বিএনপির বহিষ্কৃত নেতারা দু’কূল হারানোর ভয়ে

বিএনপির বহিষ্কৃত নেতারা দু’কূল হারানোর ভয়ে

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও ভোট বর্জনের ডাক দিয়েছে বিএনপি। সেই প্রক্রিয়ায় দলের নেতাকর্মীকে ভোটকেন্দ্রে না যেতে যেমন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তেমনি সাধারণ মানুষকেও ভোট বর্জনের আহ্বান জানানো হয়েছে। অবশ্য দলের এমন কঠোর সিদ্ধান্ত অমান্য করেও যারা লোভে ও প্রলোভনের পাশাপাশি নিজের জনপ্রিয়তা যাচাই করতে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, তাদের অনেকেই এখন সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করছেন। প্রার্থীদের কেউ কেউ বলছেন, নির্বাচনে অংশ নিয়ে এখন তাদের দু’কূলই হারাতে হতে পারে। দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ারও ধ্বংসের মুখে পড়তে পারে বলেও আশঙ্কা ব্যক্ত করছেন তারা।

দলের কঠোর সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রথম ধাপের উপজেলা নির্বাচনে বিএনপির ৮০ নেতা অংশ নিচ্ছেন। এর মধ্যে চেয়ারম্যান পদে ৩৫, ভাইস চেয়ারম্যান পদে ২৫ এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে ২০ জন রয়েছেন। দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করায় এরই মধ্যে তাদের বহিষ্কারও করা হয়েছে।

বিএনপির শীর্ষ নেতারা মনে করছেন, এ সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে না। এ ছাড়া জাতীয় নির্বাচনের মতো একতরফা উপজেলা নির্বাচনেও ক্ষমতাসীনরা নিজেরা-নিজেরা দখলের রাজনীতি শুরু করবে। সেখানে টাকার খেলা হবে, ক্ষমতার লড়াই হবে। তাই অহেতুক সাজানো এই নির্বাচনে অংশ নিয়ে নেতাকর্মীরা মামলা-হামলার শিকার হবেন। যেখানে জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটবে না, সেই নির্বাচন বর্জন আবশ্যক। দলের শীর্ষ নেতাসহ তৃণমূল নেতাকর্মীর এমন মনোভাবের ভিত্তিতে উপজেলা নির্বাচন বয়কটের সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি।

বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত অনেক প্রার্থী সমকালকে অভিযোগ করে জানান, সুষ্ঠু নির্বাচন হবে– এমন আশ্বাসে তারা নির্বাচনে অংশ নিলেও এখন নানা শঙ্কা কাজ করছে। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর নেতাদের সঙ্গে যদি প্রশাসনও একাকার হয়ে যায়, তাহলে তাদের সবকিছুই শেষ হয়ে যাবে। একদিকে দল থেকে বহিষ্কৃত, অন্যদিকে জনপ্রতিনিধি হওয়ার স্বপ্নও ভেস্তে যাবে। এরই মধ্যে অনেক স্থানে প্রচার-প্রচারণায় বাধার ঘটনা ঘটেছে।

ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলা চেয়ারম্যান পদে অংশ নেওয়া ফুলপুর পৌর বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ইমরান হাসান পল্লব সমকালকে জানান, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে– এমন আশ্বাসে নির্বাচনে অংশ নিলেও প্রচার-প্রচারণায় বাধা দেওয়া হয়েছে। এখন দিনের ভোট যদি রাতে না হয়, জনগণ যদি ভোট দিতে পারে, তাহলে নির্বাচন হবে। আবার ভোটের দিন আওয়ামী লীগ ও প্রশাসন যদি একাকার হয়ে যায়, তাহলেও নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। আর সেই আশঙ্কাই কাজ করছে তাঁর।

পিরোজপুরের ইন্দুরকানী উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থী ফায়জুল কবির তালুকদার জানান, দল থেকে বহিষ্কার করলেও দলের সাধারণ নেতাকর্মী ও এলাকাবাসী তাঁর সঙ্গে রয়েছে। তিনি জানান, সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা দিতে তাঁর কর্মী-সমর্থকদের ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা ভয়ভীতি প্রদর্শন করছেন, যাতে ভোটকেন্দ্রে না যায়। তিনি এ বিষয় পুলিশকে জানিয়েছেন।

ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটা উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী হুমায়ুন কবির, শেরপুর শ্রীবরদী উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী সাদমান সৌমিক মুন, সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলায় চেয়ারম্যান প্রার্থী গোলাপ মিয়া, মানিকগঞ্জের সিংগাইরে চেয়ারম্যান প্রার্থী তোফাজ্জেল হোসেনসহ অনেকেই সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে এমন শঙ্কা প্রকাশ করেন।

তবে কয়েক স্থানে বিএনপির প্রার্থীরা ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নির্বাচনের মাঠে অবস্থান করছেন। সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলায় স্থানীয় এমপি প্রভাব বিস্তার না করলেও আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দুই প্রার্থীর সমর্থকরা মারমুখী অবস্থানে রয়েছেন। আওয়ামী লীগ নেতা সাবেক উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অবনী মোহন দাস ও বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত সাবেক চেয়ারম্যান গনেন্দ্র চন্দ্র সরকারের মধ্যে সেখানে লড়াই হতে পারে। সাম্প্রদায়িক ও আঞ্চলিকতা নিয়ে উপজেলায় প্রভাব বিস্তারের আশঙ্কা করছেন সাধারণ ভোটাররা। ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলা নির্বাচনে বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত নেতা আবদুল হামিদ শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে মাঠে রয়েছেন। স্থানীয়রা মনে করছেন, নির্বাচন সুষ্ঠু হলে তাঁর জয়ের সম্ভাবনা বেশি।

ভোট বর্জনের আহ্বান

এদিকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো উপজেলা নির্বাচনকেও ভোটারবিহীন করতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে বিএনপি। আসন্ন উপজেলা নির্বাচনে দলের কোনো পর্যায়ের নেতাকর্মী যাতে অংশ না নেয়, সে বিষয়ে নানা কর্মসূচি পালন করে আসছে দলটি। সেখানে নির্বাচনে যাতে দলের কর্মীরা সম্পৃক্ত না হতে পারে, সে জন্য তাদের সতর্ক করতে সারাদেশে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কর্মিসভা চলছে। সেখানে শুধু নেতাকর্মী নয়, সাধারণ জনগণের মধ্যেও এই নির্বাচনকে অহেতুক আর সাজানো-পাতানো উল্লেখ করে ভোটদানে নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। শান্তিপূর্ণ এ কর্মসূচির মাধ্যমে বিগত দিনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যে তাদের মতামতের প্রতিফলন ঘটেনি, সেসব চিত্র তুলে ধরা হয়।

গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে উপজেলা নির্বাচনে ভোট বর্জন সংবলিত দলীয় লিফলেট বিতরণকালে দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী উপজেলা নির্বাচনের দিন ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে না যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, এই ভোট হচ্ছে ডামি ভোট, এই ভোট হচ্ছে প্রহসনের ভোট, এই ভোট হচ্ছে জালিয়াতির ভোট। এই ভোটে জনগণ অংশগ্রহণ করবে না। সবার প্রতি আহ্বান জানিয়ে দলটির নেতারা আরও বলেছেন, সারাদেশে আপনাদের যেখানে আত্মীয়স্বজন-ভাইবোন আছে, সবাইকে বলবেন কেউ যেন ভোটকেন্দ্রে না যায়। এই ডামি সরকারকে যেন কেউ সমর্থন না করে।

রাজধানীর বনানী এলাকায় পথচারী, যানবাহন চালক ও যাত্রীদের হাতে উপজেলা নির্বাচনের ভোট বর্জন সংবলিত লিফলেট বিতরণ করেন তিনি। এ সময় তাঁর সঙ্গে দলের সহ-অর্থনৈতিকবিষয়ক সম্পাদক মাহমুদুর রহমান সুমন, মহিলা দলের সাধারণ সম্পাদক সুলতানা আহমেদ, ছাত্রদলের সাবেক নেতা তৌহিদুর রহমান আউয়াল, মহিলা দলের রেহানা সুলতানা আরজু, পান্না ইয়াসমীন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে তৃণমূল নেতাকর্মী ও সমর্থকদের ভোটকেন্দ্র থেকে দূরে রাখতে কাজ করছেন বিএনপির শীর্ষ নেতারা। এর ধারাবাহিকতায় গত সোমবার বিকেলে উপজেলা নির্বাচন নিয়ে নয়াপল্টনে ঢাকা জেলা বিএনপি, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের যৌথ জরুরি সভা হয়। সেখানে দায়িত্বশীল নেতাদের বেশকিছু নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। ভোটের দিন শান্তিপূর্ণভাবে ভোটবিরোধী প্রচেষ্টা চালানো, নেতাকর্মী কারও পক্ষে কাজ করলে তাদের নিবৃত করা ও নেতাকর্মী ভোটকেন্দ্রে গেলে তাদের চিহ্নিত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। শুধু ঢাকা বিভাগ নয়, দেশের অন্যান্য বিভাগের নেতাকর্মীকেও এমন নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।

ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম আজাদ বলেন, নেতাকর্মীকে ভোটদানে বিরত থাকার দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। দলীয় সিদ্ধান্ত মতো বিএনপির কেউ ভোটকেন্দ্রে যাবে না। কারও পক্ষে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে কাজ করবে না। প্রতিরোধও গড়বেন না। তবে মানুষকে ভোটদানে নিরুৎসাহিত করা হবে।

samakal