই সময়ে ২ হাজার ১৯০ জনের নামের গেজেট বাতিল হয়েছে। যাঁরা নতুন করে তালিকায় যুক্ত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে মেয়র, সংসদ সদস্য রয়েছেন। এর মধ্যে ২০২২ সালের ১১ এপ্রিল জামুকার সভায় বরিশাল সিটি করপোরেশনের বর্তমান মেয়র আবুল খায়ের আবদুল্লাহকে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্তির সিদ্ধান্ত হয়। ২০২২ সালের ২৭ এপ্রিলের সভায় গাইবান্ধা-৪ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য মনোয়ার হোসেনকে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্তির সিদ্ধান্ত হয়।
জামুকা সূত্র বলছে, ১৯৮৪ সালে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তখন একটি তালিকাও তৈরি হয়, যা ‘জাতীয় তালিকা’ নামে পরিচিত। ওই তালিকা অনুযায়ী, মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ১ লাখ ২ হাজার ৪৫৮। তবে তালিকাটি পূর্ণাঙ্গ ছিল না। মূলত বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় গঠিত মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের মাধ্যমে সংগ্রহ করা মুক্তিযোদ্ধাদের নামের একটি তালিকা, চট্টগ্রামের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের (ইবিআরসি) তালিকা এবং ভারত থেকে প্রাওয়া একটি তালিকা—এই তিন তালিকা মিলিয়েই মূলত ‘জাতীয় তালিকা’ করা হয়েছিল।
জামুকা সূত্র জানায়, ১৯৮৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেজর জেনারেল আমীন আহম্মদ চৌধুরী বীর বিক্রম ভারত থেকে একটি তালিকা সংগ্রহ করেন, যা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতীয় তালিকা বলে পরিচিত। এই তালিকায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ৬৯ হাজার ৮৩৩ জন। ১৯৯৪ সালে বিএনপি সরকারের আমলে মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের তৎকালীন আহ্বায়ক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ জ ম আমিনুল হক বীর উত্তম কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের নির্বাচন পরিচালনার জন্য যে ভোটার তালিকা প্রণয়ন করেন, তাতে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল ৮৬ হাজার।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও জামুকার তিনজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১ লাখ ৮৬ হাজার ৭৯০ জনের একটি তালিকা (বীর মুক্তিযোদ্ধা) প্রণয়ন করা হয়, যা মুক্তিবার্তা (সবুজ) হিসেবে পরিচিত। পরে আরও যাচাই-বাছাই করে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৪৫২ জনের আরেকটি তালিকা করা হয়, যা মুক্তিবার্তা (লাল) হিসেবে পরিচিত।
জামুকা সূত্র বলছে, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি তালিকা করার উদ্যোগ নেয়। এ লক্ষ্যে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব সা’দত হুসাইনকে আহ্বায়ক ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মমতাজ উদ্দিনকে সদস্যসচিব করে ১৫ সদস্যের জাতীয় কমিটি করা হয়। এই কমিটি ২ লাখ ১০ হাজার ৫৮১ জনকে তালিকায় (বীর মুক্তিযোদ্ধা) অন্তর্ভুক্ত করে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে অভিযোগ করে, বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ৭০ হাজারের বেশি অমুক্তিযোদ্ধাকে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্তির জন্য ন্যূনতম বয়স ১২ বছর ৬ মাস নির্ধারণ করে ২০১৮ সালের ১৭ জানুয়ারি সংশোধিত পরিপত্র জারি করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এই পরিপত্র অনুযায়ী, ১৯৭১ সালের ৩০ নভেম্বর যেসব মুক্তিযোদ্ধার বয়স ন্যূনতম ১২ বছর ৬ মাস ছিল, তাঁদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে আবেদন করতে পারবেন।
বর্তমানে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসিক ২০ হাজার টাকা ভাতা পাচ্ছেন। দুই ঈদে ১০ হাজার টাকা করে আরও ২০ হাজার টাকা ভাতা পান। এ ছাড়া বিজয় দিবসে ৫ হাজার টাকা এবং বাংলা নববর্ষে ২ হাজার টাকা ভাতা পান একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দেশের বিশেষায়িত ২৪টি হাসপাতালে মুমূর্ষু বা জটিল রোগে আক্রান্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার সুযোগ রয়েছে। তাঁরা এসব হাসপাতাল থেকে সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা চিকিৎসা-সুবিধা পাবেন।
অসচ্ছল বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ ও প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য ‘বীর নিবাস’ নামের প্রকল্পের আওতায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ৩০ হাজার পাকা বাড়ি নির্মাণ করছে। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিশেষ ঋণ কর্মসূচির আওতায় সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে ১০ লাখ টাকা ঋণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যকে রেশন সুবিধা দেওয়া হচ্ছে। বীর মুক্তিযোদ্ধা আসা-যাওয়ার সুবিধার্থে বিমানবন্দরে রয়েছে আলাদা কাউন্টার।
এ ছাড়া ২০১২ সালে সরকার এক আদেশে সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে যাঁরা বীর মুক্তিযোদ্ধা, তাঁদের ক্ষেত্রে অবসরের বয়স ৬০ বছর করে। এমনিতে সরকারি চাকরিজীবীদের অবসরে যাওয়ার বয়স ৫৯ বছর। আর সব ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের নামের আগে ‘বীর’ শব্দ ব্যবহারের বিধান করে ২০২০ সালের ২৯ অক্টোবর গেজেট প্রকাশ করে সরকার।
PROTHOM ALO