বিশেষ সাক্ষাৎকার: ম. তামিম বিদ্যুৎ খাতের এই আমদানিনির্ভরতা পরিকল্পিতই

ড. ম. তামিম
ড. ম. তামিম

প্রথম আলো: সরকার বিদ্যুৎ খাতের যে পরিকল্পনা ধরে এগিয়েছে, তাতে কি এটা অনুমান করা গিয়েছিল যে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি এতটা খারাপ হতে পারে? আপনার নিজের কোনো মূল্যায়ন ছিল কি?

ম. তামিম: বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রাথমিক জ্বালানি আমদানির অর্থ জোগান দিতে যে আমরা বিপদে পড়তে পারি, সেই আশঙ্কা ছিল। বিদ্যুৎ খাত নিয়ে আমাদের যে পরিকল্পনা, তাতে আমার হিসাব অনুযায়ী ২০৩০ সাল নাগাদ ৯০ শতাংশই আমদানি করা জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ার কথা। সেই হিসাবে তখন বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রাথমিক জ্বালানি আমদানিতে খরচ ২০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে। এখন আমাদের ১০-১২ বিলিয়ন ডলার খরচ পড়ছে। এত অর্থ কোথা থেকে আসবে, পরিকল্পনা করার সময় সেই প্রশ্ন বিভিন্ন পর্যায় থেকে তোলা হয়েছিল। আমি নিজেও তুলেছিলাম। তখন আমাদের বলা হয়েছিল যে দেশের অর্থনীতি যেভাবে এগোচ্ছে, তাতে অর্থের সমস্যা হবে না।

ম. তামিম: আমি মনে করি, বাস্তবতা বিবেচনায় নিয়ে ও ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। জ্বালানির আন্তর্জাতিক বাজার, প্রাপ্যতার ঝুঁকি, সরবরাহের ঘাটতি, মূল্যবৃদ্ধির ঝুঁকি বা অর্থনীতির অবস্থা যে খারাপ হতে পারে বা আমাদের যে আমদানি করার টাকার অভাব হতে পারে, এসব বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।

ম. তামিম: আসলে পরিকল্পনা করেই আমদানিনির্ভর করা হয়েছে। অর্থনীতি ভালো করবে, এই বিবেচনা থেকে আমরা আমদানিনির্ভরতার দিকে এগিয়েছি। যুক্তি ছিল এমন যে জাপান, তাইওয়ান বা দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশগুলোর জ্বালানির খাত পুরোপুরি আমদানিনির্ভর। এখন প্রশ্ন হচ্ছে যে আমাদের অর্থনীতি কি এই দেশগুলোর মতো শক্তিশালী? এখানে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি যে অর্থনীতি ভালো করতে পারে আবার খারাপও করতে পারে। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের পারস্পেকটিভ প্ল্যান ২০৪১-এ ২০ বছর ধরে ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে অর্থনীতির হিসাব-নিকাশ করা হয়েছে। এটা একদিকে যেমন উচ্চাভিলাষী, তেমনি অবাস্তব।

প্রথম আলো: আপনি বললেন, ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৯০ শতাংশ হবে আমদানি করা জ্বালানির মাধ্যমে। বর্তমানে এটা কত ভাগে দাঁড়িয়েছে?

ম. তামিম: বর্তমানে আমাদের যে ১৫ হাজার মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়, এর মধ্যে ৬ হাজার মেগাওয়াটের মতো হয় গ্যাস থেকে। এর মধ্যে নিজস্ব গ্যাস থেকে হয় ৫ হাজার মেগাওয়াট। সেই হিসাবে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ জ্বালানি আমদানি করতে হয়।

প্রথম আলো: বিদ্যুৎ উৎপাদনকে এভাবে আমদানিনির্ভর করা কতটুকু যৌক্তিক হলো?

ম. তামিম: বিদ্যুৎ উৎপাদনে আমাদের জ্বালানি আমদানি করতে হবে, এটা বাস্তবতা। এ ক্ষেত্রে পুরো স্বনির্ভর হওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। যখন আমাদের গ্যাস উৎপাদন কমতে শুরু করে, তখন আমদানিনির্ভর তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দিকে যেতে হয়েছে। তখন আর কোনো উপায় ছিল না দেখে বিশেষ ব্যবস্থায় স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট করে তা করতে হয়েছে। কিন্তু সেটা ছিল সাময়িক ব্যবস্থা, তিন থেকে পাঁচ বছরের জন্য। তখন আমাদের উচিত ছিল পাশাপাশি গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া। ২০১৮ সালে আমরা এলএনজি আমদানি শুরু করেছি। এটারও হয়তো দরকার ছিল। কিন্তু যে ভুলটি আমরা করেছি, তা হচ্ছে আমাদের নিজস্ব উৎপাদনে সময় লাগবে, এই যুক্তি দিয়ে আমরা সমান্তরালভাবে নিজেদের গ্যাস অনুসন্ধানের দিকে নজর না দিয়ে পুরোপুরি আমদানিনির্ভরতার দিকে ঝুঁকেছি। গত ২০ বছরে একেক সময়ে একেক কারণে বাংলাদেশে কোনো গ্যাস অনুসন্ধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। বিদ্যুৎ উৎপাদনে আমাদের নিজস্ব প্রাথমিক জ্বালানি তিনটি—গ্যাস, কয়লা ও সৌরশক্তি। বিদ্যুতের ঘাটতি দূর করতে জরুরি যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, এর পাশাপাশি যদি নিজেদের গ্যাস ও কয়লা ব্যবহার এবং সৌরবিদ্যুতের দিকে জোর নজর দেওয়া হতো, তাহলে পরিস্থিতি এতটা খারাপ হতো না।

ম. তামিম: ফুলবাড়ী কয়লাখনির বিরুদ্ধে যখন আন্দোলন শুরু হয়, তখন আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বিরোধী দলে ছিলেন। তিনি তখন বলেছিলেন যে ক্ষমতায় গেলে সেখান থেকে কয়লা তুলবেন না। তিনি তাঁর কথা রেখেছেন। যাঁরা এর বিরোধিতায় নেমেছিলেন, তাঁরা শুরুতে যে যুক্তি দিয়েছিলেন, তা ভালো যুক্তি ছিল না। আসলে বিষয়টি আবেগ দিয়ে দেখার কিছু নেই। তারা কয়লাখনি অঞ্চলের দুই ফসলি জমি এবং কৃষির ক্ষতির যুক্তি দিয়েছিলেন আর পরে দিয়েছিলেন খনির পানি ব্যবস্থাপনাজনিত সমস্যার যুক্তি। দেখুন, ১৯৭৬-৭৭ সালে যেখানে আমাদের ফসলি জমি ছিল ৯০ শতাংশ, এখন তা ৭০ শতাংশে নেমে এসেছে। শিল্পায়নের জন্য, আবাসনের জন্য কৃষিজমি কমছে। ফুলবাড়ী কয়লাখনির পুরো জমি একবারে বিবেচনায় নিলে তার পরিমাণ ৬ হাজার হেক্টর। আমি হিসাব করে দেখেছি, এখানে বছরে ধান-চালসহ যে কৃষিপণ্য উৎপাদিত হয়, তার মূল্য ১২ মিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি। মানে কয়লাখনি হলে বছরে এই অর্থমূল্যের ধান-চাল থেকে আমরা বঞ্চিত হব। এখানে যে অর্থনৈতিক হিসাব-নিকাশটি করা উচিত ছিল, তা করা হয়নি। শুধু চাষের জমি চলে যাচ্ছে, এ নিয়েই আমরা বেশি ব্যস্ত ছিলাম। তবে খনির পানি ব্যবস্থাপনার যে বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ এবং তা একটি প্রকৌশলগত বিষয়। যে বিদেশি কোম্পানি কয়লা তুলতে চেয়েছিল, তারা তাদের মতো যুক্তি-ব্যাখ্যা দিয়েছে। কিন্তু বিষয়টি তৃতীয় কোনো পক্ষের মাধ্যমে যাচাই করে দেখা উচিত ছিল। বোঝা উচিত ছিল যে দুই পক্ষের যুক্তি ও ব্যাখ্যার বাস্তব দিক কী। খনির পানি ব্যবস্থাপনার যে প্রকৌশলগত চ্যালেঞ্জের কথা বলা হচ্ছে, তার কোনো সমাধান আছে কি না, সেই নিরীক্ষা আমরা করিনি। আমি মনে করি, এটা করা উচিত ছিল। সবকিছু বিবেচনায় নিয়েই ফুলবাড়ীর বিষয়ে আমাদের সিদ্ধান্তে আসা উচিত ছিল।

প্রথম আলো: সৌরবিদ্যুৎ বাংলাদেশের জন্য কতটা কার্যকর? সরকার তো এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু কোনো অগ্রগতি তো নেই।

ম. তামিম: ২০১০-১১ সাল থেকে সরকার সৌরবিদ্যুৎকে উৎসাহিত করার চেষ্টা করে আসছে। এ জন্য বেসরকারি খাতকে কিছু সুযোগ-সুবিধা ও ছাড় দিয়েছে। এ পর্যন্ত ৪০টির বেশি প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছে এবং সেখান থেকে এখন মাত্র ৫০০ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে। যেভাবে চলছে, তাতে আরও ৫০০ মেগাওয়াটসহ সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন সামনে ১ হাজার মেগাওয়াটে পৌঁছাতে পারে। এ ক্ষেত্রে আমি যা বলতে চাই, তা হচ্ছে সৌরবিদ্যুতের ক্ষেত্রে সরকার যে নীতি নিয়েছে, তা কাজ করেনি। সরকার বেসরকারি খাতের মাধ্যমে কাজটি করতে চেয়েছে এবং সুবিধাও দিয়েছে। কিন্তু ১০০ মেগাওয়াটের একটি সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র করতে অন্তত ৩০০ একর জমির প্রয়োজন। বেসরকারি উদ্যোক্তাদের পক্ষে এত জমি পাওয়া ও জোগাড় করা কঠিন। অনেকে চরের কথা বলছেন কিন্তু সেখানকার জমি কতটা শক্তপোক্ত, সেটা এক বড় বিবেচনা। ফলে জমির নিশ্চয়তা না পেলে এসব ক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ নিশ্চিত করা কঠিন। কারণ, উদ্যোক্তাদের অনেকেই বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে কাজটি করতে আগ্রহী। সৌরবিদ্যুতের সঙ্গে যেহেতু জমি পাওয়ার বিষয়টি যুক্ত, তাই এই দায়িত্ব শুধু বেসরকারি উদ্যোক্তাদের ওপর ছেড়ে দিয়ে ফল পাওয়া যাবে না। সৌরবিদ্যুতের ক্ষেত্রে সরকারের অবস্থান শুধু ইতিবাচক হলেও হবে না। সরকারকে এখানে বাড়তি ভূমিকা পালন করতে হবে। পুশ করতে হবে। তা ছাড়া সৌরবিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ গ্রহণের ক্ষেত্রে আমাদের জাতীয় গ্রিডের সক্ষমতার অভাব রয়েছে।

প্রথম আলো: সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে জমি সমস্যার সমাধানে সরকার বেসরকারি খাতকে কীভাবে সহায়তা করতে পারে?

ম. তামিম: সরকারের কাছে অনেক পতিত জমি থাকে। এগুলোর হিসাব সরকারের কাছে আছে। বেসরকারি উদ্যোক্তাদের জমি দেওয়ার ব্যাপারে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। তা ছাড়া পরিত্যক্ত বা বন্ধ হয়ে যাওয়া বিভিন্ন প্ল্যান্টকে সরকার বেসরকারি উদ্যোক্তাদের দিতে পারে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য। প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাদে সৌর প্যানেল লাগানোর বিষয়টি সরকার বাধ্যতামূলক করে দিতে পারে। বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান যেন তাদের কলকারখানার ছাদ বাইরের কোম্পানিকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য দিতে পারে, সেই নীতিমালা তৈরি করতে পারে। এগুলো করা গেলে ২০৩০ সাল নাগাদ সৌরবিদ্যুতের উৎপাদন ৬ হাজার মেগাওয়াট পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব।

প্রথম আলো: ২০১২ সালে সমুদ্রসীমা নির্ধারণের পর প্রায় ১০ বছর চলে গেছে। গভীর সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানের কিছু কেন হলো না?

ম. তামিম: সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য তথ্যের প্রয়োজন পড়ে। সমুদ্রসীমা নির্ধারিত হওয়ার পর বাংলাদেশ জরিপ করার উদ্যোগ নেয়। টেন্ডার ডাকা হয় এবং একটি প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি সেখানে নির্বাচিত হয়। স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় কাজটি হয়েছে বলেই আমরা জানি। কিন্তু মন্ত্রণালয় কোনো এক অজ্ঞাত কারণে তা বাতিল করে দেয়। আবার নতুন করে টেন্ডার ডাকা হয়। সেখানেও সেই একই কোম্পানি যাচাই-বাছাইয়ের পর প্রথম হয়। সেই টেন্ডার বাতিল না করে ঝুলিয়ে রাখা হয়। সবকিছুরই একটা সময়সীমা থাকে এবং সেই সীমা পার হয়ে গেছে। এরপর নিজেরাই জরিপের জাহাজ জোগাড় করে জরিপ করার মতো অবাস্তব প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। শেষ পর্যন্ত সেটারও কিছু হয়নি। এভাবে সময় চলে গেছে। এখন এক্সন-মবিল কোম্পানির কাছ থেকে সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানের প্রস্তাব এসেছে বলে পত্রপত্রিকায় খবর এসেছে। পরিস্থিতি খারাপ হলে আমাদের তাড়াহুড়া শুরু হয়। আসলে সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধানের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে যে তৎপরতা চালানো উচিত ছিল, তা নেওয়া হয়নি। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে নিজস্ব জ্বালানি অনুসন্ধানের বিষয়টি আমাদের কাছে প্রাধান্য পায়নি। স্থলভাগে অনুসন্ধানের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা যায়। বিদেশি তেল-গ্যাস কোম্পানিগুলোকে যেন আমরা বাদ দেওয়ার নীতি নিয়েছি। অথচ তাদের কারিগরি ও প্রযুক্তিগত দক্ষতা আমাদের বেশি। ব্যবস্থাপনা ও উৎপাদনগত দক্ষতার কারণে তারা গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে সর্বোচ্চ গ্যাস তুলতে পারে। শেভরনের বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র তার দৃষ্টান্ত। তিতাস বা সিলেট গ্যাসফিল্ড বিবিয়ানার তুলনায় অনেক বড় হওয়ার পরও সেখান থেকে উত্তোলন কমে আসছে। অথচ যথাযথ প্রযুক্তি ও প্রকৌশলগত উদ্যোগ নেওয়া গেলে এই ক্ষেত্রগুলো থেকে গ্যাস উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। এর জন্য প্রযুক্তির উন্নয়ন লাগবে, বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

ম. তামিম: আমাদের এলএনজি আমদানির সক্ষমতা বছরে ৭ দশমিক ২ মিলিয়ন টন। এর অর্ধেক আমরা কিনি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির অধীনে কাতার ও ওমান থেকে। বাকি অর্ধেকের কিছু আমরা কিনি স্পট মার্কেট থেকে। কাতার ও ওমান আমাদের চাহিদার পুরোটাই দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির মাধ্যমে কেনার জন্য তাগিদ দিয়েছিল। কিন্তু আমরা তা করিনি। বাইরের দেশ থেকে জ্বালানি কেনার ক্ষেত্রে স্ট্যান্ডার্ড প্র্যাকটিস হচ্ছে সরবরাহ নিশ্চিত রাখতে সামগ্রিকভাবে মূল যে চাহিদা, তা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় কেনা। কোনো বিশেষ কারণে বাড়তি প্রয়োজন পড়লে তা স্পট মার্কেট থেকে কেনা। যেমন শীতের সময় ইউরোপে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে বাড়তি জ্বালানি লাগে। আবার সেখানে ঝড় বা কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিলে বাড়তি জ্বালানির প্রয়োজন পড়ে। তখন বাড়তি বা বিশেষ চাহিদা মেটাতে সাধারণত স্পট মার্কেট থেকে জ্বালানি কেনা হয়। আমি মনে করি, আমাদের চাহিদার কতটুকু আমরা দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় কিনব আর কতটুকু স্পট মার্কেট থেকে কিনব, সেই জরুরি হিসাব আমরা ঠিকভাবে করতে পারিনি। এটা ভুল ছিল।

প্রথম আলো: ভুল নীতি, কৌশল বা পরিকল্পনা—যে কারণেই হোক, বিদ্যুতের সংকট এখন একটি বাস্তবতা। ডলারের ঘাটতি না থাকলে হয়তো এই সমস্যা এতটা প্রকট হতো না। ডলারের পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বর্তমান সংকটকে সহনশীল করার জন্য কী কী উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে? আপনার পরামর্শ কী?

ম. তামিম: স্বল্প মেয়াদের কথা যদি বলি, তবে এলএনজি কেনার চুক্তিগুলো সতর্কতার সঙ্গে করতে হবে। বাজার ওঠানামার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এবং হিসাব করে সিদ্ধান্তে আসতে হবে। সামনে যে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো আসছে, তাতে ২০২৭ সাল নাগাদ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন দাঁড়াবে ৭ হাজার মেগাওয়াট। আর গ্যাসনির্ভর উৎপাদন হবে আরও ৪ হাজার মেগাওয়াট। নতুন এই বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বিবেচনায় নিয়ে কোন বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সামনে চলবে বা কোনগুলো কখন বন্ধ করে দিতে হবে, সেই তালিকা করতে হবে। অস্থায়ী বা তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত না নিয়ে ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু সংকটটি অর্থনৈতিক। তাই সংকট সমাধানের পথ হলো অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা। আমদানি কমিয়ে রিজার্ভ রক্ষা করার নীতি কাজে দেবে না। এটা রিজার্ভ বাড়ানোর পথ নয়। আমদানি কমানোর কারণে দেশের শিল্প খাত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেল-গ্যাসের দাম বকেয়া পড়েছে। দেখা যাচ্ছে আমদানি বন্ধ করে দ্রব্যমূল্যও কমানো যাচ্ছে না। আমি অর্থনীতির লোক নই, তারপরও বলি, আমাদের জন্য রিজার্ভ বাড়ানোর পথ হচ্ছে রপ্তানি বাড়ানো ও রেমিট্যান্স বাড়ানো, শুধু আমদানি কমানো নয়। কৃত্রিমভাবে টাকার মূল্য ধরে রাখা বা ব্যাংকের সুদের হার কমিয়ে রাখার মতো বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হবে। জ্বালানি খাত যেহেতু আমদানিনির্ভর, তাই ডলার-সংকট দূর করা ও অর্থনীতিকে ভালো করা ছাড়া কোনো পথ নেই।

প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।

ম. তামিম: আপনাকেও ধন্যবাদ।