বিদেশি ঋণ নেওয়ার হিড়িকে অর্থনীতির বিপদ

ড. মইনুল ইসলাম : দৈনিক বণিক বার্তা গত ২৬ অক্টোবর প্রথম পৃষ্ঠার দ্বিতীয় লিড স্টোরিতে বলেছে, ২০২৩ সালের জুনে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯৮ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে ৭৬ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে সরকার ও সরকারি সংস্থাগুলো।

বাকি ২২ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছে দেশের বেসরকারি খাত। এর মানে সরকারি-বেসরকারি বিদেশি ঋণের বর্তমান স্থিতি দেশের মোট জিডিপির ২১ দশমিক ৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। মোট বিদেশি ঋণের মধ্যে ৮২ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলারই দীর্ঘমেয়াদি; আর ১৬ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলার স্বল্পমেয়াদি।

২০১৫-১৬ অর্থবছরের শেষে সরকারি-বেসরকারি খাতের মোট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ৪১ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে ৩৪ দশমিক ১৯ বিলিয়ন ডলার দীর্ঘমেয়াদি। ওই পর্যায়ে বিদেশি ঋণ ছিল জিডিপির ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ। ওই সময় বৈদেশিক ঋণের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৯ দশমিক ৭ শতাংশ। এর পর থেকে বিদেশি ঋণ গ্রহণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে উচ্চহারে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে ১৯ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। ২০২১-২২ অর্থবছরেও বৈদেশিক ঋণের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১৬ দশমিক ৯ শতাংশ। সরকারি ঋণের পাশাপাশি বেসরকারি খাতেও এর পর দ্রুত বিদেশি ঋণ বাড়তে থাকে। পাঁচ বছরে বেসরকারি খাতের ঋণ ১২ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ২৫ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে পৌঁছে। ২০২৩ সালের জুনে বেসরকারি বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল ২২ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার।

ওপরে বৈদেশিক ঋণের যে চিত্র দেওয়া হয়েছে, সেটা বাংলাদেশ ব্যাংকের এ সংক্রান্ত প্রক্ষেপণকে ১৮ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ছাড়িয়ে গেছে (২২%)। কারণ বাংলাদেশ ব্যাংকের ‘সর্বোচ্চ উচ্চাভিলাষী’ প্রক্ষেপণ অনুযায়ী ২০২৩ সালের শেষে গিয়ে বৈদেশিক ঋণ হওয়ার কথা ছিল ৮১ বিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালে তাদের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী ৬৫ দশমিক ২৭ বিলিয়ন থেকে বেড়ে ২০২৩ সালের শেষে রক্ষণশীল হিসাবে ৬৭ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার, স্বাভাবিক হিসাবে ৭৬ দশমিক ২৯ বিলিয়ন এবং উচ্চাভিলাষী হিসাবে সর্বোচ্চ ৮১ বিলিয়ন ডলার হবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছিল। এই প্রক্ষেপণ কতখানি অবাস্তব সরলীকরণ, সেটা সত্যিকার বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের হিড়িক প্রমাণ করে দিয়েছে।

সরকারের কাছে এমন প্রক্ষেপণের কোনো মূল্য নেই– তারই জলজ্যান্ত প্রমাণ খামখেয়ালিভাবে গৃহীত নানা প্রকল্পে ইচ্ছামতো বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের হিড়িক, যার মাধ্যমে তিন বছরের মধ্যেই বিদেশি ঋণকে প্রায় ৯৯ বিলিয়ন ডলারে উল্লম্ফন করা হয়েছে। অর্থনীতি বিপদে পড়বে যখন ২০২৫ সাল থেকে এই খামখেয়ালিপনার খেসারত হিসেবে ঋণগুলোর সুদাসলে কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়ে যাবে। ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে সরকারি প্রশাসন খাতে ব্যয় বরাদ্দের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১৮ শতাংশ ব্যয় বরাদ্দ রাখতে হয়েছিল সরকারি ঋণের সুদ পরিশোধ খাতে; মোট ৮০ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে ঋণের সুদ পরিশোধ খাতে বরাদ্দের প্রস্তাব রাখা হয়েছে ৯৪ হাজার কোটি টাকা। শুধু বৈদেশিক ঋণের সুদাসলে কিস্তি পরিশোধ ২০২২-২৩ অর্থবছরের ২ দশমিক ৭৪ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে হয়তো ৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের এমন উচ্চ প্রবৃদ্ধি ২০২৯ সাল পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। আরও দুঃখজনক, এসব ঋণের অর্থে চলমান প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন যখন সম্পন্ন হবে তখন এগুলোর আয় থেকে ঋণের কিস্তির অতি সামান্য অংশ পরিশোধ করা সম্ভব হবে। বাকি অর্থ জনগণের ওপর দীর্ঘমেয়াদি বোঝা হিসেবে চেপে বসবে।

বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ কিংবা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মতো আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে এখনও ‘সফট লোন’ পাওয়া গেলে আমরা নিতে আগ্রহী হই। কিন্তু আমাদের বৈদেশিক ঋণের সিংহভাগই এখন ‘সাপ্লায়ারস ক্রেডিট’। সাপ্লায়ারস ক্রেডিটের অসুবিধা হলো, জোগানদাতারা প্রকল্পের প্লান্ট, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম ঋণ হিসেবে দেওয়ার সময় প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক বাজারদরের চেয়ে অনেক বেশি দাম ধরে ঋণের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়।

উপরন্তু সাপ্লায়ারস ক্রেডিটের সুদের হারও সফট লোনের সুদের হারের চেয়ে বেশি; ঋণ পরিশোধের সময়সীমাও কম থাকে। আরও গুরুতর হলো, সাপ্লায়ারস ক্রেডিটে রাজনীতিবিদ, ঠিকাদার ব্যবসায়ী ও আমলাদের ‘মার্জিনের হার’ অনেক বেশি হয়ে থাকে। সে জন্য সাপ্লায়ারস ক্রেডিটকে লুটপাটের অর্থনীতির সবচেয়ে বহুল ব্যবহৃত মেকানিজম বলে অভিহিত করা হয়।

দুঃখজনক, সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশে সাপ্লায়ারস ক্রেডিট শাসক মহলের দুর্নীতি ও পুঁজি লুণ্ঠনের সবচেয়ে ভয়াবহ হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। সে জন্য বাংলাদেশের মেগা প্রকল্পগুলোর ব্যয় বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক হয়ে যাচ্ছে। কারণ এসব প্রকল্প থেকে পুঁজি লুণ্ঠন এখন শাসক দলের নেতা ও প্রধানমন্ত্রীর পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত ব্যবসায়ীদের লোভনীয় ধান্দা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আন্তর্জাতিক ঋণদান সংস্থা বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে হলে যেহেতু তাদের অনেক কঠিন শর্ত পরিপালনে শাসকরা জটিলতার সম্মুখীন হন; তাই বাংলাদেশে ২০০৯ সাল থেকে বর্তমান সরকার প্রধানত সাপ্লায়ারস ক্রেডিটের প্রতি অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়েছে।

চীন যেহেতু এখন তাদের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে উদারভাবে সাপ্লায়ারস ক্রেডিট দেওয়ার নীতি বাস্তবায়নে তৎপর, তাই দেড় দশক ধরে চীনের সাপ্লায়ারস ক্রেডিট পাওয়া অনেক সহজ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ এ পর্যন্ত চীন থেকে মোট ১ হাজার ৮৫৪ কোটি ডলার ঋণ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে গত ১০ বছরে বাংলাদেশ চীন থেকে সাপ্লায়ারস ক্রেডিট নিয়ে মোট ১২টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করে চলেছে। চীনা সাপ্লায়ারস ক্রেডিটে যেসব মেগা প্রকল্প এ দেশে বাস্তবায়িত হয়েছে বা বাস্তবায়নাধীন, সেগুলো হলো পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-যশোর-পায়রা রেলপথ প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প এবং ঢাকা-গাজীপুর বিআরটি প্রকল্প।

জাপানের জাইকার সাপ্লায়ারস ক্রেডিটে অর্থায়িত যেসব মেগা প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে বা বাস্তবায়নাধীন, সেগুলো হলো ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্প, মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ী কয়লাচালিত বিদ্যুৎ প্রকল্প, হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল, যমুনা রেল সেতু এবং চট্টগ্রাম আউটার রিং রোড। ঢাকা-যশোর রেলপথ এবং ঢাকা-গাজীপুর বিআরটি প্রকল্প নিঃসন্দেহে নিকৃষ্ট প্রকল্প। কিন্তু বাংলাদেশের নিকৃষ্টতম ‘সাপ্লায়ারস ক্রেডিট প্রকল্প’ ১২ বিলিয়ন ডলার রাশিয়ান ঋণে নির্মীয়মাণ রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। এটি আক্ষরিকভাবেই ‘সাদা হাতি প্রকল্প’।

দুই ইউনিটের এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে প্রাক্কলিত ব্যয় হবে ১৩শ ৫০ কোটি ডলার। ইউনিট দুটোর কাজ শেষ হতে সময় লাগবে ২০২৪ সাল পর্যন্ত। এই দুটো ইউনিট থেকে ২৪শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রাক্কলিত নির্মাণ ব্যয় ১৩শ ৫০ কোটি ডলারের মধ্যে ১২শ কোটি ডলার ঋণ দেবে রাশিয়া, বাকি দেড়শ কোটি ডলার বাংলাদেশ ব্যয় করবে। রাশিয়ার ঋণের সুদহার হবে ৪ শতাংশ, যা ১০ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ২৮ বছরে বাংলাদেশকে সুদাসলে পরিশোধ করতে হবে। রাশিয়ার রোসাটম নামের যে প্রতিষ্ঠানটি এই প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডি করেছে, তারা প্রতিবেদনে দাবি করেছে, আনুমানিক ৬০ বছর আয়ু হবে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের। নির্মাণ সম্পন্ন হওয়ার পর এক বছর রোসাটম প্লান্টটি পরিচালনা করবে।

অনেকেরই জানা নেই, মাত্র ৬ বিলিয়ন ডলার রাশিয়ান ঋণে ভারতের তামিলনাড়ুর কুদান কুলামে দুই হাজার মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ প্লান্ট স্থাপিত হয়েছে কয়েক বছর আগে। অথচ আমাদের ২৪শ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ প্লান্টের জন্য ১২ বিলিয়ন ডলার রাশিয়ান ঋণ নিতে হচ্ছে কেন? এত বেশি ‘ইনফ্লেটেড প্রজেক্ট কস্ট’ দেখিয়ে রাশিয়া কি বাংলাদেশের বন্ধুর পরিচয় দিয়েছে? বাংলাদেশ সরকারের কর্তাব্যক্তিদের উচ্চ মার্জিন কি এই উচ্চ ব্যয়ের জন্য দায়ী? ২০২৫ সাল থেকে ২৮ বছর ধরে প্রতি বছর ৫৬৫ মিলিয়ন ডলার ঋণের কিস্তি পরিশোধ করে যেতে হবে আমাদের।

স্বল্প প্রয়োজনীয় প্রকল্পে যথাযথ ফিজিবিলিটি স্টাডি ছাড়া খামখেয়ালিভাবে বিনিয়োগের হিড়িকের ব্যাপারে আমি আপত্তি জানানোয় কেউ কেউ আমাকে ‘অর্বাচীন অর্থনীতিবিদ’ আখ্যা দিয়েছিলেন। আজ দেখা যাচ্ছে, আমার সাবধানবাণী কতটা সঠিক ছিল।

ড. মইনুল ইসলাম: অর্থনীতিবিদ, সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি