- তৈমূর আলম খন্দকার
- ০৮ জানুয়ারি ২০২১
দেশের খ্যাতনামা ৪২ বিশিষ্ট নাগরিক নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনেছেন এবং এ নিয়ে তদন্তের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠনের আবেদন জানিয়েছেন। এ কাউন্সিল গঠনের এখতিয়ার একমাত্র রাষ্ট্রপতিরই আছে। যদিও রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশ বা মতামত ছাড়া এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন না। এ বিষয়ে সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদে লেখা আছে, ‘এই সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাহার অন্য সব দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন।’
‘(১) সংসদ আইনের দ্বারা ন্যায়পালের পদ-প্রতিষ্ঠার জন্য বিধান করিতে পারিবেন।
(২) সংসদ আইনের দ্বারা ন্যায়পালকে কোনো মন্ত্রণালয়, সরকারি কর্মচারী বা সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষের যেকোনো কার্য সম্পর্কে তদন্ত পরিচালনার ক্ষমতাসহ যেরূপ ক্ষমতা কিংবা যেরূপ দায়িত্ব প্রদান করিবেন, ন্যায়পাল সেইরূপ ক্ষমতা প্রয়োগ ও দায়িত্ব পালন করিবেন।
(৩) ন্যায়পাল তাঁহার দায়িত্বপালন সম্পর্কে বার্ষিক রিপোর্ট প্রণয়ন করিবেন এবং অনুরূপ রিপোর্ট সংসদে উপস্থাপিত হইবে।’
৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিক রাষ্ট্রপতির কাছে একটি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করে নির্বাচন কমিশনের দুর্নীতি, চুরি, স্বেচ্ছাচারিতা প্রভৃতি বিষয়ে তদন্ত দাবি করেছেন। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেখা যায় যে, ০.৫০ (পঞ্চাশ পয়সার) টাকার একটি সাদা কাগজ এবং ৪ টাকা মূল্যের একটি বলপেন দিয়ে কারো বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ দুর্নীতি দমন কমিশনের বাক্সে ফেলে দিলেই তদন্ত শুরু হয়ে যায়। অনেক সময় পত্রিকায় দুর্নীতি সম্পর্কিত কোনো সংবাদ প্রকাশিত হলেই সে সংবাদের সূত্র ধরে সম্পদের হিসাব চেয়ে দুদকের নোটিশ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে পৌঁছে যায়। দুদকের নোটিশ মানেই একটি আতঙ্ক। কিন্তু রাষ্ট্রে ৪২ জন নাগরিক সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করার পরও দুদক কোনো প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেনি। দুদক আইনে ৩(২) ধারায় বলা হয়েছে যে, ‘এই কমিশন একটি স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন হবে।’
যে ৪২ নাগরিক নির্বাচন কমিশনের দুর্নীতির তদন্ত দাবি করেছেন তারা সমাজের বরেণ্য ও আলোকিত ব্যক্তিত্ব। তাদের বক্তব্য গোটা জাতির বক্তব্য। নিজের ভোট নিজে দিতে না পারা কোটি কোটি দেশবাসীর নীরব আর্তনাদ ৪২ জনের বক্তব্যে উঠে এসেছে। তারা (৪২ জন) নির্বাচন কমিশনের দুর্নীতির তদন্ত দাবি করেছেন মাত্র, এখনো শাস্তি দাবি করেননি। কিন্তু বঙ্গভবনের চার দেয়ালের ভেতরে অবস্থানরত মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে ভোটাধিকার প্রয়োগে ব্যর্থ নাগরিকদের বোবা কান্না হয়তো পৌঁছে না। এ জন্য তিনি বিচারপতি সাহাবউদ্দিনের মতো বলতেই পারেন যে, কবর জেয়ারত এবং মিলাদে অংশ গ্রহণ করা ছাড়া রাষ্ট্রপতিকে সংবিধানে কোনো ক্ষমতা দেয়া হয়নি। কাগজে-কলমে সব ক্ষমতার উৎস রাষ্ট্রপতি, কিন্তু কোনো ক্ষমতাই তার নেই যদি না প্রধানমন্ত্রী তাকে Space দেন। এমতাবস্থায় রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তির কাছে দাখিল করা ৪২ জনের আবেদন ডাস্টবিনে যাবে, না কার্যকর তদন্ত অনুষ্ঠিত হবে তা অগ্রিম আঁচ করা যাচ্ছে না।
‘জবাবদিহির ঊর্ধ্বে কেউ নয়’ এটাই স্বাধীনতার চেতনা। যদি রাষ্ট্র পরিচালনায় জবাবদিহি নিশ্চিত করা যেত তবে প্রজাতন্ত্রের দায়িত্বপ্রাপ্তরা পুকুরচুরি থেকে সাগরচুরি করতে পারত না। উন্নত দেশে ‘জবাবদিহির’ গুরুত্ব অনেক। যেখানে গণতন্ত্র নেই সেখানে জবাবদিহির প্রয়োজন হয় না, বরং এক ব্যক্তিকে খুশি রাখতে পারলেই হলো।
আমরা দেখেছি, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সিনেট তদন্ত করেছে। মক্কা শরিফে বায়তুল মাল অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে কাপড় প্রদান করা হতো। একবার কাপড় বিতরণের পর খলিফা হজরত ওমর রা: জুমার নামাজে খুৎবা দেয়ার সময় একজন সাহাবি খলিফাকে প্রশ্ন করে বলেন যে, হে আমিরুল মুমিনিন সবার জন্য একটি করে নতুন কাপড় বিতরণ করা হয়, কিন্তু আপনার পরনে তো ২টি নতুন কাপড় দেখা যাচ্ছে। ‘এতে আপনার জবাব কী?’ খলিফা দাঁড়িয়ে থেকে জবাব দিয়ে বলেছিলেন যে, আমার পরনে নতুন দুটি কাপড়ের মধ্যে একটি আমার পুত্রের ও অন্যটি আমার নিজের। অথচ এ ধরনের প্রশ্ন যদি আমাদের দেশের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, এমপি বা নেতাদের করা হয় তবে প্রশ্নকারীর ঘারে মাথা থাকবে কি? তৎসময়ে রাষ্ট্র নায়কদের জবাবদিহিতার মানসিকতা ছিল বলেই হজরত ওমর রা: প্রশ্নকারীর জবাব দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছিলেন।
৪২ জন বিশিষ্ট নাগরিকের অভিযোগের পরও তদন্ত কি আলোর মুখ দেখবে না? নাকি কলাপাতার মতো শুকিয়ে যাবে? কলাপাতা শুকানোর পর জ্বালানি হিসেবে এখনো গ্রামগঞ্জে ব্যবহৃত হয়। ৪২ জন নাগরিকের অভিযোগ যদি যথাযথ বিধিমতে আমলে নেয়া না হয় তবে দেশবাসীর মনের আগুন জ্বলে উঠতে পারে।
৪২ জন নাগরিকের অভিযোগ তদন্তের আগেই প্রধান নির্বাচন কমিশনার অন্য কমিশনারদের সাথে নিয়ে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। অবস্থা দৃষ্টে মনে হলো যে, ‘ঠাকুর ঘরে কে রে, আমি কলা খাই না।’ নির্বাচন কমিশন যদি এতই স্বচ্ছ থাকে তদন্তের বিরোধিতা তারা করবে কেন? অন্যতম একজন নির্বাচন কমিশনারের বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত বক্তব্যই প্রমাণ করে যে, প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ কমিশন একটি দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। শপথ গ্রহণ করে দায়িত্ব নেয়ার পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার জাতির সামনে সত্য গোপন করে যেসব অসত্য কথা বলেন তা শুনে শুনে জাতি হয়রান হয়ে পড়েছে।
৪২ জন নাগরিকের অভিযোগ যদি রাষ্ট্রপতি আমলে না নেন তবে জাতির মনে এমন একটি ধারণা বদ্ধমূল হবে যে, সত্য উদঘাটনে রাষ্ট্রপতির সদিচ্ছায় প্রতিবদ্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। অন্য দিকে তদন্তের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছা অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করে। তবে প্রধানমন্ত্রীর পূর্বাপর বক্তব্য এবং মন্ত্রীদের সরাসরি বক্তব্যে প্রমাণ করে, নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের তদন্ত হোক প্রধানমন্ত্রীর সরকার তা সমর্থন করে না, বরং বিরোধিতা করছে।
আমাদের দেশে এখন নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র চলছে, অর্থাৎ সরকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কেউ মুখ খুলতে পারবে না। সরকারি দল বা সরকার সমর্থিত দল রাজপথে মিটিং মিছিল করতে পারবে, কিন্তু বিরোধী দল করতে পারবে না। দেশে যদি স্বচ্ছভাবে গণতন্ত্র চালু থাকত তবে ৪২ বিশিষ্ট নাগরিক কর্তৃক নির্বাচন কমিশনের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের তদন্তের কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হতো না। সরকারি ভাষ্য মতে দেশে এখন উন্নয়নের জোয়ারে গণতন্ত্র নির্বাসিত।
লেখক : রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
E-mail: [email protected]