প্রথম আলোর যুগ্ম–সম্পাদক ও কবি
বিএনপিকে ‘সঠিক পথে পরিচালিত হওয়ার’ আহ্বান জানিয়েছে সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ। গত মঙ্গলবার রাত সোয়া ১১টার দিকে গণমাধ্যমে পাঠানো বিবৃতিতে আওয়ামী লীগের নেতারা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, দলটি সঠিকভাবে পরিচালিত না হলে ১৯ নভেম্বর সিলেটের গণসমাবেশসহ সব ধরনের কর্মসূচি প্রতিহত করা হবে।
বিবৃতির ভাষাটি লক্ষ করুন। দুটি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। সঠিক পথ ও প্রতিহত।
এত দিন আমরা দেখে এসেছি, নিজ দলের কর্মীদের কেউ বিপথে গেলে দলের নেতা সতর্ক করে দেন। তাঁকে সঠিক পথে আসতে বলেন। এবার সিলেট আওয়ামী লীগের নেতারা বিএনপিকেও সঠিক পথে আনার দায়িত্ব নিয়েছেন। সব সম্ভবের বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য ভোট ছাড়া সবই করা সম্ভব।
আওয়ামী লীগ তার কর্মসূচি পালন করবে। বিএনপি তার কর্মসূচি পালন করবে। জনগণের কাছে নিজ নিজ কর্মসূচি তুলে ধরবে। এতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু যদি কোনো দল অপর দলের নেতা-কর্মীদের ‘সঠিক পথে’ আনতে চায়, কিংবা প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়, তখনই সমস্যা দেখা দেয়।
আসলে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতা-কর্মীদের কেউ কি সঠিক পথে আছেন? থাকলে দেশে এত সমস্যা ও সংকট কেন? জিনিসপত্রের দাম হু হু করে বাড়ছে। সরকার বলছে, ইউক্রেন যুদ্ধ। দেশে গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট চলছে। সরকার বলছে, ইউক্রেন যুদ্ধ। ব্যাংকে ডলার সংকট। সরকার বলছে, ইউক্রন যুদ্ধ। মেনে নিলাম। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে যে সংকট চলছে, সেটা তো ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ঘটেনি। আপনারাই ঘটিয়েছেন। কেউ ১৬ বছর আগে। কেউ ১৬ বছর পর। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে দেশ স্বাধীন হয়েছে, সেই দেশে নির্বাচন নিয়ে কেন তারা ঐকমত্যে আসতে পারছেন না।
বিএনপি সিলেটে বিভাগীয় গণসমাবেশ ডেকেছিল ১৯ নভেম্বর। এরই মধ্যে দলের সাবেক স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক আ ফ ম কামাল গত রোববার রাত সোয়া আটটায় নগরের আম্বরখানা এলাকায় খুন হলেন। আওয়ামী লীগের দাবি, বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে তিনি খুন হয়েছেন। জেলা বিএনপির দাবি, এ খুনের সঙ্গে সরকারদলীয় সংগঠনের নেতা-কর্মীরা জড়িত। ওই রাতেই বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের একটি বিক্ষোভ মিছিল থেকে জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন উপলক্ষে নির্মিত তোরণ, ব্যানার, ফেস্টুন ভাঙচুরের অভিযোগ ওঠে। ভাঙচুরের খবর পেয়ে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে ভাঙচুরকারীদের ধাওয়া দেন। এ সময় লাঠিসোঁটা নিয়ে পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এ সময় একটি প্রাইভেট কার ভাঙচুর ও মোটরসাইকেল আগুন দিয়ে পোড়ানো হয়। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে পরিস্থিতি শান্ত করে। এ সময় আওয়ামী লীগের নেতারা ভাঙচুরে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা না হলে ১৯ নভেম্বর বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশ প্রতিহত করার ঘোষণা দেন।
দখল, পাল্টা দখল, প্রতিহত করা এখন দুই দলের রাজনৈতিক পরিভাষা। কেউ কারও থেকে কম যায় না। এক দল বলছে, খেলা হবে। আরেক দল বলছে, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড ছাড়া খেলা হয় না।পুলিশ-প্রশাসন ছাড়া আসুন। দুই পক্ষই চায় নিজ নিজ শর্তে খেলা হোক। কিন্তু খেলার যে নিয়ামক শক্তি জনগণ, তাদের কথা কেউ ভাবে না।
সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের দাবি, বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বের কারণে মারা যান আ ফ ম কামাল। কিন্তু তারা দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও ব্যবসায়িক দ্বন্দ্বকে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বে পরিণত করার পাঁয়তারা করছে। এটাই বিএনপির চরিত্র। তারা নিজেদের দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপাতে সব সময়ই সিদ্ধহস্ত। কিন্তু জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগ কোনোভাবেই তা হতে দেবে না। সিলেটে বিএনপিতেই কেবল দলীয় কোন্দল নেই। আওয়ামী লীগেও নানা ধারা। কেউ নিষ্ক্রিয়। কেউ উজ্জীবিত।
সিলেটে আওয়ামী লীগ বিএনপি অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে জর্জরিত। কিন্তু নেতারা সে কথা স্বীকার করতে চান না। বরং অন্যদের ওপর দোষ চাপিয়ে আত্মরক্ষা করতে চান। দেশের বিভিন্ন স্থানে আওয়ামী লীগের জেলা ও উপজেলা স্তরে যেসব সম্মেলন হচ্ছে, তাতেও কোথাও কোথাও মারপিট, হাঙ্গামা ঘটছে। গত সপ্তাহে কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন যখন চলছিল, দলের একশ্রেণির নেতা-কর্মী বাইরে রাস্তায় লাঠিসোঁটা নিয়ে সংঘাতে লিপ্ত হচ্ছেন। পত্রিকা ও টিভির কল্যাণে দেশবাসীও তা দেখেছে। এসব নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতারা খুব চিন্তিত বলে মনে হয় না। তারা ব্যস্ত প্রতিপক্ষকে কীভাবে ঘায়েল করবেন।
আওয়ামী লীগের অভিযোগ হলো সিলেট বিএনপির নেতা আ ফ ম কামালের মৃত্যুর পর বিএনপির মিছিল থেকে আওয়ামী লীগের তোরণ, ব্যানার ও ফেস্টুন ভাঙচুর করা হয়েছে। যদি বিএনপির মিছিল থেকে কেউ ব্যানার, ফেস্টুন, তোরণ ভাঙচুর করে থাকে, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। আওয়ামী লীগ নেতারা বিএনপির অজ্ঞাতনামা নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। মামলার তদন্ত হয়নি। এখনই তারা হামলাকারী শনাক্ত করে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছেন।
বিএনপিকে সঠিক পথে আনার দায়িত্ব নেওয়ার আগে আওয়ামী লীগের উচিত নিজ দলের নেতা-কর্মীদের সঠিক পথে আনা। আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে, তা সিলেট বিএনপির নেতা-কর্মীদের নামে আনা অভিযোগের চেয়েও গুরুতর। কোথাও তাঁরা রাস্তায় চৌকি বসিয়ে পাহারা দিয়েছেন, যাতে বিএনপির সমাবেশে কেউ যেতে না পারেন (বাগেরহাট), আবার কোথাও সমাবেশগামী বিএনপির নেতাদের ওপর মাইক্রোবাসে হামলার ঘটনা ঘটেছে (বরিশাল)। কোথাও বা অতি উৎসাহী আওয়ামী লীগের নেতারা মাইকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন, কেউ বিএনপির সমাবেশে যাবেন না (চট্টগ্রাম)।
আওয়ামী লীগ তার কর্মসূচি পালন করবে। বিএনপি তার কর্মসূচি পালন করবে। জনগণের কাছে নিজ নিজ কর্মসূচি তুলে ধরবে। এতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু যদি কোনো দল অপর দলের নেতা-কর্মীদের ‘সঠিক পথে’ আনতে চায়, কিংবা প্রতিহত করার ঘোষণা দেয়, তখনই সমস্যা দেখা দেয়। বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঠিক পথে আনার দায়িত্ব আওয়ামী লীগের নয়। বিএনপির নেতা-কর্মীরা বেআইনি কিছু করলে সেটি দেখার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আছে।
- সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি