বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি

দেশের উন্নয়ন কার্যক্রমের একটি বড় অংশের অর্থের জোগান নিশ্চিত হয় বিদেশি ঋণের মাধ্যমে। আগে স্বল্পসুদের ঋণের পরিমাণ বেশি থাকলেও বিগত এক দশকে কঠিন শর্তের বেশি সুদের ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধ। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধের পরিমাণ আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সর্বশেষ হালনাগাদ মাসিক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে বিদেশি ঋণের বিপরীতে পরিশোধ করা সুদের পরিমাণ ছিল ৩৬ কোটি ৫৮ লাখ ৭০ হাজার ডলার। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের একই সময়ে সেই সুদ পরিশোধের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে ৭৬ কোটি সাত লাখ ৪০ হাজার ডলার। একই সঙ্গে আসল পরিশোধের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে। গত অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে আসল পরিশোধের পরিমাণ ছিল ৯১ কোটি ৮৯ লাখ ১০ হাজার ডলার। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে তার পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ১০৯ কোটি ৬০ লাখ ৩০ হাজার ডলার। বৈদেশিক ঋণের সুদ ও আসল মিলে চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে পরিশোধ করতে হয়েছে ১৮৫ কোটি ৬৭ লাখ ৭০ হাজার ডলার, টাকার অঙ্কে যা ২০ হাজার ৪১৮ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। গত অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ১২৮ কোটি ৪৭ লাখ ৮০ হাজার ডলার, টাকার অঙ্কে ১২ হাজার ৪৩৬ কোটি ২৭ লাখ টাকা।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সরকার কঠিন শর্তের ঋণের পরিমাণ বাড়িয়েছে। ওই সব ঋণের রেয়াতকাল (গ্রেস পিরিয়ড) শেষ হয়ে আসছে। ফলে আসল ও সুদ উভয়ই পরিশোধ করতে হচ্ছে এখন, যে কারণে বিদেশি ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য সম্প্রতি শেয়ার বিজকে বলেন, ‘আমরা ২০২২ সালেই বলেছিলাম, বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ পরিস্থিতি বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। আমরা এও বলেছিলাম, ২০২৪ সালের পর থেকে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হবে, যা রিজার্ভের ওপর অনেক বেশি বিরূপ প্রভাব ফেলবে। কিন্তু আমাদের সে বক্তব্যকে সরকারের নীতিপ্রণেতারা তখন গুরুত্ব দেননি এবং নানা যুক্তি দিয়ে তারা বুঝিয়েছিলেন, বিদেশি ঋণ নিয়ে বাংলাদেশের কোনো সমস্যা হবে না। কিন্তু প্রকৃত অর্থে এখন সমস্যা হচ্ছে এবং ঋণ পরিশোধের চাপ সামলানোর জন্য আমদানি সংকোচন করতে হচ্ছে। এ পরিস্থতির জন্য ওইসব নীতিপ্রণেতাই দায়ী। এখন তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত।’

তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ পরিস্থিতির স্থিতিশীলতা (ডেট সাসটেইনেবিলিটি) এখন পুনর্মূল্যায়ন করা প্রয়োজন এবং সেই মূল্যায়নের ভিত্তিতেই আগামী দিনে ঋণগ্রহণের সীমা নির্ধারণ করা উচিত। বিদ্যমান ব্যবস্থা চলতে থাকলে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াতে পারে।

এদিকে বাংলাদেশের বৈদেশিক সহায়তার ক্ষেত্রে একসময় খাদ্য সহায়তা একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত ছিল। মূলত অর্থনৈতিকভাবে খুব ভঙ্গুর দেশগুলোকে এ ধরনের সহায়তা দেয়া হয়। বাংলাদেশ অর্থনীতির নানা সূচকে অগ্রগতি অর্জন করায় বিগত কয়েক বছর খাদ্য সহায়তা বাবদ কোনো ঋণ বা অনুদান পাচ্ছে না। আর অর্থনীতির সূচকে অগ্রগতি হওয়ার দরুন বিদেশি ঋণের সুদের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা সরকারের বাজেট ব্যবস্থাপনায় চাপ বাড়াচ্ছে।

ইআরডির প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দেখা যায়, অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ঋণ ছাড়ের পরিমাণ কিছুটা বৃদ্ধি পেলেও অনুদান হ্রাস পেয়েছে। এ বিষয়টিকেও স্বাভাবিক বলছেন সংশ্লিষ্টরা। কেননা অর্থনৈতিক অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে যে কোনো দেশে অনুদানের প্রবাহ হ্রাস পেতে থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সেটাই হচ্ছে। গত অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে দেশে আসা বৈদেশিক অনুদানের পরিমাণ ছিল ১৮ কোটি ৬৮ লাখ ৬০ হাজার ডলার, যা এবার হ্রাস পেয়ে হয়েছে ১৭ কোটি ৪৩ লাখ ৬০ হাজার ডলার। অন্যদিকে গত অর্থবছরের সাত মাসে ছাড় হওয়া ঋণের পরিমাণ ছিল ৪০৪ কোটি ৭৬ লাখ ২০ হাজার ডলার। এবার সেটি বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৪২১ কোটি ৩৬ লাখ ২০ হাজার ডলার।

এদিকে চলতি অর্থবছরে নতুন ঋণ ও অনুদানের প্রতিশ্রুতি প্রায় চারগুণ বেড়েছে। একই সঙ্গে অনুদানের প্রতিশ্রুতিও বেড়েছে। অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে বিভিন্ন প্রকল্পে নতুন বিদেশি ঋণের প্রতিশ্রুতি এসেছে ৬৭৪ কোটি ডলারের সমান। গত অর্থবছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ১৫৩ কোটি ৪৩ লাখ ৬০ হাজার ডলার। অন্যদিকে এবার অনুদানের প্রতিশ্রুতি এসেছে ৪৩ কোটি ২১ লাখ ৩০ হাজার ডলারের সমান, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ২৩ কোটি ১৪ লাখ ১০ হাজার ডলারের সমান।

sharebiz