বিএনপির যুগপৎ সঙ্গী : কর্মসূচি নেই, তবে যোগাযোগ আছে

বিএনপি

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দুই মাস পার হয়েছে। এখনো যুগপৎ আন্দোলন-কর্মসূচিতে ফেরেনি বিএনপিসহ নির্বাচন বর্জনকারী দলগুলো। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ভোটের পর কর্মসূচি না থাকায় যুগপৎ আন্দোলনে ছন্দপতন হয়েছে।

সরকার পতনের এক দফার আন্দোলনের মুখেও গত ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন করতে পেরেছে ক্ষমতাসীনেরা। এমন পটভূমিতে বিএনপিসহ যুগপৎ আন্দোলনের অন্য দল ও জোটগুলোতেও কিছুটা হতাশা তৈরি হয়েছে; থমকে গেছে দলগুলোর ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার আন্দোলন।

যুগপৎ আন্দোলনের শরিক একাধিক দল ও জোটের দায়িত্বশীল নেতারা জানিয়েছেন, নির্বাচন ঘিরে সারা দেশে বিএনপির নেতা-কর্মীদের বড় একটি অংশকে কারাবন্দী করায় আন্দোলনের গতি কমে যায়। এর রেশে কর্মসূচিতেও ছেদ পড়ে। তবে এ মুহূর্তে যুগপৎ কর্মসূচি না থাকলেও আন্দোলনের প্রধান দল বিএনপির সঙ্গে মিত্র দলগুলোর যোগাযোগ রয়েছে। এরই মধ্যে একাধিক জোটের সঙ্গে বিএনপির নীতিনির্ধারণী নেতাদের আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হয়েছে। এখন ভোট বর্জনকারী বিভিন্ন দল ও জোট যার যার মতো করে কর্মসূচি পালন করছে।

বিএনপি ২০-দলীয় জোট ও জাতীয় ঐক্য ফ্রন্ট নামে দুটি জোট করে অংশ নিয়েছিল ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচনে। এবার নির্বাচনের আগে দুই জোট ভেঙে দিয়ে বিএনপি একাধিক জোট ও দলের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলন করে। এর মধ্যে বাম ঘরানার ৫–দলীয় জোট গণতন্ত্র মঞ্চ, পুরোনো ২০–দলীয় জোটের শরিকদের নিয়ে গঠিত ‘১২–দলীয় জোট’ ও ‘জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট’ অন্যতম। এর বাইরে অলি আহমদের লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), এবি পার্টি, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, গণফোরাম ও পিপলস পার্টি, গণ অধিকার পরিষদের দুই অংশ রয়েছে। সবাই এখনো বিএনপির সঙ্গেই আছে।

সংশ্লিষ্ট নেতারা বলছেন, চলতি রমজান মাসে বিএনপিসহ কয়েকটি দল পৃথক ইফতার অনুষ্ঠান করবে। এই রোজায় ইফতারের মাধ্যমে ভোট বর্জনকারী দলগুলোকে আরও ঘনিষ্ঠ করার চেষ্টা করবে বিএনপি। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ২১ মার্চ চিকিৎসা শেষে সিঙ্গাপুর থেকে দেশে ফিরতে পারেন। তিনি ২৪ মার্চ কূটনীতিক এবং ২৮ মার্চ রাজনীতিকদের সম্মানে বিএনপি আয়োজিত ইফতার অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন। এই অনুষ্ঠানে ভোট বর্জনকারী সব দলকে আমন্ত্রণ জানানোর কথা রয়েছে।

১২–দলীয় জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও বাংলাদেশ লেবার পার্টির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম

কারামুক্ত বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ নেতাদের অনেকে নানা শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন। তাঁদের অনেকে দেশে ও বিদেশে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ঈদের পর বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্ষদে আলোচনার পর নতুন করে আন্দোলন সংগঠিত করার বিষয়ে সিদ্ধান্ত হতে পারে। তখন যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দল ও জোটগুলোর সঙ্গে বসবে বিএনপি।

গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যুগপৎ আন্দোলনে আছি। যারা নির্বাচন বর্জন করেছে, তাদের সবাই আন্দোলনে আছে। বলতে পারেন, আন্দোলনে সবাই সমানতালে নেই। আন্দোলনের নতুন কর্মকৌশল নিয়ে দলগত আলোচনা হচ্ছে, পরে যৌথভাবে (বিএনপির সঙ্গে) আলোচনা হবে।’

বিএনপির দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, এই রমজানে বিএনপি ইফতার অনুষ্ঠানে বেশ গুরুত্ব দিয়েছে। এবার সাংগঠনিকভাবে সারা দেশে গুম-খুনের শিকার নেতা-কর্মীদের পরিবার এবং কারা নির্যাতিত নেতা-কর্মীদের সম্মানে ইফতার অনুষ্ঠান করার নির্দেশনা রয়েছে। কর্মসূচিগুলোতে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভার্চ্যুয়ালি অংশ নিতে পারেন। মূলত এবারের রোজায় ইফতার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নেতা-কর্মী ও সমর্থকদের সঙ্গে সম্পৃক্ততা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনগুলো পুনর্গঠনে মনোযোগ দিচ্ছেন বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব।

গণতন্ত্র মঞ্চের নেতা ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি

 

যোগাযোগ আছে জামায়াতের সঙ্গেও

বিএনপির আন্দোলনে অন্যতম শরিক দল জামায়াতে ইসলামীও এ মুহূর্তে নিজস্ব কর্মসূচি করছে। প্রতি রমজানে দলটির ইফতার অনুষ্ঠান ছাড়াও সাংগঠনিকভাবে ‘দাওয়াতি’ ও ‘প্রশিক্ষণমূলক’ কার্যক্রম থাকে। যুগপৎ কর্মসূচি না থাকায় এ রোজায় এসব কার্যক্রমে জোর দিয়েছে জামায়াত। দলের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল হালিম গত মঙ্গলবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখন আমরা নিজস্ব কর্মসূচি করছি। এ মুহূর্তে যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচি নেই, তবে বিএনপির সঙ্গে আমাদের রাজনৈতিক যোগাযোগ আছে।’

১২–দলীয় জোটের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও বাংলাদেশ লেবার পার্টির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা জোটগতভাবে বিএনপির সঙ্গে আছি। আমরা চাই, বিএনপি তাদের সাংগঠনিক দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করে দল পুনর্গঠন করুক। এরপর পূর্ণ শক্তি নিয়ে মাঠে নামুক।’

যদিও যুগপৎ আন্দোলনের একাধিক শরিক দলের নেতা মনে করেন, বিএনপির নেতৃত্ব এখনো আন্দোলনে ব্যর্থতার পর্যালোচনা করেননি। একই সঙ্গে নেতা-কর্মীদের হতাশা কাটানোর কোনো উপায়ও বের করতে পারেননি। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং একতরফা ভোটের বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলের কোনো পদক্ষেপও দৃশ্যমান নয়। এ অবস্থায় কেবল দল পুনর্গঠনের নামে সংগঠন নাড়াচাড়া করে কোনো লাভ হবে না। এ ছাড়া বিএনপিতে দক্ষ নেতৃত্বের অভাব রয়েছে, যা বিগত আন্দোলনের বাঁকে বাঁকে ফুটে উঠেছে।

বিগত আন্দোলনে ‘সমন্বয়হীনতা’ ও ‘সিদ্ধান্তহীনতার’ কথা জানান যুগপৎ আন্দোলনের শরিক দল গণ অধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক (নুর)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘নির্বাচনের পর বিএনপির সঙ্গে বৈঠকে এ বিষয়গুলো আমরা আলোচনা করেছি।’

নুরুল হক উল্লেখ করেন, তাঁরা বিএনপিকে কিছু প্রস্তাবও দিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, পরবর্তী আন্দোলনে যেতে হলে দুর্বলতার জায়গাগুলো ঠিক করে এগোতে হবে। বিশেষ করে আন্দোলন ও কর্মসূচির সিদ্ধান্তের জন্য বিএনপির একটি টিম করা যায় কি না, যারা দেশের পরিবেশ-পরিস্থিতি বুঝে ঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

Prothom Alo