- মইনুল হোসেন
- ১১ নভেম্বর ২০২১
কোনো অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তি বিচারে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত আইনত তাকে নির্দোষ ধরে নিতে হবে। মৌলিক অধিকার হিসেবে এখনো আমাদের ব্যক্তিস্বাধীনতা রয়েছে। কোনো ফৌজদারি মামলায় কাউকে গ্রেফতার করা হলে তার বিরুদ্ধে বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষ্য-প্রমাণ না থাকলে তাকে কারাভোগে বাধ্য করাটা আইনের দৃষ্টিতে একেবারেই স্বীকার করে নিতে পারি না। এফআইআর অপরাধের কথা জানাবে। সেটি অপরাধের সাক্ষ্য-প্রমাণ নয়। এমনকি চার্জশিটও অপরাধের প্রমাণ হয় না। তবুও পুলিশ তদন্তসাপেক্ষে প্রদান করার কারণে এর একটা বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। কিন্তু তার পরও চার্জশিটের আলোকে সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করে অভিযোগের সত্যতা প্রমাণ করতে হয়।
শাসনতন্ত্র প্রদত্ত ব্যক্তিস্বাধীনতা কারো বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করে কিভাবে হরণ করা যেতে পারে তা বোধগম্য নয়। এ জন্যই আমি আগেও বলেছি, পুলিশের বক্তব্যের ভিত্তিতে কাউকে জেলে আটক রাখা মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। অপরাধ দমনের কাজ শুধু জেলে পাঠানোর বিষয় নয়। কোর্টের ক্ষমতার অপব্যবহার করা হচ্ছে। মানবাধিকারগুলো অগ্রাহ্য করে ব্যক্তিবিশেষকে পুলিশের কাছে সম্পূর্ণভাবে সমর্পণ করা হচ্ছে। অন্যান্য দেশেও কম-বেশি জামিন আইনের অপব্যবহার হচ্ছে। আমাদের পুলিশ সরকারদলীয় রাজনীতির অংশ হওয়ায় পুলিশের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। অথচ পুলিশকে দেখার কথা ‘জনগণের বন্ধু’ হিসেবে।
আসামি জামিনে মুক্তি পেলে সাক্ষ্য-প্রমাণ প্রভাবিত করতে পারে; এই বিবেচনায়, অতীতে জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করা হতো। সেই যুক্তি আর ব্যবহার করা হয় না। এখনকার প্রধান বিবেচ্য বিষয় হলো, আসামি যদি সামাজিকভাবে বিপজ্জনক না হয়, তাহলে বিচার চলা অবস্থায় তার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। বিচার ও সাজা দেয়ার ক্ষেত্রে আসামির উপস্থিতিও অপরিহার্য নয়; কারণ আমাদের আইন রয়েছে আসামির অবর্তমানে সাজা দেয়ার। তবুও জামিন পাওয়ার বিষয়টি প্রায় অসম্ভব।
এফআইআরের ভিত্তিতে একজন লোককে সহজে জেলে ঢুকানো যাচ্ছে বলে ক্রিমিনাল কেসের সংখ্যা স্ফীত হচ্ছে। কোর্টকে পুলিশ বাদী কেসের অতিরিক্ত বোঝা বহন করতে হচ্ছে এবং গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিরা জামিনের জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠছে। অথচ বেশির ভাগ মামলা গুরুতর অপরাধসংক্রান্ত নয়।
হঠাৎ ব্যাংকগুলো ঋণের টাকা আদায় করার ব্যাপারে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। অনেক শিল্প রয়েছে যা বিক্রি করা হবে শুধু জমির জন্য, শিল্পের জন্য নয়। কিন্তু সরকার সে ব্যাপারে উদাসীন। অনেক শিল্প বন্ধ হয়ে যাবে এবং বেকার সমস্যাকে প্রকট করে তুলবে। আবার কিছু কারখানা যোগসাজশে স্বল্পতম দামে নিলামে বিক্রি করে অন্যদের লাভবান করবে এবং ব্যাংক বাকি টাকা আদায়ের জন্য মামলা করবে। এ কাজের শক্তিশালী চক্র কোর্টের আশপাশে বসে থাকে। দেখা যাচ্ছে, ব্যাংকগুলো লুটেরাদের চুরির টাকা উপভোগ করার সুযোগ দিয়েছে কিন্তু আর্থিক সঙ্কট থেকে এখন শিল্প বাঁচানোর কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না, যদিও সমগ্র পৃথিবীতেই খাঁটি আর্থিক সঙ্কট বিরাজ করছে।
যেসব শিল্প-কারখানা প্রলয়ঙ্করী করোনা মহামারীর কারণে বিপাকে পড়েছে, সেগুলো যাতে টিকে থাকতে পারে তার জন্য সরকারি সহযোগিতার দরকার। ধনী দেশগুলো তাদের শিল্প-কারখানা রক্ষার বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছে। এখানে সে রকম কোনো চিন্তাভাবনা দেখছি না। মামলা দিয়ে জেলে আটক রাখাকে বিরাট সাফল্য মনে করা হচ্ছে। ঋণ যে আদায় হচ্ছে না, ব্যবসা ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, সেটি বিবেচ্য বিষয় নয়। অন্য উপায় খুঁজে না পেয়ে ব্যবসায়ীরা কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন কিস্তিতে পাওনা পরিশোধের আর্জি নিয়ে। ব্যাংকগুলোও এ কাজ করতে পারে। কিন্তু তারা অনিচ্ছুক। তবে ঋণগ্রহীতা প্রভাবশালী হলে ভিন্ন কথা। বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা, সফল উদ্যোক্তা তৈরি করার ব্যাপারে ব্যাংকের কোনো চিন্তাভাবনা আছে বলে মনে হয় না, – এ কথা বলার জন্য আমি দুঃখিত। বিদেশে কর্মরত শ্রমিকরাই দেশের অর্থনীতিকে চালু রাখছেন। আইনকানুনের নিশ্চয়তা না থাকলে, সব কিছু দুর্নীতিবাজ আর ক্ষমতাসীনদের খেয়ালখুশির ব্যাপার হলে, দেশী বা বিদেশী বিনিয়োগ উৎসাহ পায় না। বাংলাদেশে তাই বিনিয়োগের নামে চলছে ‘ব্যাংক লুটপাটের প্রতিযোগিতা’।
যদিও জামিন না পাওয়া ব্যক্তিস্বাধীনতার মৌলিক অধিকারের বিরোধী, তবুও জামিন পাওয়া কঠিন করে তোলা হয়েছে। অপরাধ প্রমাণের ঝামেলা ছাড়াই সহজে জেলে রাখা যাচ্ছে। জামিন পাওয়ার জন্য উচ্চ আদালতে ভিড় লেগে আছে, যা আগে কখনো দেখা যায়নি।
কোথাও অপরাধ সংঘটিত হলে এফআইআর যে প্রাথমিক তথ্য, এ কথা সবার জানা। এর কোনো প্রামাণিক মূল্য নেই। অথচ জামিন লাভের জন্য এফআইআর-ই সর্বোচ্চ বাধা।
আইনের ভাষ্য হচ্ছে, কোর্টের বিচারে অপরাধী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে অপরাধী বলা যাবে না। যতই কাটাছেঁড়া করা হোক, এখনো আমাদের একটি শাসনতন্ত্র রয়েছে এবং সেই শাসনতন্ত্রে মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। এফআইআরের কারণে সবকিছু উদ্দেশ্যহীন ও অর্থহীন হতে পারে না।
কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার করার পর তাকে কোর্টে হাজির করতে হয় কোর্টের হেফাজতে রাখার জন্য। তখন বিবেচনার বিষয় হয়, গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিকে নিয়ে কী করা হবে? তাকে জেলে পাঠানো হবে, না জামিন দেয়া হবে, বিচারের সময় আদালতে উপস্থিত থাকার শর্তে। উদ্দেশ্য, বিচারকালীন তার উপস্থিতি নিশ্চিত করা। কিন্তু এফআইআর স্তরে এটি রেওয়াজ হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে এই বিশ্বাস সঞ্চার করতে হবে যে, তাকে অপরাধী প্রমাণ করার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
পথটি একমুখী হওয়ায় এটি বিশ্বাস করানো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে যে, এফআইআর তথ্যটা সত্য নয়। সুতরাং এফআইআরে বর্ণিত অভিযোগের ভিত্তিতে জামিন থেকে বঞ্চিত হবে। আর একটি কারণ, পুলিশ যখন ধরেছে তখন কিছু দিন জেল খাটুক। তবুও আশার কথা জামিন দেয়ার ব্যাপারে হাইকোর্ট-সুপ্রিম কোর্ট কিছুটা সদয় না হলে বিচারের নামে অনেককে অর্ধেক জীবনই জেলে কাটাতে হতো। অভিযোগ যতই মারাত্মক হোক না কেন, গ্রেফতার ব্যক্তিই যে বর্ণিত অপরাধ করেছেন সেটি তো তার প্রমাণ নয়।
কোর্টে হাজির না হয়ে বিচার এবং সাজা এড়ানো অভিযুক্ত ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। তার অনুপস্থিতিতে বিচার চলবে এবং সাজাও হবে। এটি আইনেরই বিধান। তবুও মানুষকে জেলে রাখার উৎসাহের সীমা নেই। তথাপি এফআইআরভিত্তিক অভিযোগের বিরাট বোঝা ঝুলে থাকছে, অভিযুক্তরা জামিন পাচ্ছে না। আমাদের রাষ্ট্রের পুলিশ এতটা বিশ্বাসযোগ্য থাকতে পারছে তাও তো বিবেচনায় থাকা উচিত। আসলে সবাইকে ভয়ের মধ্যে থাকতে হচ্ছে না। সে জন্য সবই সম্ভব হচ্ছে।
আমাদের দেশে পুলিশ বাদি হয়ে মামলা দেয়া খুব সহজ। সে কারণে হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষ বছরের পর বছর না হলেও মাসের পর মাস জেল খাটছে। পুলিশের তথ্যের ভিত্তিতে যদি জামিন নামঞ্জুর হয়ে যায়, তা হলে মিথ্যা মামলা দায়ের করার ব্যবসা জমে ওঠাই স্বাভাবিক। আমাদের কোর্টগুলোও সে কথা জানেন, কিন্তু তারাও অসহায়।
হাইকোর্ট কাউকে জামিন দিতে চাইলে দু’জন বিচারককে একমত পোষণ করতে হয়। কোর্টের সুরক্ষা দেয়ার জন্য যখন কোনো আসামিকে কোর্টে হাজির করা হয় তখন তাকে কোর্টের হেফাজতে রাখাই যুক্তিসঙ্গত হওয়া বাঞ্ছনীয়। জুডিশিয়াল কাস্টডি অগ্রাধিকার পাওয়ার দাবি রাখে। জামিন অর্থ মুক্তি নয়। তাকে বিভিন্ন শর্ত মেনে চলতে হয়।
সরকারি আইনজীবীদের প্রত্যাশা হচ্ছে, যাকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তাকে কারাগারে থাকতেই হবে। বিচারপ্রক্রিয়া শেষ হওয়ার জন্য তারা অপেক্ষা করতে নারাজ। কাজেই বিচার বিলম্বিত হবেই। এটিই হচ্ছে পুলিশি বিচারব্যবস্থা। দীর্ঘকাল ধরে আমরা এ ধারণা পোষণ করে আসছি যে, গ্রেফতারের গন্তব্য কারাগার। সামাজিক পরিস্থিতি যদি গুরুত্ব না পায়, তা হলে সুবিচার মিলবে না। বিনা জামিনে জেলে আটক রাখায় এই গরিব দেশটিতে কত পরিবার যে রাস্তায় নামবে, তা বুঝতে তো কারো অসুবিধার কথা নয়। সবাই মিলে একটি নিষ্ঠুর জাতি গড়ে তুলছে। অপরাধ বেড়েই চলছে।
আইনের সুরক্ষা দেয়ার জন্য তারা জনগণের স্বাধীন পুলিশ নয়। আমাদের দেশে সত্যিকার অর্থে আইন গর্দভের সাথে তুলনীয়।
সবাই জানে, শক্তিশালী লোকেরা মাদক ব্যবসার সাথে জড়িত। বিনা বিচারে জেল খাটছে বেকার যুবকরা, দারিদ্র্যের কারণে যারা প্রতারণার শিকার হয়েছে। হাজার হাজার সন্দেহমূলক মাদক মামলায় এসব তরুণের জামিন শুনানিতে কোর্টের সময় চলে যাচ্ছে। কিন্তু যদি মাদক কারবারের সাথে জড়িত চেনাজানা প্রভাবশালী লোককে গ্রেফতার করে জেলে পাঠানো হতো, তা হলে মাদক মামলা বিস্ময়করভাবে হ্রাস পেত। দারিদ্র্যের কারণে ছোটখাটো যারা মাদক বহন করে বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দিয়ে জীবন-জীবিকা চালাচ্ছে তারা বিপদে পড়ত না। এ প্রসঙ্গে এটি বিবেচনায় নিতে হবে, কেন সরকার তরুণদের জন্য নিরাপদ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছে না? এর সাথে এই প্রশ্নও মাথায় রাখতে হবে; পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো অপরাধ প্রতিরোধে কী করছে? আমাদের শ্রমিকদের কষ্টার্জিত বৈদেশিক অর্থ পেয়েই সরকার ভালো আছে। তারা পরম আনন্দে আছেন।
অপরাধ বেড়ে চলেছে। লোভনীয় মাদক ব্যবসা চলবে, সমাজ চরম মূল্য দেবে, সরকার এ ব্যবসা বন্ধ করতে ব্যর্থ হবে আর এফআইআরের ভিত্তিতে কোর্ট কেস দিয়ে তরুণদের কারাগারে রাখবেন। জেলে থাকা কোনো তামাশা নয়। জামিনের আবেদন নামঞ্জুর করাটা অপরাধ প্রতিরোধ করা নয়। পুলিশি ব্যবস্থার কোথাও ত্রুটি রয়েছে। যেখানে রাঘব বোয়াল অপরাধীদের রক্ষার কাজে পুলিশ ব্যবহৃত হচ্ছে, সেখানে ড্রাগলর্ড ছাড়া অনেককেই গ্রেফতার করা সহজ। ড্রাগ সমস্যা কিন্তু ড্রাগ বহনকারী বেকার তরুণরা সৃষ্টি করছে না।
বিচারিক প্রক্রিয়ার দ্বিতীয় ধাপ শুরু হবে দীর্ঘকাল পর, যখন কোর্ট সাক্ষীদের কথা শুনবেন। তখনই প্রসিকিউশনের দায়িত্ব পালন শুরু হবে। এ পর্যায়ে প্রমাণ করতে হবে, অভিযুক্ত ব্যক্তি দোষী। তখন প্রসিকিউশন তার কর্মদক্ষতা দেখাতে গিয়ে অন্ধকার দেখতে পাবেন। জামিন না দিয়ে জেলে রাখা কত সহজ। দীর্ঘ ব্যবধানে অনেক সাক্ষীকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। অনেককে হাজির করানো সম্ভব হবে না। সুতরাং সাজা দেয়া কঠিন হবে, এই প্রক্রিয়ায় দু’ভাবে অভিযুক্ত ব্যক্তি সাজা ভোগ করে থাকে। প্রথমত, এফআইআরের ভিত্তিতে জেলে রেখে জামিন দিতে অস্বীকার করে। দ্বিতীয়ত, বিচারে দোষী প্রমাণিত হলে।
অপরাধ মোকাবেলা করার কোনো সহজ পথ নেই। জামিন নামঞ্জুর করে অপরাধ কমানো যায়, তথ্য দিয়ে তা প্রমাণ করা যায় না।
দুর্নীতি আর অপরাধ বিস্তার লাভ করতে সরকারের প্রয়োজন হয় না।
আমাদের অপরাধ বিচার করার ব্যবস্থাটাকে মানবিক করে তুলতে পারেন বিচারপতিরা এবং সেটিই শেষ আশা। ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি আর সুবিচার একসাথে চলতে পারে না। বিচারব্যবস্থার অসহায়ত্বের ব্যাপারে জনগণ দারুণ হতাশার মধ্যে আছে। বিচারব্যবস্থাকে নিজস্ব স্বাধীন নিয়মে চলতে দিলেই সুশাসন সম্ভব হবে। তা না হলে সরকারকে নিজেদের নিরাপত্তা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হবে। জনগণকে ভয় করে চলতে হবে। জনগণকে বিপদে রাখা নিরাপদ ব্যবস্থা নয়।
লেখক : সিনিয়র আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট