শেয়ারবাজারে হঠাৎ করেই ন্যাশনাল ব্যাংকের শেয়ারের লেনদেন বেড়ে গেছে। দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ব্লক মার্কেটে গত দুই দিনে ব্যাংকটির বিপুল শেয়ারের হাতবদল হয়েছে। পাশাপাশি সাধারণ বাজারেও ব্যাংকটির শেয়ারের লেনদেন বেড়েছে।
ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, গত সোমবার ব্লক মার্কেটে ন্যাশনাল ব্যাংকের ১২ কোটি ২৫ লাখ ২০ হাজারের বেশি শেয়ারের হাতবদল হয়েছে; যার বাজারমূল্য ছিল প্রায় ৮৩ কোটি টাকা। আর গতকাল মঙ্গলবার একই মার্কেটে হাতবদল হয়েছে ব্যাংকটির ৬ কোটি ৪৫ লাখ শেয়ারের; যার বাজারমূল্য সাড়ে ৪২ কোটি টাকার বেশি। সব মিলিয়ে গত দুই দিনে ব্যাংকটির ১৮ কোটি ৭০ লাখের বেশি শেয়ারের হাতবদল হয়েছে, যার মোট বাজারমূল্য ছিল ১২৫ কোটি টাকার বেশি। এ দুই দিনে ব্যাংকটির মোট শেয়ারের মধ্যে প্রায় ৬ শতাংশ শেয়ারের হাতবদল হয়েছে ব্লক মার্কেটে।
শেয়ারবাজারে ব্লক মার্কেট ও সাধারণ বাজারের মধ্যে বড় পার্থক্য হচ্ছে, সাধারণ বাজারে ক্রেতা-বিক্রেতা ও শেয়ারের দাম বাজারের চাহিদা ও জোগানের ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। আর ব্লক মার্কেটে ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ই থাকে পূর্বপরিচিত এবং শেয়ারের দামও আগেই ঠিক করা থাকে। শুধু ব্লক মার্কেটে লেনদেনের মাধ্যমে শেয়ার হাতবদলের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হয়।
গত রোববার ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাতে ব্যাংকটির মালিকানায় থাকা সিকদার পরিবারের সদস্য ও তাঁদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পরিচালকদের বাদ দেওয়া হয়। ব্যাংকটির নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় চট্টগ্রামভিত্তিক কেডিএস গ্রুপের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমানকে। এ ছাড়া বেশ কয়েকজনকে মনোনীত ও স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়; যাঁদের বেশির ভাগই চট্টগ্রামভিত্তিক একটি গ্রুপের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত।
রোববার পরিচালনা পর্ষদের এই বদলের পর সোমবার ও গতকাল ব্লক মার্কেটে বিপুল পরিমাণ শেয়ারের হাতবদল হয়েছে। ডিএসই সূত্রে জানা গেছে, ব্লক মার্কেটে গত দুই দিনে হাতবদল হওয়া শেয়ারের বড় অংশই কেনা হয়েছে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নামে। তার মধ্যে রয়েছে ইস্ট কোস্ট গ্রুপ, গ্রিন স্কয়ার ও মার্চেন্ট অটো নামের প্রতিষ্ঠান। ব্লক মার্কেটে এসব শেয়ার হাতবদল হয়েছে একটি ব্রোকারেজ হাউসের মাধ্যমে। এই ব্রোকারেজ হাউসটির মালিকানার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেডের (এসআইবিএল) সাবেক এক পরিচালক। যিনি একসময় এসআইবিএলের মালিকানা বদলের সময়ও শেয়ার কেনাবেচায় ভূমিকা রেখেছিলেন। এসআইবিএলের মালিকানায় যুক্ত চট্টগ্রামভিত্তিক গ্রুপটির সঙ্গে রয়েছে তাঁর ঘনিষ্ঠতা। বর্তমানে ন্যাশনাল ব্যাংকের বড় অঙ্কের শেয়ারও হাতবদলের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন তিনি।
নতুন করে ন্যাশনাল ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠনের পর ব্যাংকটির মালিকানায়ও বদল আসছে বলে জোর গুঞ্জন রয়েছে ব্যাংক পাড়ায়। ইসলামী ব্যাংক, এসআইবিএলসহ বেসরকারি খাতের একাধিক ব্যাংকের মালিকানায় থাকা চট্টগ্রামভিত্তিক গ্রুপটি বেনামে ন্যাশনাল ব্যাংকের মালিকানায় যুক্ত হচ্ছে বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে। পুনর্গঠিত পর্ষদে এ গ্রুপ সংশ্লিষ্ট একাধিক ব্যক্তিকে পরিচালক নিয়োগ করায় বিষয়টি সামনে এসেছে। যদিও সোমবার পুনর্গঠিত পর্ষদের পক্ষ থেকে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে দাবি করা হয়, ন্যাশনাল ব্যাংক দখল হয়নি।
এদিকে ব্লক মার্কেটের বাইরে গতকাল সাধারণ বাজারেও ন্যাশনাল ব্যাংকের প্রায় ১৭ লাখ শেয়ারের হাতবদল হয়েছে। আর এদিন ডিএসইতে ব্যাংকটির শেয়ারের দাম ৫০ পয়সা বা প্রায় ৮ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭ টাকায়। সাত দিন ধরেই শেয়ারবাজারে ব্যাংকটির শেয়ারের দাম একটানা বাড়ছে। এই সাত দিনে ব্যাংকটির প্রতিটি শেয়ারের দাম দেড় টাকা বা ২৭ শতাংশের বেশি বেড়েছে। অথচ গত মাসে ব্যাংকটির একীভূত হওয়ার খবর জানাজানি হওয়ার পর থেকে একটানা এটির শেয়ারের দরপতন হয়েছিল।
ঈদের ছুটির আগে গত ৯ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংক বেসরকারি খাতের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক বা ইউসিবির শীর্ষ কয়েকজন ব্যক্তিকে ডেকে নিয়ে ন্যাশনাল ব্যাংক একীভূত করার নির্দেশ দিয়েছিল। ইউসিবি ব্যাংকের সঙ্গে ন্যাশনাল ব্যাংককে একীভূত করার এ খবরে ঈদের ছুটির পর ১৫ এপ্রিল থেকে শেয়ারবাজারে ন্যাশনাল ব্যাংকের শেয়ারের দাম কমতে শুরু করে। ১৫ থেকে ২৪ এপ্রিল পর্যন্ত টানা পতনে ব্যাংকটির শেয়ারের বাজারমূল্য ৭ টাকা থেকে কমে সাড়ে ৫ টাকায় নেমে আসে। এর মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকের পর্ষদ থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, আপাতত তারা অন্য কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হবে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউটের (আইবিএ) সাবেক অধ্যাপক সৈয়দ ফরহাত আনোয়ারের নেতৃত্ব গঠিত ন্যাশনাল ব্যাংকের আগের পর্ষদ একীভূত না হওয়ার বিষয়ে অবস্থান নেয়। এর পর থেকে শেয়ারবাজারে ব্যাংকটির শেয়ারের দাম বাড়তে শুরু করে।
এর মধ্যে সৈয়দ ফরহাত আনোয়ারের নেতৃত্বে গঠিত ব্যাংকটির পর্ষদ ভেঙে রোববার নতুন পর্ষদ গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন পর্ষদের পক্ষ থেকেও সোমবার সংবাদ সম্মেলন করে আপাতত অন্য কোনো ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত না হওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়। এ খবরে গতকাল লেনদেনের শুরুতে ব্যাংকটির শেয়ারের সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ বা ৬০ পয়সা মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে ৭ টাকা ১০ পয়সায় উঠে যায়। যদিও দিন শেষে দাম কিছুটা কমে দাঁড়ায় ৭ টাকায়। এক মাসের মধ্যে এটিই ন্যাশনাল ব্যাংকের শেয়ারের সর্বোচ্চ বাজারমূল্য।
prothom alo