বিএনপি অবস্থান না বদলালে রাজনৈতিক অস্থিরতা কাটবে না

মইনুল ইসলাম : বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় বুদ্ধিজীবী প্রফেসর রেহমান সোবহান গত ২ ডিসেম্বর ‘চ্যানেল টোয়েন্টিফোর’কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, দেশে অনেক বেশি রাজনৈতিক দল থাকলেও যেহেতু আওয়ামী লীগ ও বিএনপি দুটি বড় দলের নিরঙ্কুশ প্রাধান্য রয়েছে, তাই ভোটের রাজনীতিতে ‘টু পার্টি সিস্টেম’-এর শিকড় দৃঢ়মূল হতে এ দেশে বেশি সময় লাগবে না। সময়ের পরিক্রমায় ছোট অনেক দল এ দুই দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে রাজনীতি করবে কিংবা রাজনীতির অঙ্গন থেকে হারিয়ে যাবে। বিষয়টি ওইদিকে না যাওয়ায় তিনি ‘আশার আলো দেখছেন না’ বলে হতাশা প্রকাশ করেছেন। প্রফেসর রেহমান সোবহান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে আমার সরাসরি শিক্ষক ছিলেন। তাই স্যারের সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করেও বিষয়টির ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজন অনুভব করছি।

আওয়ামী লীগ এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদানকারী দল। ১৯৪৯ সালে এর জন্মলগ্ন থেকেই তদানীন্তন পূর্ববাংলার জনগণের বিপক্ষে থাকা পাকিস্তান রাষ্ট্রটির ঔপনিবেশিক শোষণ-বঞ্চনা-বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে দলটি। ১৯৫৪ সালে পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসনের সনদ ২১ দফার ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্টের ভূমিধস বিজয়ের পর আওয়ামী লীগ পরিণত হয়েছিল পূর্ববাংলার নিপীড়িত জনমানুষের অধিকার আদায়ে সোচ্চার প্ল্যাটফর্মে (১৯৫৫ সালে পূর্ববাংলাকে পূর্ব পাকিস্তান নামকরণ করেছে পাকিস্তানি শাসকরা)। ১৯৬৩ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর দলটির নেতৃত্বে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৬৬ সালে তাঁর রচিত ছয় দফার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের সংগ্রাম ক্রমশ স্বাধিকার সংগ্রামে পরিণত হয়।

১৯৭০ সালে অনুষ্ঠিত অখণ্ড পাকিস্তানের প্রথম ও একমাত্র অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে একচ্ছত্র বিজয় অর্জনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের একক প্রতিনিধি হিসেবে ম্যান্ডেট লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানের ‘মেজরিটি পার্টি’ হওয়া সত্ত্বেও যখন সামরিক জান্তা সরকার আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা দিতে অস্বীকৃতি জানায়, তখন ১৯৭১ সালের ১ মার্চ কোনো রাখঢাক ছাড়াই ছয় দফার স্বাধিকার সংগ্রাম এক দফার স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপান্তরিত হয়। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। ২৫-২৬ মার্চের মাঝরাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে গণহত্যা শুরুর ক্রান্তিলগ্নে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন, যার ভিত্তিতে ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।

ওপরে বর্ণিত ইতিহাসকে যথাযথ গুরুত্ব দিতে নারাজ দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের অন্যতম বিএনপি। বিএনপি এখনও দাবি করছে, ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার থেকে মেজর জিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। মেজর জিয়ার ২৭ মার্চে দেওয়া ঘোষণাকে ২৬ মার্চে নিয়ে আসার এই জ্ঞানপাপীসুলভ জবরদস্তি বিএনপি আজও পরিত্যাগ করেনি। একটি ইতিহাস বিকৃতি একেবারেই ক্ষমার অযোগ্য। ১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে বলা হয়েছিল, ‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের’ মাধ্যমে জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

১৯৭৯ সালে জিয়ার আমলে গৃহীত সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীতে এই মহাগুরুত্বপূর্ণ বাক্যাংশটি পরিবর্তন করে বলা হয়, ‘জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি।’ এটা ভয়ংকর ইতিহাস বিকৃতি। ‘স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধ’ বললে শুধু একাত্তর সালের ৯ মাসের যুদ্ধ বোঝায়। কিন্তু ‘জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রাম’ বললে একাত্তরের ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধসহ জাতীয় মুক্তির লক্ষ্যে অতীতের সব ঐতিহাসিক আন্দোলন-সংগ্রাম-গণঅভ্যুত্থান-নির্বাচন-অসহযোগ আন্দোলনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

বিএনপির জ্ঞানপাপীদের ভাষ্যমতে, মুক্তিযুদ্ধ নাকি শুরু হয়েছিল জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘোষণার কারণে। ওখানে বঙ্গবন্ধুর কোনো অবদান নেই! বিএনপির দাবি, বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা না দেওয়ায় নাকি জাতি বিভ্রান্তিতে পড়েছিল, যা থেকে জিয়ার ঘোষণা জনগণকে পথ প্রদর্শন করেছে। এই অক্ষম্য ইতিহাস-বিকৃতি এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বকে অস্বীকারের অপপ্রয়াস স্বাধীনতাবিরোধী ছাড়া দেশ-বিদেশে কেউ গ্রহণযোগ্য মনে না করলেও বিএনপি আজও এই ইতিহাস বিকৃতি পরিত্যাগ করেনি। বিএনপি জাতির মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসের উল্লিখিত অধ্যায়গুলোকে যথাযোগ্য মর্যাদায় এখনও পালন করে না। এই ইতিহাস বিকৃতি যদ্দিন বিএনপি পরিত্যাগ না করবে তদ্দিন তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ধারক ও লালনকারী দলগুলোর শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান সম্ভব হবে না।

সবাইকে মনে রাখতে হবে, ১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলের পর ১৯৭৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জিয়াউর রহমান নিজ ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার উদ্দেশ্যে ক্যান্টনমেন্টে বসে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট খন্দকার মোশতাক ও অভ্যুত্থানকারী ঘাতক সামরিক জান্তা স্বাধীন বাংলাদেশে যে পরাজিত পাকিস্তানকে ফিরিয়ে এনেছিল, সেই পাকিস্তানপন্থি রাজনীতির ধারক-বাহক সমরপ্রভু জিয়াউর রহমান বিএনপির জন্ম দিয়েছিলেন এ দেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যাতে আর কোনোদিন রাজনৈতিকভাবে জনপ্রিয় না হয়, সে উদ্দেশ্যেই। তাই জন্মসূত্রেই বিএনপি এ দেশে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকা পালনকারী ‘পাকিস্তান মুসলিম লীগ’-এর বাংলাদেশি উত্তরসূরি। এই ভূমিকা তারা কখনোই পরিত্যাগ করবে না।

বিএনপির মূল রাজনৈতিক আদর্শ পাকিস্তানপ্রেম ও আওয়ামী লীগ-বিরোধিতা। জন্মসূত্রেই আওয়ামী লীগের ‘নেমেসিস’ বিএনপি। বিএনপিতে দেশের বাম ঘরানা ও দক্ষিণপন্থি রাজনীতিকদের কেনাবেচার মাধ্যমে দলে ভেড়ানোর দায়িত্বটি অর্পণ করা হয়েছিল রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে; প্রধানত সশস্ত্র বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআইকে। লাইসেন্স, পারমিট, ব্যাংক ঋণ, প্লট ইত্যাদি সুযোগ-সুবিধা দিয়ে এই অ্যাসাইনমেন্ট সম্পন্ন করেছিল গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। তারা প্রয়োজনে ব্ল্যাকমেইলের আশ্রয়ও নিত। ক্যান্টনমেন্টে বসে রাজনৈতিক দল বানানোর এই খেলা শুরুর আগে ১৯৭৭ সালে জিয়া দেশের রাষ্ট্রপতির আসনও জবরদখল করেছিলেন।

বিএনপির কাছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের কোনো গুরুত্বই নেই। তাঁর ২৬ মার্চের স্বাধীনতা ঘোষণার অস্তিত্বও নেই! জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে ইতিহাসের পাতা থেকে মুছে ফেলার এই চরম ধৃষ্টতা কি বিএনপি নেতাকর্মী এখনও দেখিয়ে যাবেন? ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হতে না চাইলে এই বিশ্বধিকৃত মিথ্যাচার থেকে বিএনপিকে সরে আসতেই হবে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫২তম বছরেও যখন বিএনপি-জামায়াতের পাকিস্তানপ্রেম এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি অটুট থাকতে দেখি, তখন স্বাধীন বাংলাদেশে এই দুটো দলের আদৌ রাজনীতি করার অধিকার থাকতে পারে কিনা– সেই প্রশ্ন জাতির কাছে উপস্থাপন করছি।

কোনো দেশের রাজনৈতিক দলগুলো সে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার কিংবা স্বাধীনতার ইতিহাসকে বিকৃত করে রাজনীতি করার অধিকার পাওয়ার প্রশ্ন অবান্তর। বাংলাদেশেও ইতোমধ্যে সংসদে আইন পাস হয়েছে– স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতি একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু বিএনপি যে আজও এই অক্ষম্য ইতিহাস বিকৃতি চালিয়ে যাচ্ছে, সে ব্যাপারে রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন মহল নিশ্চুপ কেন?

আইনানুগভাবে রাজনীতি করতে হলে বিএনপিকে অবিলম্বে স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসকে মেনে নিতেই হবে। এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের করণীয় হলো, অবিলম্বে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন নিরপেক্ষ বিচার বিভাগীয় কমিশন গঠন করে এ সম্পর্কে বিরোধপূর্ণ বিষয়গুলো ঐকমত্যে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা। স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে কারও অবদানকে খাটো করার অধিকার আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ কোনো মহলেরই থাকতে পারে না।

ক্ষমতায় গেলে যেহেতু দুর্নীতির কারণে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তায় ধস নামে, তখন বিএনপির জনপ্রিয়তায় জোয়ার আসে। এবারও এসেছিল। আওয়ামী লীগকে বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে উৎখাত করতে বদ্ধপরিকর গোষ্ঠীগুলোই এ জোয়ার নিয়ে আসছে। তাদের সবাই স্বাধীনতাবিরোধী না হলেও তারা হিন্দুবিদ্বেষী, ভারতবিদ্বেষী ও পাকিস্তানপ্রেমী। তারা হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে জানপ্রাণ কবুল করতেও রাজি। সে কারণেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ পাকিস্তানকে অর্থনীতির সব ক্ষেত্রে ছাড়িয়ে গেলেও বিএনপিভক্তদের মন গলবে না। ২০০৯-২৩ পর্যায়ে অর্থনৈতিকভাবে শেখ হাসিনার বাংলাদেশ বিএনপি-জামায়াতের ২০০১-০৬ মেয়াদের শাসনামলের তুলনায় চমকপ্রদভাবে এগিয়ে যাওয়া সত্ত্বেও বিএনপির জনপ্রিয়তায় বড়সড় ধস নামেনি। বর্তমানে পাকিস্তান অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়াত্বের প্রান্তে উপনীত হওয়া সত্ত্বেও বিএনপির পাকিপ্রেমীদের প্রেমে ভাটা পড়েনি!

ড. মইনুল ইসলাম: একুশে পদকে ভূষিত অর্থনীতিবিদ