- মইনুল হোসেন ০৯ মার্চ ২০২০
প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এবং তার মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যরা জনসমক্ষে বিবৃতি দিয়ে দাবি করে চলেছেন যে, দুর্নীতিবিরোধী যে অভিযান চলছে তাতে কাউকে ছাড় দেয়া হবে না; কিন্তু বাস্তবে শাসকদলের একজন সাবেক এমপি ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে আনীত তিনটি দুর্নীতির মামলায় জামিন মঞ্জুর না করায় একজন সিনিয়র জজকে সাথে সাথে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেয়া হলো। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে অপর একজন জজকে দায়িত্ব দিয়ে তাদের জামিনের ব্যবস্থা করা হলো। আইনমন্ত্রীকে তার ক্ষমতার দাপট দেখাতে লজ্জা পেতে হলো না।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ, আইনমন্ত্রী পিরোজপুরের সেশন জজকে অপসারণ করেই খান্ত হলেন না; তাকে হেয় করার জন্য নিজের মন্ত্রণালয়ের অধীনে এনে ওএসডি করলেন। এর মাধ্যমে সবাইকে এই বার্তাই দেয়া হয়েছে যে, জজদের মান-মর্যাদার দিকে লক্ষ না রেখেই তাদের শাস্তি দেয়া কত সহজ।
আমার নিজ জেলা পিরোজপুরের সাবেক আওয়ামী লীগের এমপির সাথে আমার ব্যক্তিগত আগেকার ভালো সম্পর্ক এখনো আছে বলে মনে করি। তার বিরুদ্ধে দেখানো দুর্নীতির মামলা আমার আলোচনার বিষয় নয়। আমি তো এ কথাই বলে এসেছি যে, কোর্টে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত কাউকে অপরাধী বলা যাবে না। এটাই আইন ও সুবিচারের কথা। তাকে জামিনে মুক্তি দিতে বাধা হবে কেন? দুর্নীতিসহ যেকোনো মামলায় জামিন দিতে সরকারই শক্তভাবে বাধা দিয়ে থাকে।
আইনের শাসনে বিশ্বাস করি বলেই বলছি, কাউকে জামিন দেয়া-না-দেয়ার বিষয়টি সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন হওয়া সভ্য সমাজের কথা নয়। জামিন না পাওয়ার বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ রয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়ের অধৈর্য হওয়ার তো কিছু ছিল না। সরকার এবং দুর্নীতি দমন কমিশন উভয়ে মিলেই দুর্নীতির মামলায় জামিন দেয়াকে রীতিমতো অন্যায় বলে মনে করে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবীরা দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্তদের পেছনে এমন ক্ষিপ্রতা নিয়ে লেগে থাকেন যে, অভিযুক্তরা অপরাধী, তারা ঘৃণার পাত্র এবং তাদের জামিন দেয়া দেশের স্বার্থবিরোধী। দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগেই তাদের বিরুদ্ধে অপমানজনক বক্তব্য রাখতে এতটুকু বাধে না। কোর্টও তাদের কাছে অসহায় বোধ করেন।
আমি তো জামিনের পক্ষেই বক্তব্য রেখে যাচ্ছি। একজন অভিযুক্তকে জামিনে মুক্ত থাকতে দেয়া বাঞ্ছনীয়, যাতে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে তার কোনো অসুবিধা না হয়। তা ছাড়া অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জেলে পুরে রাখাটা আত্মসাৎকৃত অর্থসম্পদ উদ্ধারে সহায়ক হওয়ার তো কোনো কারণ দেখি না। তাকে জেলে আবদ্ধ না রেখেও তার অবৈধ অর্থ-সম্পদ আদায়ের ব্যবস্থা নেয়া যায়। তার পাসপোর্ট জব্দ করা যায়।
কিন্তু জামিন না দিলে পুলিশি বিচারে অভিযুক্তকে জেলে বন্দী জীবন কাটাতে হয়। কোর্টের বিচারে সে দোষী হবে কি না সেটি কোনো চিন্তার বিষয় নয়। জামিন না পেয়ে দুর্নীতির মামলায় বহু লোককে জেল খাটতে হচ্ছে; কিন্তু দুর্নীতির বিস্তার তো ঘটেই চলছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের সাফল্য কি শুধু মামলা দায়ের করা? দোষ প্রমাণের দায়িত্ব যেন তাদের ওপর বর্তায় না।
আইনের শাসন যারা বোঝেন না তাদের কাছে আইনের অপব্যবহারই আইনের শাসন। আদালতের জামিন দেয়ার ক্ষমতা প্রয়োগ হবে সরকারি নির্দেশে। পুলিশি বিচার চালু রাখার আইনের শাসন চলছে। জেলে বন্দী রাখতে পারলেই হলো। দোষ প্রমাণের জন্য কোর্ট-আদালতে বিচারের প্রয়োজন নেই।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রেস কনফারেন্স করে বলেছেন, কোর্টের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য সেশন জজকে তড়িঘড়ি করে দায়িত্ব পালন থেকে নিবৃত্ত রাখতে হয়েছে। সবাইকে বোকা না ভাবলেই তিনি বুদ্ধিমান প্রমাণিত হতেন। প্রথমত, কোর্টে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে তার তো মন্ত্রিত্বই থাকার কথা নয়। জামিন না দেয়ার জন্য বিশৃঙ্খলা তো সরকারদলীয় লোকেরাই করেছেন। তাদের বুঝানো সরকারের জন্য সহজ ছিল। আদালতের পরিবেশ রক্ষা করতে না পারার ব্যর্থতার জন্য জজকে শাস্তি পেতে হবে কেন? মেনে নিলাম আইনশৃঙ্খলা রক্ষার স্বার্থে সেশন জজকে বিদায় দিতে হয়েছে। কিন্তু তার জামিন নাকচের আদেশ বাতিল করার ব্যবস্থা নিলেন কোন যুক্তিতে, তা তো বুঝলাম না। জামিন প্রত্যাখ্যানের বিরুদ্ধে আপিলের ব্যবস্থা ছিল। দুুর্নীতির মামলায় জামিনের বিরোধিতা দুর্নীতি দমন কমিশন ও সরকার একত্রেই করে থাকে।
জামিনের বিরুদ্ধে কোনো আইন নেই। বিচারকদের ডিসক্রেশনের ব্যাপার। কিন্তু সরকারবিরোধীদের জামিন না দেয়াটাই সরকারি আইন হয়ে গেছে।
আলোচ্য সেশন জজকে উপেক্ষা করার প্রতিবাদে সুপ্রিম কোর্টের ক্ষুব্ধ আইনজীবীরা গত বুধবার তাদের পক্ষ থেকে বিষয়টির প্রতি হাইকোর্ট বিভাগের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বিচার চাইতে থাকেন। হাইকোর্ট ডিভিশনের বিচারপতি তারিক উল হাকিম ও বিচারপতি মোহাম্মদ ইকবাল কবিরের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ আলোচ্য জজকে কর্মরত অবস্থা থেকে অব্যাহতি দেয়ার কারণ জানতে চেয়ে আইন সচিব ও উপ-আইন সচিবের ওপর রুলনিশি জারি করেন। জানা যায়, উপ-আইন সচিব আইনমন্ত্রীর নির্দেশে তার পক্ষে স্বাক্ষর করেন। রুলে বলা হয়েছে দুই সপ্তাহের মধ্যে জবাব দিতে।
অন্যথায় ক্ষুব্ধ আইনজীবীরা কী করতেন তা যে কেউ অনুমান করতে পারেন। আইনমন্ত্রী দাবি করেছেন সুপ্রিম কোর্টের মতামত নিয়েই তিনি পিরোজপুরের সেশন জজের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্ট আদালত অবমাননার জঘন্য কার্যক্রমকে সমর্থন জানাতে পারে তা কেউ বিশ্বাস করছেন না। তা ছাড়া আদালত অবমাননার বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টকে জড়ানোও অন্যায়। শুনানির সময় কোর্টে সঠিক তথ্য প্রকাশ পাবে বলে সবাই আশা করছেন। তবে যেভাবে মিথ্যার রাজত্ব চলছে তাতে সবাই যে আশস্ত হতে পারছেন এমন নয়। তবুও হাইকোর্ট বিভাগ আইন মন্ত্রণালয়কে কারণ দর্শানোর নোটিশ জারি করে সুপ্রিম কোর্টের ভূমিকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।
বিচারকদের মর্যাদা রক্ষার ব্যাপারটি সুপ্রিম কোর্টের কাছে গুরুত্ব না পেলে আইনের প্রতিও কারো শ্রদ্ধা থাকে না। আইনের অপপ্রয়োগে সরকার বেশ অভ্যস্ত। আইন মন্ত্রণালয় এটাও জানে যে, নিম্ন আদালতের ওপর তাদের কর্তৃত্ব কত সহজে মেনে নেয়া হয়। আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, নিম্ন আদালতের কোনো কোনো জজ জামিনের প্রশ্নে ক্ষেত্রবিশেষে আইনমন্ত্রীর নির্দেশের অপেক্ষায় থাকেন।
এক দিকে জামিন না দিতে সরকার জোর আপত্তি করবে, অন্য দিকে নিজেদের লোকদের ব্যাপারে জামিন প্রত্যাখ্যান করলে বিচারককে অপদস্থ করা হবে। ভয়ভীতির শিকার হয়ে আমরা তো সবই হারাতে বসেছি।
কর্মরত একজন জজকে কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে অব্যাহতি দিয়ে অপর একজন জজকে দিয়ে তার জামিন প্রত্যাখ্যানের আদেশ পরিবর্তন করানো কোনো স্বাভাবিক ঘটনা হতে পারে না। আইন মন্ত্রণালয়ের নির্দেশেই অন্য একজন জজকে দায়িত্ব দিয়ে এ কাজটি করা হয়েছে। সেশন জজকে অব্যাহতি দিয়ে জামিনের ব্যাপারে আর কোনো কিছু যদি না করা হতো তাহলে বলা যেত বিশেষ অবস্থার কারণে তাকে সরানো হয়েছে। তার জামিন প্রত্যাখ্যানের নির্দেশ আপিল কোর্টের ওপর ছেড়ে দিলেই হতো।
সবাই জানি, আইনের শাসন ও সুবিচারের বিষয় নিয়ে সরকারকে দুশ্চিন্তা করতে হচ্ছে না। আর এ জন্যই শাসনব্যবস্থায় নৈরাজ্য চলছে। আইনের বাধা কোনো বাধা নয়। যে যেভাবে পারছে নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছে। সাথে সাথে এটাও আমাদের স্বীকার করতে হবে যে, জজ-বিচারকদের নিজেদের দুর্বলতা সরকারকে সাহস জুগিয়েছে। নিজেদের মর্যাদা রক্ষার প্রশ্নে নিজেদের মধ্যেই সাহসের অভাব রয়েছে।
সুপ্রিম কোর্টের সম্মতি ছাড়া কোনো জজ বা ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা আইন মন্ত্রণালয়ের নেই। কোর্ট-আদালতের মর্যাদা ও অধিকার ক্ষুণ্ণ করার মতো কোনো অবমাননাকর কাজে সুপ্রিম কোর্ট সহযোগিতা দিতে পারেন না।
লেখক : সিনিয়র আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট