বিএনপির ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা’

by Farhad Mazhar    28 December 2022
বাংলাদেশের রাজনীতির দুর্ভাগ্য হচ্ছে জাতীয় রাজনীতিতে শ্রমিক শ্রেণীর উপস্থিতি যেমন নাই, তেমনি কৃষকও হাজির নাই। জাতীয় রাজনীতিতে হতদরিদ্র সর্বহারা এবং বিভিন্ন মেহনতজীবী জনগণেরও উপস্থিতি নাই। কোন শক্তিশালী নারী আন্দোলনও নাই। এর দ্বারা ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা বিরোধী আন্দোলনের চরিত্র সংকীর্ণ এবং ফ্যাসিস্ট শক্তি ক্ষমতা থেকে অপসারিত হলেও আর্থ-সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ইতিবাচক ফল লাভের সম্ভাবনা সীমিত হতে বাধ্য।
এই সীমাবদ্ধতা সহজেই যে কারুরই চোখে পড়বার কথা। কিন্তু এই সীমাবদ্ধতার জন্য বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি বা কোন শাসক শ্রেণিকে দোষ যাওয়া যায় না। কারন সেটা তাদের সমস্যা নয়, তাদের রাজনীতিও নয়। সাধারন ভাবে বাংলাদেশের তথাকথিত বামপন্থাই এর জন্য দায়ী, কিম্বা সেটা মার্কসবাদ, লেনিনবাদ, মাওবাদ বা নানান কিসিমের বামের ব্যর্থতা। বাংলাদেশের শাসক শ্রেণী সর্বহারা, গরিব বা হতদরিদ্রদের জন্য রাজনীতি করে না। তারা শাসক শ্রেণী হিশাবে টিকে থাকবার জন্যই রাজনীতি করে। বাংলাদেশের মতো একটি পোস্ট কলোনিয়াল সমাজে বা রাষ্ট্রে ধনি হওয়ার ক্ষেত্র উৎপাদনশীল ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করে সম্ভব না। তার ক্ষেত্র হচ্ছে প্রধানত রাষ্ট্র বা রাষ্ট্র ক্ষমতা, বৈদেশিক বাণিজ্য এবং ব্যাংক। রাষ্ট্র তুলনামূলক ভাবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র কারন বড় বা বৃহৎ প্রকল্প থেকে ক্ষমতার জোরে অর্থ লুট করা সহজ। ক্ষমতায় থাকা বা না থাকাটা যে কারণে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে বাঁচা মরা বা টিকে থাকা না থাকার প্রশ্ন। শ্রেণী চরিত্র এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার বাস্তবতার কারনে বিএনপি নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি ছাড়া বাংলাদেশের কোন গুণগত সংস্কার বা রূপান্তরের দাবি তুলতে অক্ষম। এই বাস্তব পরিস্থিতি আমাদের বুঝতে হবে।
কিন্তু ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে জনগণের প্রবল ক্ষোভ ও রোষের মুখে বিএনপির মধ্যেও পরিবর্তন ঘটছে। ফলে ক্ষমতাসী্নদের ক্ষমতা থেকে অপসারণ করে জাতীয় সরকারের প্রস্তাব গুরুত্বপূর্ণ অগ্র পদক্ষেপ। এখন আমরা যারা গণমানুষের রাজনীতি করি এবং বাংলাদেশে শক্তিশালী গণরাজনৈতিক ধারার বিকাশ চাই আমাদের কাজ হচ্ছে যাদের কন্ঠস্বর গরহাজির এবং যাদের স্বার্থ জাতীয় রাজনীতিতে অনুপস্থিত তাদের কন্ঠস্বর তুলে ধরা এবং জাতীয় রাজনীতিতে তাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করবার লড়াই চালিয়ে যাওয়া। আমাদের রূপরেখার পর্যালোচনা অতএব যারা মাঠের আন্দোলনে সরবে হাজির নাই তাদের অবস্থান থেকে করতে হবে। কিন্তু সেটা সস্তা শ্লোগান বা মুখস্ত বিদ্যা আঊড়িয়ে করলে হবে না। করতে হবে বাস্তবের পাটাতনে দাঁড়িয়ে সুনির্দিষ্ট কর্তব্য নির্ণয় করে। করতে হবে জাতীয় রাজনীতিতে যে সকল তর্ক বিতর্ক চলছে তার পরিপ্রেক্ষিতে। বাংলাদেশে গণমুখী রাজনৈতিক ধারা গড়ে তুলবার সুনির্দিষ্ট নীতি ও কৌশলের প্রতি নজর রাখার মধ্য দিয়েই আমরা তাই বিএনপির ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা-র পর্যালোচনা হাজির করবার চেষ্টা করব।
প্রভাবশালী গণমাধ্যমে কারো কারো বক্তব্য দেখলাম বলা হচ্ছে রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখায় খুব বেশী নতুন কিছু নাই। কারন জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা ও খালেদা জিয়ার ভিশন-২০৩০-এর সংমিশ্রণে এই রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়েছে। ঘোষিত রূপরেখায় বিএনপি নিজেই সেটা বলছে। ‘রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের রূপরেখা’ নিয়ে আমাদের বিস্তর সমালোচনা আছে। কিন্তু এই রূপরেখায় ‘নতুন কিছুই নাই’ এই প্রকার মূল্যায়নের সঙ্গে আমরা একদমই একমত নই। এই রূপরেখা ঘোষিত হচ্ছে ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র শক্তি এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে একটি জাতীয় সরকারের প্রতিশ্রুতি ও অঙ্গীকার ঘোষণার মধ্য দিয়ে। এটা ঠিক যে তারেক রহমান এই ঘোষণা আগেই দিয়েছিলেন। কিন্তু তখন আন্দোলন-সংগ্রামের মাত্রা ও ব্যাপ্তি এখনকার মতো ছিল না। প্রাথমিক পর্যায়ে আন্দোলন গড়ে তোলা এবং অন্যান্য আন্দোলনকারী দল বা মতের সঙ্গে সম্বন্ধ তৈরির সম্ভাব্য কৌশল হিশাবে জাতীয় সরকারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রের ‘মেরামত’ বা রূপান্তরের আলোকে বিষয়টি হাজির হয় নি। কিন্তু এখন ঢাকা সমাবেশের পরে এই অঙ্গীকার ও প্রতিশ্রুতি আন্দোলন-সংগ্রামের দিক থেকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রস্তাব।
বিএনপি যদি রাজনৈতিক কৌশল হিশাবে ফ্যাসিস্ট শক্তিকে ক্ষমতা থেকে আন্দোলন সংগ্রামের দ্বারা ‘অপসারণ’ করে জাতীয় সরকার গঠন করে তাহলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রচলিত তত্ত্ব অনুযায়ী সেটা কোন সাংবিধানিক সরকার নয়, জনগণের বিজয়ী গণ অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত সরকার। এই ধরণের সরকারকে সাংবিধানিক সরকারের বিপরীতে বিপ্লবী’ সরকার বলা হয়। কারন এই ধরণের সরকার সাংবিধানিক ভাবে – অর্থাৎ সংবিধান দ্বারা বিধিবদ্ধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নয়, বিজয়ী গণ অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে জন্ম লাভ করে। বিএনপির নতুন ঘোষণায় তারই ইঙ্গিত রয়েছে। কিন্তু ইঙ্গিত দিয়েও বিএনপি তাকে নস্যাৎ করবার রূপরেখা হাজির করেছে।
 ‘রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখা’ বলছে, “চলমান আন্দোলনে জনতার বিজয় অর্জনের পর একটি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পরিচালনায় একটি অবাধ নির্বাচনে বিজয়ী হলে, সবার মতামত ও সম্মতির মাধ্যমে দেশ পরিচালনার নিমিত্তে, বর্তমান সরকারবিরোধী রাজপথের আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী সকল রাজনৈতিক দলসমূহকে নিয়ে ‘একটি জাতীয় সরকার’ গঠন করার প্রস্তাব করছি”।  তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে ‘চলমান আন্দোলনে জনগণের বিজয়’ মানে কি? জনগণের বিজয় মানে হচ্ছে বিজয়ী গণ অভূত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা থেকে উৎখাত। উৎখাতের পর আন্দোলন পরিচালনাকারী সংস্থাই জনগণের বিজয়ের পর বিপ্লবী অন্তর্বর্তী কালীন সরকারে পরিণত হয়। অর্থাৎ যারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেবে তারাই বিপ্লবী সরকার হিশাবে হাজির হয়। বিপ্লবী কারণ এই সরকার সাংবিধানিক ভাবে নয় ,ক্ষমতাসীনদের অসাংবিধানিক ভাবে উৎখাত করে গঠিত হয়। এটাই ‘অপসারণ’ কথাটার অর্থ।
কিন্তু ‘চলমান আন্দোলনে ‘জনতার বিজয়’কে বিএনপি ছিনিয়ে নিতে চাইছে। সেটা চাইছে বিপ্লবী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে বিএনপি ‘নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার’ বানিয়ে। ‘জনগণের বিজয়’কে বিএনপি পর্যবসিত করতে চায় জনগণের পরাজয়ে। অর্থাৎ তাকে নিয়ে আবার ঢোকাতে চায়  বিদ্যমান সংবিধানের অধীনে।  বিপ্লবী অন্তর্বর্তী সরকারকে স্রেফ নির্বাচন পরিচালনাকারী সংস্থায় পর্যবসিত করে নির্বাচনের মাধ্যমে একটি জাতীয় সরকার বিএনপি গঠন করতে চায়। এরপর টুকটাক সংস্কার করে পুরানা রাষ্ট্র ব্যবস্থাই টিকিয়ে রাখবার ব্যবস্থাপত্র পেশ করছে বিএনপি তার  ‘রাষ্ট্র মেরামত রূপরেখা’। এই প্রস্তাব আসলে জনগণের বিজয়কে আগাম নস্যাৎ করবার রূপরেখা। এ ব্যাপারে আমরা বিএনপির কাছ থেকে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দাবি করি।
আন্দোলন-সংগ্রামে জনগণের বিজয়ের মধ্য দিয়ে গঠিত সরকার  একান্তই ‘অন্তর্বর্তীকালীন বিপ্লবী সরকার’ ছাড়া ভিন্ন কিছুই হতে পারে না। সেই সরকারের কাজ বাংলাদেশকে নতুন ভাবে গঠন করবার জন্য নতুন ‘রাষ্ট্র গঠন সভা’ Constituent Assembly) ডাকা। তাকে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বানানো এবং  বিদ্যমান সংবিধান মেনে নিয়ে বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন দেওয়া এবং বিদ্যমান সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচনে জয়ীদের নিয়ে জাতীয় সরকার গঠন করা — পুরাটাই নতুন বোতলে পুরানা মদ পরিবেশনের চেষ্টা।  বিএনপি গণ আন্দোলন গণ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জনগণের বিজয়ী হবার পরও নতুন গঠনতন্ত্র প্রণয়ন সভা না ডেকে পুরানা সংবিধান বহাল  রাখবার কৌশল নিয়েছে।  বিএনপির তথাকথিত জাতীয় সরকার গঠন আসলে বিজয়ী গণ অভ্যূত্থানের মধ্য দিয়ে গঠিত সংবিধান বহির্ভূত ‘বিপ্লবী’ সরকারকে নাকচ বা নস্যাৎ করবার রণকৌশল।
যেহেতু গণ আন্দোলন গণ সংগ্রামের  মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীনদের ‘অপসারণ’ দিয়ে গঠিত সরকার সংবিধান বহির্ভূত সরকার, অতএব এই ধরণের সরকারকে বিদ্যমান সংবিধান দ্বারা ন্যায্য প্রমাণের কোন উপায় নাই। বিএনপির ফর্মূলা অনুযায়ী নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক যদি বিপ্লবী সরকার না হয় তাহলে এই সরকার অসাংবিধানিক ও অবৈধ। এই ধরণের সরকারের অধীনের নির্বাচনও অবৈঢ ও অসাংবিধানিক হবে। অতএব বিএনপির প্রস্তাবিত রূপরেখায় ‘জাতীয় সরকার’ গঠিত করা শেষাবধি পুরানা সংবিধান আবার জনগণের ওপর আরোপ করবার প্রস্তাব। শাসক শ্রেণী হিশাবে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের শ্রেণীগত মিলের জায়গাটা আমরা এখানে পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি। আওয়ামী লীগ তাদের দলের সুবিধার জন্য সংবিধান সংশোধন করেছে, বিএনপিও সাংবিধানিক ভাবে ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা থেকে অপসারণ করে নিজেদের দলীয় সুবিধা আদায় করবার জন্য পুরানা সংবিধানই আবার বহাল রাখবার কথা বলছে। কিন্তু বলছে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে, চাতুরির সঙ্গে। পুরানা সংবিধান বহাল রেখেই তার সংবিধানের টুকটাক সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছে। সারমর্মে এটাই তাদের ‘রাষ্ট্র মেরামতের রূপরেখা’।
ক্ষমতাসীন দলকে অসাংবিধানিক ভাবে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করে নিজেদের সুবিধামতো সংবিধান সংস্কারের ইতিহাস বাংলাদেশে নতুন কিছু না। অতীতে ঘটেছে। অসাংবিধানিক ভাবে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করার পর সেই অসাংবিধানিক কাজকে পুরানা সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ দিয়ে আবার বৈধ করা হয়েছে। এই অনুচ্ছেদের বিপদ ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে আমি এর আগে বহুবার আলোচনা করেছি। (আগ্রহীরা ‘সংবিধান ও গণতন্ত্র’ বইটি দেখতে পারেন)। সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদ ক্ষমতা, রাজনীতি এবং রাষ্ট্র গঠনের দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তর্কের বিষয়। এ নিয়ে আলাদা ভাবে আমাদের বিস্তর আলোচনা করতে হবে।
কিন্তু এবারকার পরিস্থিতি ভিন্ন। এই ভিন্নতার তিনটি দিক আমাদের বিবেচনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত শেখ হাসিনা যখন বলছেন তাঁকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ সহজ না, তাকে হুমকি হিশাবে ভাবলে চলবে না, আক্ষরিক অর্থে বুঝতে হবে। সর্বোপরি সাংবিধানিক অর্থেও বুঝতে হবে। বিএনপি দাবি করে এই সরকার রাতের ভোটে ক্ষমতায়, অতএব অনির্বাচিত এবং অবৈধ। কিন্তু সেই জাতীয় পরিষদে বিএনপির সদদ্যরা যোগ দিয়ে থেকেছেন এবং অবৈধ সরকারকে তারা বৈধতা দিয়েছেন। এই  ঘোর স্ববিরোধিতা বিএনপির রয়েছে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার কারনে অসাংবিধানিক ভাবে ক্ষমতা থেকে ক্ষমতাসীনদের অপসারণ আগের চেয়ে অনেক বেশী বিপজ্জনক। ফ্যাসিস্ট শক্তি বাংলাদেশে এখন অনেক বেশী সংগঠিত এবং শক্তিশালী। তাই উলটা ক্ষমতাসীন দল হিশাবে ফ্যাসিস্ট শক্তি সংবিধানের দোহাই দিয়ে দেশদ্রোহিতা হিশাবে অনায়াসেই ক্ষমতা থেকে তাদের অপসারণকে ‘অসাংবিধানিক’ আখ্যায়িত করতে পারে এবং তাদের সমর্থক আন্তর্জাতিক শক্তির সহায়তায় সাংবিধানিক ভাবে তাকে মোকাবিলা করবার বিস্তর আইনী ও সহিংস পথও তারা অবলম্বন করতে সক্ষম। সে কারনে শেখ হাসিনা যখন বলেন তিনি সাংবিধানিক ভাবে ক্ষমতায় এবং তাঁকে ক্ষমতা থেকে সরানো সহজ না, তিনি অসাংবিধানিক পন্থায় ক্ষমতা থেকে তাকে অপসারনের বিরুদ্ধে খোদ সংবিধানকেও অস্ত্র হিশাবে ব্যবহারের কথাই বলেন। আসলেই ‘অপসারণ’ এবার অতো সহজ না। এই রকম পরিস্থিতি তিনি আগেই অনুমান করেছিলেন বলে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী এনেছেন।
দ্বিতীয় দিক হচ্ছে ভূ-রাজনীতি। ক্ষমতাসীনদের প্রতি বিভিন্ন পরাশক্তির অবস্থান যাই থাকুক, অসাংবিধানিক ভাবে ক্ষমতা থেকে ক্ষমতাসীনদের অপসারণ প্রক্রিয়া যে অনিশ্চয়তা তৈরি করে কোন পরাশক্তি তার প্রতি নির্বিচারে সায় দেবে না। আন্দোলন-সংগ্রামের চরিত্র আরও গণমুখী না হলে এবং কৃষক, শ্রমিক মেহনতি জনগণ আন্দোলনে অংশগ্রহণ না করলে আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ‘জাতীয় সরকার’ গঠন করা হলেও শেষাবধি তার ফল যেই লাউ সেই কদুর অতিরিক্ত কিছু হবে না।
এখান থেকে আমরা তৃতীয় দিকের বিচারে আসতে পারি। সেটা হোল বাস্তবে ফ্যাসিবাদ, ফ্যাসিস্ট শক্তি ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থা উৎখাত করে বাংলাদেশকে নতুন ভাবে ‘গঠন’ করবার চেতনা জনগণের মধ্যে আমরা কতোটা সঞ্চার করতে পেরেছি? আমরা গণ আন্দোলন গণ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিজয়ী গণ অভ্যূত্থান সফল করবার পর আবার ১৪২ অনুচ্ছেদ দিয়ে জনগণের অর্জনকে ফ্যাসিস্ট সংবিধান দিয়ে বৈধ করবার পথ বেছে নেব কি?  ক্ষমতাসীনদের ক্ষমতা থেকে অপসারণ করে পুরানা ফ্যাসিস্ট সংবিধান আবার কার্যকর করাই কি আমাদের কাজ? তার জন্য কি আমরা রক্ত দেব, আর লাশ হয়ে যাব?  নাকি আমরা বাংলাদেশকে নতুন ভাবে ‘গঠন’ করব, নতুন ‘গঠনতন্ত্র’ প্রণয়ন করব?  বাংলাদেশকে আমরা নতুন ভাবে গঠন করতে চাই নাকি চাই না সেটাই জনগণের দিক থেকে আমাদের এখনকার মৌলিক রাজনৈতিক প্রশ্ন।
আমরা মনে করি, গণচেতনাই শেষাবধি আন্দোলন-সংগ্রামের ফলাফল নির্ণয়ের ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করবে। আমার ধারণা জনগণের চেতনার মাত্রা আগের চেয়ে উন্নত এবং জনগণ অর্থপূর্ণ অর্জন চায়। কিন্তু জনগণ কি চায় বা না চায় তাকে অনুমান হিশাবে ধরে নেওয়া ঠিক নয়, গণচেতনার বিকাশ ঘটানোই গণমানুষের রাজনীতি। আমরা আদৌ ঠিক বলছি কিনা সেটা আগামি দিনগুলোতেই স্পষ্ট হবে। (চলবে)
The artcile appeared in Farhad Mazhar’s Facebook presentation.