বিদেশি বিনিয়োগ আসার চেয়ে ফেরত যাওয়া বেড়েছে

 দেশে চলমান ডলার সংকটেও বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) সুখবর দিতে পারেনি। ২০২২-২৩ অর্থবছর তার আগের অর্থবছরের তুলনায় সোয়া চার শতাংশ কম এসেছে মোট এফডিআই। মূলত বৈশ্বিক অস্থিরতার কারণে ২০২২ সালের সংকটের মুখোমুখি পড়ে দেশের অর্থনীতি। পাশাপাশি বাংলাদেশ থেকে বিদেশি বিনিয়োগ প্রত্যাহারের পরিমাণও বেড়েছে। এর ফলে ২০২২-২৩ অর্থবছর নিট বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা গেছে।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত অর্থবছর গ্রস বিনিয়োগ হয়েছে ৪ দশমিক ৪৩৮ বিলিয়ন ডলার, যা তার আগের অর্থবছরে ছিল ৪ দশমিক ৬৩৬ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে গ্রস বিনিয়োগ কমেছে ৪ দশমিক ২৭ শতাংশ। ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট বিদেশি বিনিয়োগে শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে ছিল যুক্তরাজ্য, দক্ষিণ কোরিয়া, হংকং ও নেদারল্যান্ডস।

অপরদিকে গত অর্থবছরে বিনিয়োগ ফেরত নিয়ে যাওয়া হয় ১ দশমিক ২৪৩ বিলিয়ন ডলার। তার আগের অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ১ দশমিক ১৯৬ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে বিনিয়োগ প্রত্যাহার বেড়েছে ৩ দশমিক ৯৩ শতাংশ। এ সময় সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ প্রত্যাহার করেছে দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, হংকং ও সিঙ্গাপুর।

প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত অর্থবছরে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করা দেশ যুক্তরাজ্য। এর পরিমাণ ছিল ৬২২ মিলিয়ন ডলার। তবে দেশটি মাত্র ৫৭ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ প্রত্যাহার করেছে। এতে দেশটির নিট বিনিয়োগ দাঁড়ায় প্রায় ৫৬৫ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ব্যাংকিং খাতে ২৩৪ মিলিয়ন ডলার ও টেক্সটাইল খাতে ১৮৭ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ ছিল।

গত অর্থবছর বাংলাদেশে নিট বিদেশি বিনিয়োগে দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল নেদারল্যান্ডস। দেশটি প্রায় ৫১৩ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। তবে বিনিয়োগ প্রত্যাহার করেছে অনেক কম, মাত্র ৭৭ মিলিয়ন ডলার। এতে দেশটির নিট বিনিয়োগ দাঁড়ায় ৪৩৬ মিলিয়ন ডলার। নেদারল্যান্ডস খাদ্য খাতে ১৫১ মিলিয়ন এবং গ্যাস ও পেট্রোলিয়াম খাতে ১০২ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে।

যদিও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৬০৩ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ আসে। তবে এ সময় দেশটি বাংলাদেশ থেকে ৩০৮ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ ফেরত নিয়ে গেছে। ফলে গত অর্থবছরে দেশটি থেকে বাংলাদেশে নিট বিনিয়োগ দাঁড়ায় ২৯৫ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে ১৬০ মিলিয়ন ডলারই এসেছে টেক্সটাইল খাতে।

গত অর্থবছরে চীন থেকে বিনিয়োগ এসেছে ২৩২ মিলিয়ন ডলারের। এর মধ্যে দেশটি বাংলাদেশ থেকে ২০৩ মিলিয়ন ডলারই ফেরত নিয়ে গেছে। ফলে গত অর্থবছর চীনের নিট বিনিয়োগ দাঁড়ায় মাত্র ২৯ মিলিয়ন ডলার। আর গত অর্থবছর হংকংয়ের বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ৩৭১ মিলিয়ন ডলারের। এর মধ্যে দেশটি ১৮৭ মিলিয়ন ডলার ফেরত নিয়ে গেছে। এতে করে দেশটির গত অর্থবছরে বাংলাদেশে নিট বিনিয়োগ ছিল ১৮৪ মিলিয়ন ডলার। দেশটি প্রায় ১১৭ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে বিদ্যুৎ খাতে।

এছাড়া গত অর্থবছরে সিঙ্গাপুরও বিনিয়োগ ফেরত নিয়ে গেছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশটির বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছে প্রায় ৩৩১ মিলিয়ন ডলার। একই সময়ে ১৩৯ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ ফেরত যায়। ফলে দেশটির নিট বিনিয়োগ দাঁড়ায় ১৯২ মিলিয়ন ডলারে। সিঙ্গাপুর বিদ্যুৎ খাতে সর্বোচ্চ ৩৫ মিলিয়ন ডলার নিট বিনিয়োগ করেছে।

যুক্তরাষ্ট্র গত অর্থবছরে বাংলাদেশে ৩৪৭ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। আর বিনিয়োগ প্রত্যাহার করেছে মাত্র ৫৮ মিলিয়ন ডলার। ফেরত নেয়ার পর দেশটির নিট বিনিয়োগ দাঁড়িয়েছে ২৮৯ মিলিয়ন ডলার। জাপান ১০৭ মিলিয়ন বিনিয়োগ করলেও গত অর্থবছরে ২৮ মিলিয়ন ডলারই ফেরত নেয়। এতে নিট বিনিয়োগ দাঁড়ায় ৭৯ মিলিয়ন ডলার।

একইভাবে গত অর্থবছরে ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া এবং নরওয়ে বাংলাদেশ থেকে বিনিয়োগ ফেরত নিয়ে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত অর্থবছরে বাংলাদেশে ভারতের বিনিয়োগ ছিল প্রায় ১৪২ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে প্রত্যাহার করে ২২ মিলিয়ন ডলার। এতে করে নিট বিনিয়োগ দাঁড়ায় ১২০ মিলিয়ন ডলার। সংযুক্ত আরব আমিরাত ১০২ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করলেও প্রত্যাহার করে ১২ মিলিয়ন। আর বিদায়ী অর্থবছরে মালয়েশিয়ার মোট ১০৫ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের বিপরীতে ফেরত নেয় ৬ মিলিয়ন ডলার। এছাড়া নরওয়ের মোট বিনিয়োগ ছিল ১৮৯ মিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে দেশটি প্রায় ৫ মিলিয়ন ডলার ফেরত নিয়ে যায়।

অন্যদিকে গত অর্থবছরে কোনো বিনিয়োগ ফেরত নেয়নি মালটা। দেশটি ২০২২-২৩ অর্থবছর বাংলাদেশে মোট ১৭১ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে। কোনো অর্থ ফেরত না নেয়াতে নিট বিনিয়োগে কোনো পরিবর্তন আসেনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, গত অর্থবছর সর্বোচ্চ বিনিয়োগ এসেছে টেক্সটাইল খাতে এক দশমিক ২২৯ বিলিয়ন ডলার। তবে এর মধ্যে ৪৬ শতাংশ ৫৬৭ মিলিয়ন ডলার ফেরত গেছে। ফলে খাতটিতে নিট বিনিয়োগ দাঁড়ায় ৬৬২ মিলিয়ন ডলার। এর বড় অংশই যুক্তরাজ্য ও দক্ষিণ কোরিয়ার।

এদিকে বিদ্যুৎ খাতে প্রায় ৪৪০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ এলেও ১৩৯ মিলিয়ন ডলারই ফেরত গেছে। নিট বিনিয়োগ দাঁড়ায় ৩০১ মিলিয়ন ডলার। ব্যাংকিং খাতে ৪০৩ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ এলেও ফেরত গেছে ৩৬ মিলিয়ন ডলার। আর গ্যাস ও পেট্রোলিয়াম খাতে ৩৪০ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ আসার বিপরীতে ফেরত গেছে ১৪ মিলিয়ন ডলার। আর টেলিকম খাতে আসা ৪৩৬ মিলিয়ন ডলারের প্রায় পুরোটাই বিনিয়োগ রয়ে গেছে। ফেরত গিয়েছে মাত্র ১ মিলিয়ন ডলার।