বিএনপি-জামায়াতের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনে বাধা কোথায়

বিএনপি-জামায়াত

একদফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনে না থাকলেও বিএনপির সঙ্গে মিল রেখে অভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছে জামায়াতে ইসলামী। সরকার পদত্যাগের দাবি আদায়ে আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে ঐক্যবদ্ধভাবে মাঠে নামতে চাইছে এ দুই দল। এ নিয়ে তাদের একাধিকবার বৈঠকও হয়েছে। জামায়াতকে সঙ্গী করতে ইতোমধ্যে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা মিত্রদের দুটি প্রস্তাবও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এক মঞ্চে আন্দোলনে আপত্তি জানিয়েছে গণতন্ত্র মঞ্চ।

এদিকে এ নিয়ে এখনই নেতারা প্রকাশ্যে কোনো কথা বলতে চাইছেন না। বিষয়টি সমাধান করে জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে দ্রুত মাঠে নামতে চান নেতারা। এজন্য বিএনপির এক শীর্ষ নেতাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তবে জামায়াতের সঙ্গে ঐক্য গড়তে আপত্তি নেই অন্যান্য সমমনা দল ও জোটের। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য।

৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। সময় কম, তাই ভোট বর্জন করা রাজনৈতিক দলগুলো তাদের ঐক্য ধরে রেখে রাজপথে আন্দোলন জোরদার করতে মরিয়া। গণতন্ত্র মঞ্চের একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, জামায়াত ইস্যুতে বিএনপির পক্ষ থেকে তাদের দুটি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। যার একটি হলো-জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনরত দলগুলো একমঞ্চে আসবে। বিকল্প আরেকটি-জামায়াতকে যুগপতে এনে অন্যরা এক মঞ্চে থেকে আন্দোলনে নামবে। শুক্রবার গণতন্ত্র মঞ্চের সভায় এ দুই প্রস্তাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। জামায়াতকে নিয়ে এক মঞ্চে আন্দোলনের বিষয়ে একটি দল ছাড়া গণতন্ত্র মঞ্চের বাকি পাঁচ দলই আপত্তি জানায়। সভায় উপস্থিত নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শীর্ষ নেতা জানান, জামায়াতকে নিয়ে এক মঞ্চ থেকে আন্দোলন করা সম্ভব বলে তারা মনে করছেন না। এটি হলে মঞ্চ সেই উদ্যোগে থাকবে না। তাই যুগপতের ওপরই গুরুত্ব দিচ্ছেন। এছাড়া জামায়াতকে নিয়ে বিএনপি যুগপতে থাকলে গণতন্ত্র মঞ্চের ভূমিকা কী হবে?

৩১ দফার ভিত্তিতে তারা এক বছর ধরে যুগপতে আছেন। তাদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে কর্মসূচিতেই থাকতে চান। রাজপথের ঐক্যটাই গুরুত্বপূর্ণ। আন্দোলন এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছেছে, আরেকটু গতি পেলেই সফলতা আসবে। অর্থাৎ চূড়ান্ত পর্যায়ে যদি এ ধরনের ঐক্য রাজপথে গড়ে ওঠে, সে ঐক্য তো হতেই পারে। কিন্তু এ মুহূর্তে সেই ঐক্যের বাস্তবতা নেই বলে তারা মনে করেন। যুগপৎ ধারায় যে আন্দোলন করে এসেছেন, তা জনগণের সমর্থন পেয়েছে, তারা গ্রহণ করেছেন। চলমান আন্দোলনে রাজপথ দখলে নেওয়ার মতো জামায়াতের সে ধরনের কোনো তৎপরতা এখনো দেখা যায়নি। তাই জামায়াত ঐক্যে এলেই যে সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নামবে, তা বিশ্বাস করা কঠিন।

অবশ্য সমমনা অন্যান্য দল ও জোটের নেতারা জানান, সময় বেশি নেই। তাই ভোট ও মাঠের শক্তি হিসাবে জামায়াতের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের এখনই সময়। অতীতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও জামায়াতকে নিয়ে আন্দোলন করেছিল। তাহলে জামায়াতকে নিয়ে বিএনপি আন্দোলন করলে দোষ কোথায়? নির্বাচনের আগ মুহূর্তে হঠাৎ গণতন্ত্র মঞ্চের এমন মনোভাবকে তারা সন্দেহের চোখে দেখছেন। কারণ হিসাবে সমমনা নেতারা বলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগেও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করা হয়েছিল। কিন্তু ওই ফ্রন্ট বিএনপি নেতাদের বিভ্রান্ত করেছিল। বিএনপি চেয়ারপারসনও দলের সিনিয়র নেতাদের বলেছিলেন, ঐক্যফ্রন্ট গঠন করা ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। তারা আশা করেন, দেশের এ ক্রান্তিকালে গণতন্ত্র মঞ্চ সঠিক সিদ্ধান্ত নেবে। কারণ, জনগণ এই আন্দোলনের দিকে তাকিয়ে আছে।

এ নিয়ে জানতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানকে একাধিকবার কল করেও পাওয়া যায়নি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য যুগান্তরকে বলেন, জামায়াতের সঙ্গে আলোচনা শেষ পর্যায়ে। দুদলই ইতিবাচক। সামনে এর প্রতিফলন দেখা যাবে। গণতন্ত্র মঞ্চও তাদের মিত্র। তারাও জনগণের মনোভাব, বাস্তবতা-সবকিছু উপলব্ধি করে জোরালো আন্দোলন চায়। বৃহত্তর স্বার্থে সবাই এক কাতারে আসবে বলে বিশ্বাস তাদের। এর কোনো বিকল্প নেই। যুক্তরাষ্ট্রসহ গণতান্ত্রিক বিশ্বও বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে না, একতরফা নির্বাচনের আয়োজন চলছে। সুতরাং গণতান্ত্রিক বিশ্বও তাদের সঙ্গে আছে।

জানা যায়, শনিবার জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের এক সভায় ‘প্রহসন ও ভাগবাঁটোয়ারার’ নির্বাচন আখ্যা দিয়ে তা বর্জন করে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তাব গৃহীত হয়। এজন্য সর্বশক্তি নিয়ে তারা মাঠে থাকবেন। জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের যুগান্তরকে বলেন, ‘দুদলের আরও কাছাকাছি হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এ নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। যখন হয়ে যাবে, তখন তো বাস্তবে দেখা যাবে।’

যুগপৎ আন্দোলনের শরিক লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপির প্রেসিডেন্ট কর্নেল (অব.) ড. অলি আহমদ যুগান্তরকে বলেন, ‘বর্তমানে যে জামায়াত আছে, তাদের মধ্যে কেউ স্বাধীনতাবিরোধী নেই। আওয়ামী লীগ বারবার জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। ১৯৮৬ সালেও আন্দোলনের সময় জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল। অথচ সেদিন বিএনপি অংশগ্রহণ করেনি, শক্তভাবে আন্দোলন করেছি। একই আওয়ামী লীগ ১৯৯৫ সালে জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে বিএনপির বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছিল। বিষয়টা এরকম-আওয়ামী লীগের যখন প্রয়োজন হয়, জামায়াতকে বিএনপির বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে দ্বিধাবোধ করে না। এখন যে বা যারা সরকারবিরোধী আন্দোলনে আছে, তারা যদি জামায়াতের বিরুদ্ধে কথা বলে, তবে তা জোরালোভাবে সরকারকে সাহায্য করা হবে।’

১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ‘জামায়াতকে নিয়ে আন্দোলনে কোনো আপত্তি নেই। এখন অত্যন্ত কঠিন একটা সময় পার করছি। এ সময়ে আমরা আমাদের নিজস্ব চিন্তাভাবনা বাদ দিয়ে গণতন্ত্র উদ্ধারের লড়াইয়ে নিয়োজিত হওয়া দরকার। অতীতে বিএনপিকে হটানোর জন্য আওয়ামী লীগ ও জামায়াত নেতারা যদি এক মঞ্চে বসতে পারে, তাহলে আমরা এখন বিএনপি, গণতন্ত্র মঞ্চ, ১২ দলীয় জোট, ইসলামী আন্দোলন, জামায়াতে ইসলামী এক মঞ্চে বসতে কোনো অসুবিধা দেখছি না। এ ধরনের উদ্যোগ আমাদের লক্ষ্য আর্জনের জন্য অনেক সহায়ক হবে।’

জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, ‘সরকারকে পতন করার জন্য যারা সক্রিয়ভাবে মাঠে কাজ করবে, তাদেরই শুভেচ্ছা জানাব। জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলনেও কোনো আপত্তি নেই।’

গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, ‘ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফরম করলে আন্দোলনের জন্য ভালো হবে। তবে সেটা করার আগে একটা বিষয় বিশ্লেষণ করতে হবে-আমাদের যে যুগপৎ আন্দোলন চলছে, এর প্রতি আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি কী এবং দেশের মানুষের দুষ্টিভঙ্গি কী। সেখানে যদি বেশির ভাগ মানুষ মনে করে যে, এক প্ল্যাটফরমে আসাটা পজিটিভ, তাহলে করা ভালো। আর যদি আন্তর্জাতিক এবং দেশের নাগরিক সমাজ কিংবা গণমাধ্যম বিভিন্ন ক্ষেত্রে যদি এক প্ল্যাটফরমে আসার জন্য কিছুটা প্রতিবন্ধকতা থাকে, সেটাও বিবেচনা করা দরকার।’

বহুবছর বিএনপির সঙ্গে মিত্র ছিল জামায়াতে ইসলামী। ২০ দলীয় জোট ভাঙার পর জামায়াত এককভাবে পৃথক কর্মসূচি পালন করছে। এর মধ্যে কয়েকটি ইস্যুতে এ দুদলের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়। তবে বেশ কিছুদিন ধরে সরকারের পদত্যাগের একদফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনে না থাকলেও অভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে জামায়াত। দলটির একাধিক নেতা জানান, পনেরো বছর ধরে বিএনপির বহু নেতাকর্মী হত্যা-গুম, হামলা-মামলা ও গ্রেফতারের শিকার হয়েছেন। কিন্তু জামায়াতের নেতাকর্মীরাও কম নির্যাতিত নন। হত্যা-গুম, হামলা-মামলা ও গ্রেফতারের শিকার অনেক নেতাকর্মী। এখন চূড়ান্ত আন্দোলন চলছে। পেছনে না তাকিয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার এখনই সময়।

সূত্রমতে, জামায়াতকে সঙ্গে নিয়ে আন্দোলনের বিষয়ে আপত্তির কথা বিএনপিকে জানিয়েছে গণতন্ত্র মঞ্চ। কিন্তু আন্দোলনের এ চূড়ান্ত পর্যায়ে এ বিষয়ে ‘চুপ’ থাকার কৌশল নিয়েছে সব পক্ষই। গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা জেএসডির

সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন যুগান্তরকে বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী থাকলে আমরা আন্দোলনে আছি, না থাকলে যুগপৎ আন্দোলনে-বিষয়টি এমন না। যুগপৎ আন্দোলন অব্যাহত রাখতে চাই। এই সরকারের বিরুদ্ধে যে শক্তি আমরা সঞ্চয় করেছি, তাতে জনগণ চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করবে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘কোনো বিষয়ে বিএনপির সঙ্গে কোনো দূরত্ব নেই। আমরা অবরোধ থেকে বেরিয়ে এসে বিক্ষোভ মিছিল দিইনি। কখনো যুগপতের কর্মসূচি হুবহু মিলবে, আবার কখনো হয়তো পার্থক্য থাকতে পারে বা নিজস্ব কর্মসূচির মতো করা হতে পারে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ও ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যে লড়াই হচ্ছে, সে জায়গায় আমরা ঐক্যবদ্ধ।’

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘যুগপৎ ও যুগপতের বাইরে যারা আছেন, তারা মনে করি এখন এই পর্যায়ে যারা যে অবস্থানে আছেন, একই লক্ষ্যে আন্দোলনকে আরও জোরদার করা, আরও বিস্তৃত করা দরকার। এর পরবর্তীকালে সব দল মিলে আন্দোলনকে যখন আরও তুঙ্গে নেওয়া হবে, তখন বিরোধী দলগুলোর মধ্যে সমন্বয় কিংবা বোঝাপড়া অথবা আরও কাছাকাছি আসব। তখন নিশ্চয় আমরা উপযুক্ত একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব। এখন আমরা স্ব স্ব জায়গায় যেখানে আছি, সেখানে থেকেই আন্দোলন এগিয়ে নিতে চাই।’

যুগান্তর