বিভীষিকা!

Daily Nayadiganta (নয়া দিগন্ত) : Most Popular Bangla Newspaper

লেখক : সৈয়দ আবদাল আহমদ – ফাইল ছবি


তাহেরের বিদেশিনী স্ত্রী লিলিয়ান অবাক হয়ে চার দিকে তাকাচ্ছে। তাহের বলল, লিলি। এই দেখো এই ঘরটার নাম আয়নাঘর। জানালাবিহীন ছোট্ট একটা কামরা, যার দেয়ালজুড়ে প্রকাণ্ড সব আয়না। তাহের বলল, আমার পূর্ব পুরুষদের রূপবতী তরুণী বধূরা দরজা বন্ধ করে এই ঘরে সাজ করত।
‘যারা রূপবতী নয় তারা কী করত?’
‘আমি কথার কথা বললাম। যারা রূপবতী নয় তারাও নিশ্চয়ই যেত।’
‘ঘরটা তো অন্ধকার। জানালা নেই। দরজা বন্ধ করলে আলো আসবে না।’
‘এই ঘরে ঢুকতে হতো প্রদীপ নিয়ে। চার দিকে আয়না তো, প্রদীপ জ্বালালেই অন্যরকম অ্যাফেক্ট হয়। তুমি মোমবাতি জ্বালাও, দেখো কেমন লাগে।’
‘তুমি অন্য ঘরে যাও। আমি একা একা মোমবাতি জ্বালাব।’

তাহের চলে গেল। লিলিয়ান দরজা বন্ধ করে, মোমবাতি জ্বালাল। সাথে সাথে ঘরটা যেন বদলে গেল। লিলিয়ানের মনে হলো। আয়নার ভেতর থেকে কে যেন তাকে দেখছে। অবাক হয়ে দেখছে!

দেশের কিংবদন্তি কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয় উপন্যাস আয়নাঘরের সংলাপ। পড়তেই মন চায়। টেনে নিয়ে যায়। এর মধ্যে কেমন যেন রহস্য লুকিয়ে আছে।

না, যে আয়নাঘরের কথা এখানে লিখছি সেটা সম্পূর্ণ অন্য এক আয়নাঘর। এই আয়নাঘর নিয়ে বর্তমানে চলছে তোলপাড়। সর্বত্র আলোচনা। হুমায়ূন আহমেদের আয়নাঘরের সাথে এর মিল নেই। বধূরা এখানে সাজ করতে যায় না। তবে এ আয়নাঘরেও আছে রহস্য! অনলাইন পোর্টাল নেত্র নিউজ এই আয়নাঘরের সন্ধান দিয়েছে। তারা অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলেছে, সরকারের বিশেষ একটি নিরাপত্তা সংস্থা এই আয়নাঘর বানিয়েছে। এটি এক অবৈধ আটক কেন্দ্র। এই আয়নাঘরে গুম হওয়া ব্যক্তিদের নিয়ে রাখা হয়। বীভৎস নির্যাতনের মাধ্যমে জেরা করা হয়। অসহায় ওই ব্যক্তিদের সম্পর্কে কেউ কিছু জানতে পারে না।

গুম হওয়া বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর সন্ধান পাওয়া যায়নি বেশ কয়েক বছর হলো। তার কিশোর ছেলেটি বড় হয়েছে। কয়েক দিন আগে তার বিয়ে হয়েছে। কিন্তু এই বিয়েতে তার বাবা উপস্থিত ছিলেন না। ইলিয়াস আলী কি আছেন এই আয়নাঘরে? আমরা জানি না। আমরা এও জানি না, ওই আয়নাঘরে অকথ্য নির্যাতনে তিনি মারা গেছেন কিনা। তেমনি আমরা জানি না ১২ বছর আগে গুম হওয়া ওয়ার্ড কমিশনার চৌধুরী আলমকে ওই আয়নাঘরে নেয়া হয়েছিল কিনা? তিনি বেঁচে আছেন কিনা?

জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলের বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। চার দিনের সফর শেষে ১৭ আগস্ট বুধবার স্থানীয় একটি হোটেলে সংবাদ সম্মেলন করে তিনি সরকারের কাছে বাংলাদেশের গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং নির্যাতনের গুরুতর অভিযোগের বিষয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। অভিযোগগুলো সুরাহা করতে তিনি স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ তদন্তের প্রস্তাব করেছেন।

তিনি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন সংস্কারেরও আহ্বান জানিয়েছেন। মিশেল ব্যাচেলের লিখিত বক্তব্যে বলেছেন, জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার পরিষদের বিভিন্ন কমিটি কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশের গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা এবং নির্যাতন নিয়ে যেসব উদ্বেগ জানিয়েছে, তার অধিকাংশ ঘটনায় র‌্যাব যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে জবাবদিহিতার অভাব দেখা গেছে। বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা যাতে মানবাধিকার সুরক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখেন তা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, জাতিসঙ্ঘ শান্তিরক্ষা মিশনের সর্বোচ্চসংখ্যক সদস্য মোতায়েনকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশকে এটা নিশ্চিত করতে হবে। ইতঃপূর্বে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্র র‌্যাবের সাবেক ও বর্তমান সাত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। এতে বলা হয়েছিল ২০০৯ সাল থেকে র‌্যাবের বিরুদ্ধে ৬০০ জনকে বিচারবহির্ভূত হত্যা ও ৬০০ জনকে গুম করার অভিযোগ রয়েছে।

সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ নামে একটি সংগঠন গত মার্চ মাসে ‘হয়্যার আর দে’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে গত তিন বছরে (২০১৯-২০২১) গুমের অভিযোগ উঠেছে এমন ৭১টি ঘটনার বিস্তারিত তথ্য তারা সংগ্রহ করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়। এই ৭১ জনের মধ্যে ১৬ জনকে মার্চ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি, পাঁচজনের মৃতদেহ পাওয়া যায় এবং ২২ জনের ব্যাপারে পরিবারের অভিযোগ ছিল তাদের ‘তুলে নেয়া’ হয়েছে। বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের হিসাব অনুযায়ী ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত গুমের শিকার হয়েছেন ৫২২ জন। আর বর্তমান সময় পর্যন্ত ৬০০ জনের বেশি।

অনলাইন পোর্টাল নেত্র নিউজের অনুসন্ধানী তথ্যচিত্র আয়নাঘর প্রচারিত হওয়ার পর এই গোপন অবৈধ কারাগার নিয়ে বিভিন্ন মহলে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে।

বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের কর্মীরা গত বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাজু ভাস্কর্যের সামনে প্ল্যাকার্ডে তুলে ধরেন ‘আয়নাঘরে’ বন্দীদের দেয়াল লিখন। একটি প্ল্যাকার্ডে লেখা আছে- ‘প্লিজ আমার মাকে জানায়েন আমি এখনো বাঁইচা আছি’। আরেকটিতে লেখা- ‘আমার পরিবারের মোবাইল নং- ০১৭…, আপনারা কেউ এই নম্বরে কল দিয়া বইলেন- আমি জীবিত আছি।’

গত ১৯ আগস্ট বিবিসির রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো অত্যন্ত সোচ্চার। বিশেষ করে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও নির্যাতন নিয়ে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বছরের পর বছর ধরে ডজন ডজন রিপোর্ট প্রকাশ করে চলেছে, সতর্কও করেছে। কিন্তু এসব বিষয়কে গুরুত্ব দেয়নি সরকার। হংকংভিত্তিক এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশনের এক পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৯ সাল থেকে অর্থাৎ বর্তমান আওয়ামী লীগের সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে এ বছর জুন ২০২২ পর্যন্ত বাংলাদেশে ৬১৯ জন নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে আটকের পর লাপাত্তা হয়ে গেছেন এবং কমপক্ষে দুই হাজার ৬৫৮ জন মানুষকে বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে।

ঢাকার বাসিন্দা আফরোজা ইসলামের একটি সাক্ষাৎকার প্রচার করে বিবিসি। আফরোজা ইসলাম বলেন, ২০১৪ সালে জানুয়ারি নির্বাচনের ঠিক এক মাস আগে তার ভাই সাজেদুল ইসলামকে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে র‌্যাব তুলে নিয়ে যায়। তারপর থেকে তার খোঁজ পায়নি তারা। আফরোজা ইসলাম বলেন, ভাইয়ের খোঁজে তার পরিবার র‌্যাব হেডকোয়ার্টার, র‌্যাব-ওয়ান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ প্রতিটি জায়গায় দরখাস্ত দিয়েছেন, সাক্ষাৎ করেছেন। কিন্তু সাজেদুল ইসলামের খোঁজ পাওয়া যায়নি। তিনি বলেন, আমি জানতে চাই কেন আমার ভাইকে তুলে নেয়া হলো?

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের দক্ষিণ এশিয়া কার্যক্রমের প্রধান মিনাক্ষী গাঙ্গুলী বিবিসিকে বলেন, বাংলাদেশের সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে এমন কথা শুনতে একেবারেই নারাজ। আমরা ৯০টি দেশে কাজ করি। সব দেশেই কম বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়। কিন্তু ভয়াবহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে চললেও মানবাধিকারের লঙ্ঘন হয়েছে বাংলাদেশ সরকার এ কথা শুনতেই রাজি হতে চায় না। সব অভিযোগ তদন্ত করা হয় সরকারের এমন কথা একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়।

শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে গুম হওয়া প্রিয়জনদের খোঁজ পেতে মানববন্ধনে দাঁড়িয়েছিলেন ৪২টি পরিবারের সদস্যরা। গুমের শিকার হওয়া স্বজনদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ এই মানববন্ধনের আয়োজন করে।

নিখোঁজ বাবা পারভেজ হোসেনের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে তার মেয়ে আদিবা ইসলাম। ছোট্ট আদিবা কেঁদে কেঁদে বলে, ‘বাবাকে ছাড়া একটুও ভাল্লাগে না। আমার কিচ্ছু ভাল্লাগে না।’ আদিবার বয়স যখন দুই বছর তখন তার বাবা গুম হয়। এখন আদিবার বয়স হয়েছে ১১ বছর। মায়ের হাত ধরে মানববন্ধনে দাঁড়িয়েছিল সে।

আদিবার বাবার মতো হাফসা ইসলামের বাবা সাজেদুল ইসলামও গুম হন ২০১৩ সালে। বাবার কথা বলতে গিয়ে হাফসা কেঁদে কেঁদে বলেন, ‘আমি একটি কথাই বলতে চাই, যদি আমার বাবাকে মেরে ফেলে থাকেন, তাহলে লাশটা একটু দেখতে দিন। আমি আমার বাবার লাশটা একটু ছুঁয়ে দেখতে চাই।’

মানববন্ধনে সংহতি জানিয়ে বক্তব্য দেন ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি বলেন, পৃথিবীর সবচেয়ে কুখ্যাত কারাগার হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের গুয়ানতানামো বে। ওই কারাগারে বন্দীদের নির্যাতনের কারণে সারা পৃথিবী তাদের ধিক্কার দিচ্ছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য বাংলাদেশে শত শত মা, মেয়ে, তাদের বাবাকে খুঁজে পাচ্ছেন না। মানববন্ধনে ড. আসিফ নজরুল বলেন, সরকার বলে ৬০০ থেকে ৭০০ লোক নাকি পালিয়ে বেড়াচ্ছে। এই সরকার ১৩ বছর ধরে ক্ষমতায়। তারা কেন ৭০০ লোককে খুঁজে বের করতে পারে না? মায়ের ডাকের সমন্বয়কারী সানজিদা ইসলাম বলেন, আয়নাঘরে যারা আছেন, তাদের জীবিত অবস্থায় পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিন। আয়নাঘরই যেন তাদের ভাগ্যলিপি হয়ে না দাঁড়ায়।

আয়নাঘরের বিভীষিকা ও অব্যাহত গুম ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার তদন্ত দাবি করেছেন। দেশের ২৭ জন বিশিষ্ট নাগরিক এক বিবৃতিতে গুম, নির্যাতন ও অবৈধ আটক সম্পূর্ণভাবে বন্ধের দাবি জানিয়েছেন। তারা বিবৃতিতে বলেন, আয়নাঘর নামে গোপন স্থানে আটকে রাখাসংক্রান্ত একটি তথ্যচিত্রে গুম ও অবৈধ আটকের শিকার ব্যক্তিদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার যে বিবরণ পাওয়া গেছে তাতে আমরা উদ্বিগ্ন।

গণস্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছেন, দেশে একের পর এক গুমের কাহিনী, এটা শেষ হওয়ার নয়। এর পরিবর্তন দরকার। আয়নাঘরকে চূর্ণবিচ‚র্ণ করে দেয়া দরকার। নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, ২০১৫ সালে তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে প্রায় ৪০ ঘণ্টা গুম করে রাখা হয়। চোখ বেঁধে কোনো একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়। ওই সময় তিনি পাশের ঘরগুলো থেকে চিৎকারের শব্দ শুনেছেন। তার প্রশ্ন আমাকেও কি তখন আয়নাঘরে রাখা হয়েছিল? মাহমুদুর রহমান মান্না বাংলাদেশে সঙ্ঘটিত সব গুমের আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি করেন।

অর্থনীতিবিদ ও তেল-গ্যাস জাতীয় স্বার্থ রক্ষা কমিটির নেতা অধ্যাপক আনু মোহাম্মদ ফেসবুকে লেখেন, ‘এবার গুম করা মানুষদের দুনিয়ার কাছে ফেরত দিন। গুম, নির্যাতন, ক্রসফায়ার, হেফাজতে খুন নিয়ে মিথ্যাচার অনেক করেছেন। এবার সবার কাছে এর সব তথ্য উন্মোচিত হোক। যারা ঠাণ্ডা মাথায় এই ভয়ঙ্কর কাজগুলো করেছে তাদের চিহ্নিত করতেই হবে।’

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাতীয় প্রেস ক্লাব

Email: [email protected]